তা র রুমমেটের যদি সে দিন ফ্লু না হত, তা হলে অ্যানাকে ক্রিশ্চিয়ান গ্রে-র সাক্ষাৎকার নিতে যেতে হত না! আর অ্যানার পৃথিবীটাও এ ভাবে পালটে যেত না! অ্যানার বয়স সবে একুশ। ক’দিন পরেই ইংরেজি সাহিত্যে গ্র্যাজুয়েট হবে। এবং সে এখনও অনাঘ্রাতা ফুলের মতোই কুমারী! মস্ত অফিস-চেম্বারের দরজায় অ্যানা যখন প্রথম বার হোঁচট খেয়ে পড়ল, তার গহন ‘সমর্পিতা’ ভাবটুকু বুঝে নিতে একটুও ভুল হয়নি ক্রিশ্চিয়ান গ্রে-র। মাত্র সাতাশেই গ্রে ভুবনজোড়া এক বাণিজ্য-সাম্রাজ্যের বেতাজ বাদশা। সে অফিস যায় নিজের হেলিকপ্টারে চড়ে। অ্যানার সঙ্গে সাক্ষাৎকারেই সে বুক বাজিয়ে বলেছিল, তার সবটাই বিশুদ্ধ ধান্দা— হৃদয়বাজির কারবারে সে নেই।
অ্যানা ভেবেছিল, এ সব বুঝি কথার কথা। বাইরের লোককে ভড়কি দেওয়া। আসল মানুষটা নিশ্চয়ই ও রকম নয়। হয়তো একটু কর্তালি ফলাতে ভালবাসে। তা অত বড় কোম্পানি, অতগুলো কর্মচারী, একটু শক্ত মুঠোয় রাশ না ধরলে চলে? অ্যানা সেই প্রথম দেখার দিন থেকেই তো ক্রিশ্চিয়ানের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। গ্রে-র কাছ থেকে সে একটা রূপকথার মতো রোম্যান্টিক প্রেমের গল্পের প্রত্যাশায় থাকে। আর হাড়ে-মজ্জায় মধ্যবিত্ত, হার্ডওয়্যার দোকানের পার্টটাইম সেল্সগার্ল অ্যানার কাছে গ্রে তো রাজপুত্তুরই। পক্ষীরাজ ঘোড়ার মতোই কপ্টারে চাপিয়ে সে অ্যানাকে ওয়াশিংটন থেকে সিয়াট্লে তার প্রাসাদ অ্যাপার্টমেন্টে উড়িয়ে নিয়ে আসে। অ্যানার গ্র্যাজুয়েশনের খুশিতে তাকে চকচকে নতুন একটা গাড়ি উপহার দেয়। কিন্তু তার পর কী হয়? গ্রে ক্রমাগত অ্যানাকে সেই যৌনতার দিকে ঠেলতে থাকে, যার চলতি নাম BDSM, যেখানে এক জন আর এক জনকে অত্যাচার করে যৌন আনন্দ পায়, অন্য জনও সেই অত্যাচার মেনে নেয়। চুম্বনের চেয়ে এই প্রেমে চাবুকের ভূমিকা বেশি। অ্যানা আর গ্রে-র সেই অদ্ভুত অন্য রকম রোমান্স ও যৌনতার আখ্যান লিখেছেন ব্রিটিশ লেখক ই এল জেম্স। প্রায় সব সমালোচক এ বইয়ের প্রচুর নিন্দে করেছেন, আর পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বইয়ের কাটতি।
এ রকম একটা বাজার-বন্দিত ও বুদ্ধিজীবী-নিন্দিত কাহিনিকে সিনেমায় আনাটা সব সময়ই ঝুঁকির। মুক্তির আগেই তাই একাধিক সংগঠন ছবিটাকে বয়কটের দাবি তোলে। কিন্তু ছবিটায়, উপন্যাসের গায়ে জড়ানো তথাকথিত ‘ইরোটিক রোমান্স’-এর তকমাটা পরিচালক খুলতে খুলতে চলেন। যে ঘরানার কামকলা নিয়ে এত ফাটাফাটি আর মাতামাতি, বন্ধন-কর্তৃত্ব-ধর্ষকাম ও মর্ষকামের সেই যৌন খেলাই এখানে আধিপত্য ও সমর্পণ, ক্ষমতা ও প্রতিরোধের অন্য গল্প হয়ে ওঠে। গ্রে এখানে অ্যানার শরীর আর মনটাকে সে ভাবেই দখল করতে চায়, যে ভাবে কলোনির ‘নেটিভ’দের একদা দখল করতে চাইত সাম্রাজ্য! বা বহুজাতিক তাঁবে রাখতে চায় তার বিশ্বজোড়া বাজারকে। দখলদারির এই গেম-প্ল্যানে কর্তৃত্বকে সইয়ে নেওয়ার একটা ছক থাকে। কপ্টারের উড়ানে অ্যানার সিটবেল্ট বেঁধে দেওয়ার ডিটেলে যে আধিপত্যের আভাস থাকে, অ্যানা তাকে যত্ন ভাবে। গ্রে-র খেলাঘরে হাতকড়া বাঁধা অবস্থায় সারা শরীরে চাবুকের আলতো নরম সুড়সুড়ি তার কাছে তখনও সোহাগের এক উত্তেজক রকমফের। ছবির শেষ পর্বে সেই চাবুকই যখন টেবিলে উপুড়-নতজানু-নগ্ন অ্যানার পিঠে গুনে গুনে ছ’বার কালশিটে ফেলে, সে তখনই বুঝে যায় ‘প্রভু’ গ্রে তার যৌন-দাসীদের কাছ থেকে ঠিক কী ধরনের বশ্যতা চায়। অ্যানা গ্রে-কে ভালবাসার ভান নিয়ে তার শরীরের ধারেকাছে আর ঘেঁষতে দেয় না। শেষ দৃশ্যে গ্রে-র ক্ষমতা ও প্রতাপের মুখের ওপর অ্যানার লিফ্টের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এই পর্ব অবধি অন্তত প্রতিরোধের চেষ্টাটা জারি থাকে। সিকোয়েল-এ কী হবে, আমরা জানি না।
sanajkol@gmail.com