ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন

এই দুনিয়ায় প্রেমিক-প্রেমিকার চিঠি চালাচালি যুগে যুগে। কখনও চার হাজার বছর আগের ব্যাবিলনে, কখনও বা দ্বাপর যুগের ভারতে। শিশির রায়হৃ দয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে কেউ ভাল না বাসলেও, সভ্যতা খুঁড়ে প্রাচীন প্রেমপত্র খুঁজে বের করাই যায়। প্রত্নতত্ত্বের পাথুরে প্রমাণ, পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রেমপত্রটি নাকি অম্তত ৪০০০ বছরের পুরনো।চিঠি মানে, এক খণ্ড পাথুরে মাটি। পাওয়া গিয়েছে ক্যালডিয়া-য়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share:

হৃ দয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে কেউ ভাল না বাসলেও, সভ্যতা খুঁড়ে প্রাচীন প্রেমপত্র খুঁজে বের করাই যায়। প্রত্নতত্ত্বের পাথুরে প্রমাণ, পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রেমপত্রটি নাকি অম্তত ৪০০০ বছরের পুরনো।

Advertisement

চিঠি মানে, এক খণ্ড পাথুরে মাটি। পাওয়া গিয়েছে ক্যালডিয়া-য়। ইতিহাস বইয়ে পড়া মেসোপটেমিয়ার এক কোণের একটা এলাকাই ক্যালডিয়া, যেখানে একটা রমরমা সভ্যতা ছিল, লোকে কথা বলত হিব্রু, আরবি, যিশুর ভাষা অ্যারামাইক সহ নানান ভাষায়। সেইখানেই, সম্ভবত ২২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, ব্যাবিলনের এক ছেলে চিঠি লিখছে ইউফ্রেটিস-তীরের শহর সিপারা-য় থাকা এক মেয়েকে। ‘ও আমার কাসবুয়া (ছোট্ট ভেড়ার ছানা), এই চিঠি লিখছি আমি, মারদুক (ব্যাবিলনের অধিষ্ঠাতা দেবতা)-এর ভক্ত। তোমার শরীর কেমন আছে, যদি জানতে পারতাম! থাকি ব্যাবিলনে, তোমাকে দেখিনি কোনও দিন, আর তাই খুব চিন্তায় আছি। তুমি কবে আমার কাছে আসছ? অনেক দিন বেঁচে থাকো, অন্তত আমার জন্য।’

প্যাপিরাস কি মাটির টুকরোয় লেখা এ রকম চিঠিপত্র সে কালের দিওয়ানাদের মধ্যেও চালাচালি হত। ব্যাবিলনের তৎকালীন আইনে বিয়ে ব্যাপারটা ছিল আসলে দুই পরিবারের দেওয়া-থোওয়ার গাঁটছড়া। পাত্রপক্ষকে ‘বরপণ’ দিতে হত কনের পরিবারকে, আর পাত্রীর বাবা জোগাতেন মেয়ের সাজপোশাক-গয়নাগাঁটি মায় জমি-বাড়ি সম্পত্তি। তবু, এই প্রেমপত্র সাক্ষী, না-দেখা মেয়েটির জন্যে প্রেমিক-পরান কেমন পুড়ছে। পাথুরে মাটিতে লেখা দেখেই হদিশ মিলল, বিরহী যক্ষের মতো মেঘদূতকে দিয়ে চিঠি পাঠালেই হয়েছিল আর কী!

Advertisement

ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে, আর অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির দুটো কলেজে রাখা আছে ‘প্যাস্টন লেটার্স’। পঞ্চদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে, নরফোক কাউন্টির সম্ভ্রান্ত প্যাস্টন পরিবারের কয়েক পুরুষের চিঠিপত্রের সংগ্রহ। ওই চিঠির গাদাতেই রয়েছে ১৪৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেখা একটা চিঠি। প্যাস্টনবাড়ির ছেলে, জন প্যাস্টনকে লিখছে তার প্রেমিকা মার্গারি ব্রিউস। চিঠির সম্বোধন ‘মাই রাইট ওয়েল-বিলাভেড ভ্যালেন্টাইন’। মার্গারির বক্তব্য, তার শরীর-মন কোনওটাই ভাল নেই। থাকবেও না, যত ক্ষণ না জন-এর ফিরতি-চিঠি আসছে। মেয়েটি লিখছে, ‘আমার বিশ্বাস তুমি আমাকে ভালবাস— জানি তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না...’ জন প্যাস্টন আর মার্গারি ব্রিউস-এর বিয়েটা পরে হয়েছিল ঠিকই। সে বিয়ে কেউ মনে রাখেনি, কিন্তু ইতিহাসে থেকে গিয়েছে মার্গারির এই চিঠিটা। ইংরিজি ভাষায় লেখা সেটাই প্রথম ভ্যালেন্টাইন লেটার কিনা!

