ছবি: সুমিত্র বসাক
১৯৬০-এর মার্চ-এপ্রিল, সবে হাইস্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছি। দেশে মুদ্রার ক্ষেত্রে ‘নয়া পয়সা’ আর দৈর্ঘ্য, ভর পরিমাপের ক্ষেত্রে মেট্রিক পদ্ধতি চালু হল। অর্থাৎ টাকা-আনা-পয়সা আর নয়, শুধু টাকা আর নয়া পয়সা; মণ-সের-পোয়া-ছটাকের বদলে মেট্রিক-টন, কিলোগ্রাম, গ্রাম; মাইল-গজ-ফুট-ইঞ্চির বদলে কিলোমিটার, মিটার, সেন্টিমিটার। নয়া পয়সা চালু হয়েছিল খুব সম্ভবত ’৫৭-র এপ্রিল থেকে, আর পরিমাপের নতুন মাপজোখ ১ অক্টোবর ১৯৫৮ থেকে। কিন্তু দেশের সবার কাছে বিষয়টা পৌঁছতে তিন-চার বছর লেগে গিয়েছিল। শিক্ষকরাও ঠিক ধাতস্থ হয়ে ওঠেননি। নতুনকে জায়গা দিতে সময় তো লাগেই!
খুব তাড়াতাড়িই আমরা পুরনো ৬৪ পয়সার বদলে ১০০ ‘নয়া পয়সা’য় এক টাকা ভাবতে-বলতে শিখে গেলাম। কিন্তু চারপাশের জগতটা কিন্তু পালটাল না। জ্যাঠা-কাকা-মামা, যাঁদের কাছে এত দিন একটা বড় সাইজের ‘কুকিজ’ বিস্কুট বা দুটো মর্টন চকলেট খাবার লোভে ‘দু-আনা’ আবদার করতাম, এখন ‘তেরো নয়া’ চাইতে হিসেব নিয়ে তাঁরা মহা ফাঁপরে পড়তেন। কড়া ধমক দিয়ে বলতেন: ‘নয়া’র অঙ্ক বাড়িয়ে বলে টুপি পরানো হচ্ছে? তাঁদের বুঝিয়ে বলতে হত: আগের ‘চার আনা’র নতুন মূল্য পঁচিশ নয়া, তাই সেই হিসেবে দু’আনা=সাড়ে বারো নয়া। নতুন পদ্ধতিতে সরকার আধা নয়ার কয়েন চালু করেনি, তাই দু’আনা বলতে পুরো তেরো নয়াই মানা হবে। আবার কেউ যদি এক আনার জিনিস কেনে, তবে সোয়া ছয়ের বদলে ছয় নয়া দিলেই চলবে। আমাদের জ্ঞান দেওয়া শুনে গুরুজনরা গম্ভীর গলায় বলতেন: এই সিকিটা নিয়ে ভাষণ বন্ধ কর। যাই কিনিস, দু’আনা ফেরত দিয়ে যাবি কিন্তু। চকচকে সিকিটা হাতে নিয়ে ‘আসছি, দোকানি নতুন নিয়মমাফিক দাম রাখলে পুরো দু’আনা নয়, বারো নয়াই ফেরত পাবে কিন্তু’— বলেই আমরা দৌড়তাম!
বাজারে তখনও পুরনো কয়েনই ছেয়ে। তাই বিস্কুট-চকলেটের বায়না করতে গিয়ে ‘তেরো নয়া’ না চেয়ে সরাসরি ‘দু-আনা’ চাইলেও যে মহাভারত অশুদ্ধ হত, তা নয়। দোকানিও যে সেই পেতল-রঙা দু-আনি’ই ফেরত দেবে, তা-ও জানতাম। তবু আমরা ইচ্ছে করেই কথায় কথায় নতুন কয়েনকে টেনে আনতাম। দুই পদ্ধতির তুলনার জটিল ঘোরপ্যাঁচে পড়া বড়দের অসহায়তা উপভোগ করতে বেশ লাগত যে! স্যরদের কাছ থেকে শেখা সব কথা, উদাহরণ হুবহু ঝেড়ে দিতাম। তাই শুনে বড়দের মাথা ধরে গেলে মাথা টিপে দেওয়ার কাজটাও জুটত আমাদেরই। লাভের মধ্যে দিনপ্রতি বরাদ্দ বিস্কুট-চকলেটের সংখ্যাটা এই মওকায় বাড়িয়ে নেয়া যেত।
পুরনো ‘আর্যা’গুলো— চার পয়সায় এক আনা, ষোলো আনায় এক টাকা, বারো ইঞ্চিতে এক ফুট, তিন ফুটে এক গজ, সতেরো’শো ষাট গজে এক মাইল কিংবা চার ছটাকে এক পোয়া, চার পো’তে এক সের, চল্লিশ সেরে এক মণ— কোনও দিনই আমাদের মনে ধরেনি। হিসেব করতে গিয়ে নানান উদ্ভট, বিক্ষিপ্ত সংখ্যা মনে রাখতে হত, সে ভয়ংকর বিতিকিচ্ছিরি। আর নতুন যারা এল—সেই দশ, একশো, হাজাররা কী সুন্দর ছন্দোময়! নতুন পদ্ধতিটা তাই বন্ধু হয়ে গেল।
লোকের মুখে মুখে তখন কতগুলো আলোচনা খুব ফিরত। ‘সের’ বেশি না ‘কিলোগ্রাম’, ‘মাইল’ বড় না ‘কিলোমিটার’, ‘মণ’-এর ভার বেশি না মেট্রিক-টন’এর, এই সব। মহিলারা সোনার ‘ভরি’র সঙ্গে ‘দশ গ্রাম’ সোনার তুলনা করতেন। চতুর্দিকে এ-সব প্রশ্নের জ্ঞানগর্ভ ও ভুলভাল উত্তরদাতার সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। আমরা, নবযুগের উঠতি ছাত্রদল, তাদের পথ দেখাতাম। ‘বেচারা’ বড়দের শেখাতে পারায় সে কী আত্মতুষ্টি !
স্যররা ক্লাসে সাবধান করে দিতেন: নতুন মেট্রিক পদ্ধতি, দশমিকের অঙ্ক জলদি শিখে নে, নইলে পরীক্ষায় অসুবিধেয় পড়বি। স্কুলছুটির পর বা টিফিন টাইমে ওঁরা অঙ্কের এক্সট্রা ক্লাস নিয়ে আমাদের নতুন পদ্ধতিতে এক একক থেকে অন্য এককে পরিবর্তনের সহজ উপায় শেখাতেন। দশমিকের ফুটকিটাকে কখনও বাঁয়ে কখনও ডানে সরিয়ে চট করে একক পরিবর্তন করে ফেলাটা আমাদের কাছে একটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অ্যাদ্দিন ছিল হযবরল নিয়ম: বারো দিয়ে, সতেরো’শো ষাট দিয়ে গুণ, ষোলো দিয়ে ভাগ। সুযোগ পেয়ে সেই নিয়মের আদ্যশ্রাদ্ধ আমরা রীতিমত হইহই করে করতাম।
এক বার অমূল্য স্যরের ক্লাসে একটা ছেলে ডেসি-সেন্টি-মিলি আর ডেকা-হেক্টো-কিলোগ্রামের মধ্যেকার সম্পর্ক বারবার গুলিয়ে ফেলছিল। স্যর হঠাৎ খুব রেগে গিয়ে জোরে হাঁক পেড়ে ছেলেটাকে কাছে ডাকলেন, ওর পিঠে জোরসে একটা কিল মারলেন। সারা ক্লাস চুপ, স্যর বললেন, ‘ডেকে হেঁকে কিলে, দেশে শান্তি মেলে। কিছু বুঝলি?’ ব্ল্যাকবোর্ডের মাঝখানটায় ‘গ্রাম’ লিখলেন, তার ওপরে ডেকা-হেক্টো-কিলো আর নীচে ডেসি-সেন্টি-মিলি, পর পর। বললেন: উপর-গ্রামে পর পর ‘ডেকে হেঁকে কিল’, মানে ‘ডেকা-হেক্টো-কিলো’ বসাবি, তা হলে নীচে ‘দেশে শান্তি মিলবে’ অর্থাৎ নীচ-গ্রামে পর পর ‘ডেসি-সেন্টি-মিলি’ বসবে। মনে রাখবি, স্টেশনগুলো দশ একক দূরে দূরে। মানে নীচ থেকে শুরু করলে দশ মিলিগ্রামে এক সেন্টিগ্রাম, দশ সেন্টিগ্রামে এক ডেসিগ্রাম। আর ওপর থেকে শুরু করলে দশ ভাগের এক কিলোগ্রামে এক হেক্টোগ্রাম, দশ ভাগের এক হেক্টোগ্রামে এক ডেকাগ্রাম। দেখিস বাবারা, মধ্যিখানে ‘গ্রাম’টাকে ছুঁয়ে যেতে ভুলে যাস না— সে হল মধ্যমণি। উপরে নীচে সবাই তার সঙ্গেই সেঁটে থাকে। ওকে ভুলে গেলে কিন্তু সব মিথ্যে!’
সুভাষ কর, কেষ্টপুর, কলকাতা
subhashkar1951@gmail.com
ষাটের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে? লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 60’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in