বিরিঞ্চিবাবার বিপণি

সেখানে আছে নিরামিষাশী বাঘ, সিংহ। বাঙালি লেখক পরশুরাম আগেই লিখে গিয়েছেন! বিশ্বজিৎ রায়ভা বছি একটা দোকান খুলব। হরেক মালের দোকান। তবে হরেক মালের এক দাম হবে না, হতে পারে না। হরেক মালের এক দাম চিনে দোকানে হয়। আমার এই সনাতন ভারতীয় দ্রব্যের সুসজ্জিত সম্ভার বর্ণাশ্রমে বিশ্বাসী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share:

ছবি: কুনাল বর্মণ

ভা বছি একটা দোকান খুলব। হরেক মালের দোকান। তবে হরেক মালের এক দাম হবে না, হতে পারে না। হরেক মালের এক দাম চিনে দোকানে হয়। আমার এই সনাতন ভারতীয় দ্রব্যের সুসজ্জিত সম্ভার বর্ণাশ্রমে বিশ্বাসী। যেমন মাল তেমন দাম— হরেক মালের এক দামের ভুল সাম্যে সনাতন ভারত বিশ্বাস করে না।

Advertisement

দোকান দোকান করছি বটে, তবে দোকান ম্লেচ্ছ শব্দ। তাই সাইনবোর্ডে লিখব, ‘বিরিঞ্চিবাবার বিচিত্র বিপণি’।

বিরিঞ্চিবাবা বাঙালিদের চেনা-জানা নাম। ‘বিরিঞ্চিব্র্যান্ড’ পরশুরামের সৃষ্টি। পরশুরামের আসল নাম রাজশেখর বসু। তিনি জগদীশচন্দ্র বসুর ছাত্র, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বেঙ্গল কেমিক্যাল-এর ম্যানেজার হয়েছিলেন। রামায়ণ, মহাভারত অনুবাদ করেছিলেন। ভাল সংস্কৃত জানতেন। হাতের লেখা চমৎকার, শ্বেতশুভ্র ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন। দেশজ শিল্পোদ্যোগে বিশ্বাস ছিল। সুতরাং তাঁর লেখা থেকে আইডিয়া নিলে ‘সনাতন’ ভারতকে অসম্মান করা হবে না। বঙ্গদেশের নিন্দুক সমালোচকেরা বলেন বটে তিনি পরশুরাম নামে হিন্দুত্ববাদী আর অপবিজ্ঞানীদের মাথায় ব্যঙ্গের কুঠার চালিয়েছিলেন। তা বলুন। আমরা তাঁর লেখা থেকে হাসি আর ব্যঙ্গ মুছে মুছে শুধু আইডিয়াগুলো নেব, দরকারে একটু-আধটু বদলে সনাতন দ্রব্যাদি নির্মাণ করব।

Advertisement

দোকানে ঢুকলেই পাবেন ভক্তদের জন্য ‘দি অটোমেটিক শ্রীহনুমানগ্রাফ’। শ্রমহারক যন্ত্র। স্ট্যাম্পে ১২ লাইন ‘শ্রীহনুমান’ খোদিত থাকবে। কাগজে ৯ বার ছাপ দিলেই ১০৮ বার হনুমান নাম লেখা হয়ে যাবে। চাইলে এই স্ট্যাম্প দিয়ে কেউ সাদা ধুতি বা চাদরেও হনুমান নাম ছাপিয়ে নামাবলি তৈরি করে নিতে পারবেন। পাশেই থাকবে ‘হনুমানের স্বপ্ন চল্লিশা’। সে চল্লিশা পড়লে জানা যাবে, বীর হনুমানকে চিলিম্পা নামের এক বানরী ‘ওরে অবোধ, ওরে বৃদ্ধবালক, তুমি প্রেমের কিছুই জান না’ বলার পর হনুমান কী প্রবল পরাক্রমে চুল ধরে সেই বানরীকে শিক্ষা দিয়েছিল। এটি পড়ে জনতার চিত্তে বীররসের সঞ্চার হবে। তারা ‘জয় হনুমান, জয় জওয়ান’ বলতে বলতে আগামী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবে।