ভ্যালেন্টাইন, প্রেম আর বসন্তের মায়াময় সময়ের কথা সবার আগে লিখে গিয়েছেন ইংরেজ কবি জিওফ্রি চসার। চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে লেখা তাঁর দীর্ঘ কবিতা ‘পার্লামেন্ট অব ফাউলস’-এ আছে, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’তে, নরম বসন্তদিনে পাখিরা তুমুল পাখসাটে খুঁজে নিচ্ছে নীড়বন্ধুকে। শেক্‌সপিয়রের ‘হ্যামলেট’-এ আবার অন্য মাত্রা। প্রেমিকের হাতে বাবা পোলোনিয়াস খুন হওয়ার পর, পাগলিনিপ্রায় ওফেলিয়া গুনগুনিয়ে ওঠে, ‘টুমরো ইজ সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে,/ অল ইন দ্য মর্নিং বিটাইম,/ অ্যান্ড আই আ মেড অ্যাট ইয়োর উইন্ডো,/ টু বি ইয়োর ভ্যালেন্টাইন...’

ভ্যালেন্টাইন লেটার লেখায় শুধু সাগরপারের একচেটিয়া অধিকার, কে বলে! আমাদের শাস্ত্রেও জ্বলজ্বল করছে! বিদর্ভের রাজা ভীষ্মকের পাঁচ ছেলে এক মেয়ে। রাজকন্যা রুক্মিণীর বিয়ের বয়স হয়েছে। রুক্মিণীর বড়দা রুক্মী চান, চেদিরাজ শিশুপালের সঙ্গে বোনের বিয়ে দিতে। এ দিকে বোনটি মনে মনে বরমাল্য সঁপেছেন দ্বারকারাজ শ্রীকৃষ্ণকে। কোনও দিন তাঁকে দেখেননি, কৃষ্ণকথা শুধু শুনেছেন কানে, তাতে কী। বিয়ের আগের দিন, মরিয়া রুক্মিণী একটা চিঠি লিখে সুনন্দ নামে এক দূতের হাত দিয়ে পাঠালেন শ্রীকৃষ্ণের কাছে। ‘লজ্জা না করেই বলছি, আমার মন তোমাকেই দিয়েছি, হে অচ্যুত! হে মুকুন্দ, কোন বয়স্থা মেয়েই বা তোমার মতো পুরুষসিংহকে স্বামী হিসেবে পেতে চাইবে না? এই আমি নিজেকে সমর্পণ করলাম, তুমি আমায় গ্রহণ করো।’ এখানেই শেষ নয়। রুক্মিণী আরও লিখে দিলেন, ঠিক কী ভাবে কৃষ্ণ প্রাসাদে ঢুকে রুক্মিণীর কাছে পৌঁছবেন, কাউকে হত্যা না করেই, বিনা বাধায় কী ভাবে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাবেন। পত্রপাঠ শ্রীকৃষ্ণ বিদর্ভে এলেন, ভাইয়ের ঢাল হিসেবে বলরামও। নিশ্ছিদ্র প্ল্যানমাফিক, শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণীকে অপহরণ করে দ্বারকায় নিয়ে এলেন। যথাসময়ে সম্পন্ন হল বিয়েও।

সবই সম্ভব হয়েছিল রুক্মিণীর লেখা ওই প্রেমপত্রটির দৌলতেই! অতএব আগামী পরশু যদি কেউ ‘এই এক হয়েছে ওয়েস্টার্ন পা-চাটা হুজুগে প্রেমদিবস’ বলে শোর মচানো শুরু করে, তাদের সামনে শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের ৫২ অধ্যায়ে রুক্মিণীর প্রেমপত্রখানি মেলে ধরুন। এক্কেবারে মেক ইন ইন্ডিয়া!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন