‘রান্ঝানা’ ছবিতে ছাত্র আন্দোলন
ছা ত্রদের মধ্যে মিছিলকরা ছাত্রদের যেমন একটা অংশ থাকে, তেমনই আবার নিশ্চিন্তে লেখাপড়া করতে চায় এমন ছাত্রও থাকে। প্রেসিডেনসি কলেজে যা হচ্ছে তার পক্ষে ওই কলেজের অধিকাংশ ছাত্রের সমর্থন আছে কি?’— এটা ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদকীয়-র একটি অংশ। কিন্তু এটা লেখা হয়েছিল প্রায় ৫০ বছর আগে, ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে। তখনও পিকিং রেডিয়ো নকশালবাড়ির আন্দোলনকে ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ বলে কৌলীন্য দেয়নি। এমন অনেক আন্দোলন এই প্রতিষ্ঠানে তত দিনে হয়ে গেছে যেগুলোকে আর যাই হোক শান্তিপূর্ণ বলা চলে না। আবার ঘোর শান্তিবাদীরাও আন্দোলনগুলোকে সারশূন্য, ষোলো আনা কলঙ্ক বলে দাগিয়ে দিতে পারছেন না। তবে সংশয় তৈরি হচ্ছে। ছাত্র ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাপ-বেজি সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে।
১৯৬৮ সালে ‘ফ্রন্টিয়ার’ পত্রিকা এ সব নাশকতাকে বেশ নরম চোখেই দেখত। সেখানেও জ্ঞান কপূর একটা অতি সংগত প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হয়েছেন। স্নাতক স্তরের পার্ট ওয়ান পরীক্ষা স্থগিত রাখার দাবিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ সেনকে ঘেরাও করে ছাত্রদের আস্ফালন দেখে কপূর লিখলেন— ‘আমাকে কেউ হয়তো সিনিক ভাববেন, কিন্তু পরীক্ষা স্থগিত রাখার দাবিটা আমার খুব সুচিন্তিত মনে হচ্ছে না। মাত্র কয়েক দিন সময় পেয়ে কি দারুণ রেজাল্ট করে ফেলা সম্ভব? তা ছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থার প্রতীক’ বলে ছাত্রেরা তা বোম মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ...তা হলে, এত কথা বলার পরেও, সেই প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায় নিজেদের রেজাল্ট নিয়ে যদি ছাত্রেরা এতটা ভাবিত হয়ে পড়েন, তা হলে তো বোঝাই যাচ্ছে তাঁদের বুর্জোয়া ভ্রম ও মোহগুলো সবই অক্ষুণ্ণ আছে!’ (মূল প্রবন্ধ ইংরেজিতে, ‘ক্যালকাটা ডায়েরি’।)
আবার ১৯৭০-এ, দেব আনন্দ পরিচালিত ‘প্রেম পূজারী’ সিনেমা দেখতে গিয়ে শচীনকত্তার ‘ফুলো কি রং সে’ আর ‘রঙ্গিলা রে’ সুরের আঠায় দর্শক যখন নিজেদের পুরোপুরি সারেন্ডার করেছে, সিনেমা হল-এ হামলা, ভাঙচুর! কেউ ভাবেওনি, সিনেমায় চিনের সেনাবাহিনীকে দুষ্টু লোক হিসেবে দেখালে কলকাতায় কারও গোসা হতে পারে! কিন্তু ভারতকে ধামসে দেওয়া চিন সেনার ‘অবমাননাকর উপস্থাপনা’য় কলকাতার ছাঁকা ছাঁকা ছাত্রদের তত ক্ষণে ভয়ানক রাগ হয়ে গেছে। সাত-সাতটা সিনেমা হল বিপ্লবী ক্ষোভে চুরমার। এর কিছু দিন পর এই ‘বিপ্লব’-এর মাত্রা আরও বাড়ল। খুন হয়ে গেলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোপাল সেন।
গোটা ছাত্রসমাজ একধার থেকে ভারী শান্ত-সুবোধ হয়ে গেলেই থরে থরে সুফল ফলবে— এ দাবি কেউই করেন না। কিন্তু এই ধরনের ছাত্র-আন্দোলনের জঙ্গিপনা আর ঔদ্ধত্যের দিকে তাকিয়ে কিছু ঠোক্কর খেতেই হয়। আন্দোলন মানে কি সব নীতির বাইরে চলে যাওয়ার লাইসেন্স আদায়? উত্তাল সত্তরে নকশাল হয়ে যাওয়া সমাজকর্মী, গবেষক ও অধ্যাপক দিলীপ সিমিয়ন তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘রেভোলিউশন হাইওয়ে’-তে এই প্রশ্নগুলোর সামনেই দাঁড়িয়েছেন। উপন্যাসটির চরিত্র রথীন নিজে নকশাল না হলেও ওই সময়ের আগুনে-তর্কের আসরগুলো এড়িয়ে যেতে পারে না। এক কালে জেসুইট মিশন স্কুলের ছাত্র রথীন অবশ্য আগুনখোর নেতাদের পাশাপাশি অন্যান্য মেধাবী মানুষেরও গুণমুগ্ধ। তেমনই এক জন অধ্যাপকের ঘরে গেলেই দেখা যায় বইপত্রের স্তূপ। তা থেকে মাথা তুলে চেতাবনি দেয় কবি পল ভ্যালেরি’র পঙ্ক্তি— কোনও মতকে নাকচ করতে চাইলে, প্রথমে সেই মতের যে সেরা সমর্থক, তার চেয়ে অনেক ভাল করে মতটাকে বুঝে নাও।
হয়তো সেই বোঝাবুঝিতে অনেকটা ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। তাই ১৯৮১-তে রামমোহন কলেজের অধ্যক্ষ সাধনা সরকার অসুস্থ হয়ে পড়বেন ছাত্রীদের ঘেরাওয়ে। বহু অনুনয়েও মুক্তি মিলবে না। তবে কিছু ক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালে পৌঁছে চিরতরে মুক্তি পাবেন তিনি। মৃত্যুর মুক্তি।
রোগ শুধু এ দেশের নয়। ১৯০২ সাল। গুটিবসন্ত তখনও সাংঘাতিক মারণ রোগ। নেভাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাগোয়া রেনো শহরে হঠাৎ গুটিবসন্তের প্রকোপ শুরু হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির প্রধান, তড়িঘড়ি ক্যাম্পাসে কোয়ারান্টাইনের নোটিস জারি করলেন। ক্যাম্পাসের ভিতরে হোস্টেলে যারা থাকত, সেই সব ছাত্রদের বাইরে যাওয়া-আসার ওপর কড়া নিয়মকানুন বসল। না মানলেই দু’ডলার করে জরিমানা। শোনামাত্র ছাত্ররা অগ্নিশর্মা। ক’বছর আগেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই ‘দ্য স্টুডেন্ট রেকর্ড’ নামে একটা পত্রিকা চালু করেছিল। তার ‘মোটো’ ছিল: স্বাধীন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্তে এনে, প্রায় সমস্ত বিধিনিষেধের প্রতিবাদের অধিকার আদায় করা। কোয়ারান্টাইনের নোটিস দেখেই পত্রিকার সম্পাদকের মনে হল, এটা কর্তৃপক্ষের অত্যন্ত অন্যায্য এক দমননীতি। ছাত্ররা ঠিক করল, নিষেধ না মেনে, তারা শহরে বেরিয়ে মিছিল করবে। আমজনতা প্রমাদ গুনল। সংক্রমণ ছড়ানোর ভয়ে তারাও গেল খেপে। উগ্র ছাত্র আন্দোলন আস্তে আস্তে বাকি নাগরিকদের সহানুভূতি হারাল। শেষে, জনমতের প্রচণ্ড চাপে কর্তৃপক্ষ ওই সম্পাদককে বহিষ্কার করতে বাধ্য হলেন। প্রচুর ছাত্র সাসপেন্ডও হল। কুখ্যাত ঘটনার নাম হল ‘কোয়ারান্টাইন রেবেলিয়ন’।
১৯৬৭-র জুন। ইরানের শাহ’র জার্মানি সফরের প্রতিবাদে এক ছাত্র-জমায়েত হিংস্র হয়ে উঠলে পুলিশ গুলি চালায় এবং এক থিয়োলজি ছাত্র মারা যায়। এর পরেই ঘটনাটা পুরোপুরি প্রশাসনের হাতের বাইরে চলে গেল। জার্মানির ছোট-বড় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ শুরু। প্রবল দক্ষিণপন্থী অ্যাক্সেল স্প্রিংগার পরিচালিত সংবাদমাধ্যমগুলো ছাত্রদের ওপর মাত্রাছাড়া বিষ উগরে দেওয়ায়, পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হল। গণমাধ্যমগুলোতে ছাত্রবিরোধী লেখা পড়ে মানসিক ভারসাম্যহীন এক তরুণ, জার্মানির সোশালিস্ট ছাত্রদল (এস.ডি.এস)-এর নেতার ওপর প্রাণঘাতী হামলা চালিয়ে বসল। ছাত্ররা ঘোষণা করল— এ বার থেকে হিংসার বদলে হিংসা। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের একটা অংশ সরাসরি সন্ত্রাসের পথ বেছে নিল। জার্মানির মেধাবী ছাত্রী গুডরুন এনস্লিন এবং কলেজ-ছুট ছাত্র আন্দ্রিয়াস বাডারের নেতৃত্বে তৈরি হল রেড আর্মি ফ্যাকশন (RAF)। কিছু দিন পর বিখ্যাত সাংবাদিক উলরিখে মাইনহফ এই দলে যোগ দিলেন। সেই থেকে এই দল ‘বাডার-মাইনহফ গ্যাং’ নামে কুখ্যাত হয়ে উঠল। জার্মানির সেরা ছাত্রছাত্রীরা এই বাহিনীর উগ্র ভাবনাচিন্তায় ভীষণ আকৃষ্ট হয়। তাদের ঘোষিত নীতি ছিল— তর্কবিতর্ক নয়, ধ্বংস। এর পর বেশ কয়েক বছর ধরে এদের নাশকতা দমন করাই জার্মান পুলিশের প্রধান কাজ হয়ে গিয়েছিল। আরও কিছু দিন পর এই বাহিনী প্যালেস্টাইন সন্ত্রাসবাদীদের মদতে ফ্রিলান্স বিপ্লবী বনে যায়। তখন ইহুদি যাত্রীতে বোঝাই একটা ফরাসি প্লেন হাইজ্যাকও করে। এখনও পর্যন্ত এটাই ছাত্র-সন্ত্রাসের ল্যান্ডমার্ক।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন কম্বোডিয়ায় হামলা করার পর কেন্ট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ শুরু করে। তাদের ওপর গুলি চালায় ওহায়ো ন্যাশনাল গার্ড। ১৯৭০-এর ৪ মে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় চার জনের। জখম প্রায় দশ। জনমত আছড়ে পড়ে আমেরিকার পথেঘাটে। বছরের পর বছর মামলা চলে। ছাত্রছাত্রীরা, না বন্দুকবাজ ন্যাশনাল গার্ড— কে বেশি হিংস্র? কে কতটা দায়ী? বলা শক্ত। কত সরকারি নথি হিমঘরে চলে গেছে! অনেক প্রত্যক্ষদর্শী নতুন করে মুখ খুলছেন। হয়তো এ সব বিতর্কের নির্দিষ্ট উত্তর খুঁজতে যাওয়াটাই বোকামি!
barun.chattopadhyay@gmail.com