ভক্তদের পাশেই গৃহীদের কাউন্টার। প্রকৃত গৃহী হওয়ার জন্য শৈশবকাল থেকেই ব্রহ্মচর্য-পরায়ণ হতে হয়। ব্রহ্মচর্যের সময় বেশি বিলাসিতা ভাল নয়। ‘তোরা বেদ পড়বি, ধেনু চরাবি, কাঠ কাটবি, বনে-বাদাড়ে ঘুরে হরদম বল্কল ছিঁড়বি। কাঁহা তক জোগাব?’ তাই বেলকাঠের বল্কল। ছিঁড়বে না, সংযমও রক্ষা হবে। প্রকৃত ব্রহ্মচারী যখন বিয়ে করবেন, তখন কন্যা ‘বেনারসি বল্কল’ পরবেন। দোকানে নানা রঙের নানা কায়দার নানা দামের বেনারসি বল্কল ঝোলানো থাকবে।

দোকানের লাগোয়া গবেষণাগার। তার দরজায় একটি অয়েল-পেন্টিং থাকবে। সবুজ তপোবন, আশ্রম-ব্যাঘ্রী ঘাস খাচ্ছে। হরিণশিশু তার স্তন্য পান করছে। এই ছবি যাতে এই ভারতে বাস্তব হয়ে ওঠে, গবেষণাগারে তারই ব্যবস্থা করা হবে। দুটি খাঁচা, পাশাপাশি রাখা। কিছু দূরে পরদা-ঢাকা তৃতীয় একটি খাঁচা। প্রথম খাঁচায় একটি বাঘ, তার নাম রামখেলাওন। দ্বিতীয় খাঁচায় একটি বাঘিনী। তার নাম রামপিয়ারী। এই দুই বাঘকে নিয়ে আসা হবে গয়া জেলার গড়বড়িয়ার জঙ্গল থেকে। গুজরাতের সিংহ হলেও চলবে, কিন্তু পরশুরাম বাঘের কথাই লিেখ গিয়েছেন।

মাংস নয়, গোশ্‌তখোর দুই জানোয়ারকে ঘাস দেওয়া হবে। অরুচি হলে ‘পুরি কচৌড়ি হালুআ লড্ডু’। চাইলে ‘রাবড়ি মালাই পেড়া বরফি’, কিন্তু কিছুতেই মাংস নয়। কথায় বলে, ঠেলার নাম বাবাজি। দীর্ঘ দিন মাংস না পেয়ে শেষে দায়ে পড়ে এই সবই খাবে। পাক্কা নিরামিষাশী বাঘ হয়ে উঠবে। তখন রামখেলাওন ও রামপিয়ারীকে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে পরদা-ঢাকা তৃতীয় খাঁচায়। সেখানে রামখেলাওন রামপিয়ারীকে নরম নিরামিষ চুমু খাবে। এক দিন এই ভাবে রামপিয়ারীর গর্ভে আসবে নিরামিষাশী ব্যাঘ্রশাবক। তখন হরিণেরাও বাঘিনীর দুধ খাবে।

আদিকবি বাল্মীকি উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে দুই মৈথুনরত পাখির বিচ্ছেদ দেখে শোকগাথা লিখেছিলেন। রামায়ণ শোকের মহাকাব্য। পরদা-ঢাকা খাঁচার ভেতরে রামখেলাওন ও রামপিয়ারীর মিলনদৃশ্য দেখতে না পেয়ে আধুনিক কবি ‘বাঘায়ন’ লিখবেন। সেই নিরামিষ ‘বাঘায়ন’-ই হবে জাতীয় মহাকাব্য।

বিপণিটা আর দিন কয়েক পর নববর্ষে খুলে ফেলতেই হবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন