আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: ইন্দিরা গাঁধী

শুধু সঞ্জয়ের নয়, দেশের মাম্মি

আমি পার্টি, পাবলিক— সব্বাইকে হাড়ে-হাড়ে বুঝিয়ে ছেড়েছিলাম ‘ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা, ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’! মকবুল ফিদা হুসেন আমাকে ভারতমাতা বানিয়ে ছবি এঁকেছিলেন! কিন্তু ক্ষমতার আড়েবহরে আমি ওই মাতাজির চেয়েও একটু বড়ই ছিলাম। আমি শুধু সঞ্জয়ের নয়, গোটা দেশের ‘মাম্মি’ ছিলাম।

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৪২
Share:

ইন্দিরা গাঁধী, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে, শ্রদ্ধায় ও রোমাঞ্চে নড়ে যাওয়ায়, ছবিটা কেঁপে গেছে।

প্রতিবেদক: আপনার বউমার ‘সাহসী’ ইনিংসের দৌলতে বছরের শেষটায় তবু যা হোক শাশুড়ির বাজারটা একটু ‘হাই’ হল! নইলে, গোটা ২০১৫-য় আপনার বক্স-অফিসের যা হাল ছিল! সানি দেওলের চেয়েও খারাপ!

Advertisement

ইন্দিরা গাঁধী: নতুন রিপোর্টারি করছিস নাকি? শোন, নেহরু-গাঁধীর বাড়ির ইউএসপি-র কোনও কালে মার নেই রে। বরং অফিসে একটু-আধটু উঁচু-নিচু হতে পারে, সে তোদের বড় বড় স্টারেদের হয় না? এই যে অমিত, ওর মাম্মি আমার সই ছিল— বাচ্চাদের ইস্কুলে দিতে গিয়ে অনেক গপ্প হত— তা ওর কী হাল হয়েছিল বল! দেনার দায়ে বাংলো-ফাংলো অবধি বেচে দেওয়ার জোগাড়! আর এখন! বলিউডের ‘পাওয়ার লিস্ট’-এ তিন-চার নম্বরে হামেশাই নাম থাকে। আসলে সিনেমাই বল বা রাজনীতি, দু-চারটে ফ্লপ শো-এর মুখ না দেখলে সুপার বা মেগাহিট দিবি কী করে?

Advertisement

প্রতি: তা হলে বলছেন, আপনার বউমার ন্যাশনাল হেরাল্ড শো’টা হিট!

ইন্দিরা: না, তেমন আর কই! ওই অ্যাভারেজ-এর চেয়ে একটু ভাল বলতে পারিস। আরে ফর্মুলা তো সেই পুরনো গাঁধীগিরি! ’৭৭-এ আমি সেটাকেই বলিউড-ঘেঁষা একটা প্যাকেজিং দিয়েছিলাম। হাই ভোল্টেজ মেলোড্রামা, তার ওপর তুখড় ডায়লগবাজি! পুরো সেলিম-জাভেদের স্ক্রিপ্ট! সিচুয়েশনটা ভাব এক বার। সনিয়া-বউমা সবে আমার জন্য বিকেলের চা-টা করে এনেছে, তক্ষুনি সিবিআই-এর এসপি-টা দলবল নিয়ে আমায় ধরতে হাজির! সোজা লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে ডায়লগটা ঝাড়লাম— আমায় অ্যারেস্ট করতে হলে হাতকড়া পরাতে হবে। পুরোটাই নাটক, বুঝতেই পারছিস! ‘এক্স’ পিএম-এর দাবড়ানি খেয়ে এমনিতেই অফিসারটার কনফিডেন্সের শিরদাঁড়া তো কবেই গলে মাখন! ও আমায় হাতকড়া পরাবে কী, উপায় থাকলে ওয়ারেন্টটা তখনই পকেটে পুরে হামাগুড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরত। ও দিকে আমার কেল্লাও ফতে। ভরা মিডিয়ার সামনে আমার আক্রান্ত, নিপীড়িত শহিদ-ইমেজের মুখে হাজার ওয়াটের ফোকাস, আর মোরারজি সরকারের মুখে কালি! জেলে গেলাম আমি আর ভরপেট গালাগাল খেল জনতা পার্টি। ‘হার কর্ জিতনেওয়ালে কো বাজিগর কহ্‌তে হ্যায়!’— এটা তোদের শাহরুখের ডায়ালগ না? কেমন লাগসই ঝেড়ে দিলাম বল!

প্রতি: তা হলে বউমা এখনও শাশুড়ির ম্যাজিকটা পুরো রপ্ত করতে পারেননি?

ইন্দিরা: ধুর্‌, এখনও হিন্দিটাই রপ্ত করতে পারল না তো ম্যাজিক! ও রকম ঢোক গিলে, কুঁতিয়ে, হোঁচট খেয়ে ডায়লগ বললে কি আর রাজনৈতিক ড্রামাবাজি করা যায়? তুমি মাঝরাস্তায় ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে শব্দ খুঁজবে আর ও দিকে তোমার যাবতীয় জোশ-এর হাওয়া বেরিয়ে ফুস হয়ে যাবে!

প্রতি: সে যা-ই বলুন, আপনার বউমাটি কিন্তু ভারি লক্ষ্মীমতী। যেন একতা কপূরের মেগা সোপ— ‘মেরি সাস্‌ মহান’, কিংবা ‘সাসুমা তুসি গ্রেট হো’! এমন শাশুড়ি-ব্রতা বধূমাতা আজকাল পাবেন কোথায়?

ইন্দিরা: আরে শাশুড়ির ব্র্যান্ড-ভ্যালুটাও দ্যাখ! তা নইলে এমনি কি আর পুঁছত? হ্যাঁ, বলতে নেই, আমার এই বউমা তবু কিছুটা মান্যিগন্যি করে। ওই যে আর এক জন, যার নাম মুখে আনি না, তার মতো নয়। তাও দশ বছরের ইউপিএ জমানায় আমি কী পেয়েছি বল তো! ওই দু-আড়াইটে যোজনা, স্কুলছুটদের জন্য একটা মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়! ব্যস, ফুরিয়ে গেল।

প্রতি: কী বলছেন! এই ভারতের গলি থেকে রাজপথ, পাঠশালা থেকে মহাকাশ গবেষণা, পরিবেশ দূষণ থেকে গরিবি হটাও— সব জায়গায় নেহরু-গাঁধীদের ছোঁয়া! তাও বলছেন আপনাকে পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না?

ইন্দিরা: আরে ও-সব তো কাগুজে কেতা, লোক-দেখানো। ওতে পেটও ভরে না, মাঝখান থেকে বদনাম হয় বেশি। মোদী-ব্রিগেড গলা ফাটিয়ে চেঁচায়— গেল গেল। প্রচারের পুরো ক্ষীরটুকু গাঁধী-নেহরুরা চেটেপুটে খেয়ে গেল! আরে খাওয়ার আছেটা কী বল তো? এ দিকে আমার বউমা আর নাতিবাবুটির আমলে কংগ্রেসের যা হাল হয়েছে, এ সব ভুলভাল কথার উত্তরে জোরে কিছু বলতেও পারে না! মাঝখান থেকে ৩১ অক্টোবরের মতন তপতপে রক্তে রাঙানো ইভেন্টটাও মোদী সরকার হাইজ্যাক করে নিল! আমার মৃত্যুদিনের ওপর কোত্থেকে সর্দার পটেলের জন্মদিন চাপিয়ে দিনটার স্টেটাসই পালটে দিল। আগেকার কালে এ দিনটায় সকাল থেকে দিকে দিকে রক্তদান শিবির, মোড়ে মোড়ে আমার সব স্ট্যাচুর গলায় গাঁদা ফুলের মালা, মাইকে মাইকে ঘ্যাসঘেসে পুরনো ক্যাসেটে ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কি লোগোঁ’, কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ। আর এখন দ্যাখ সব ফক্কা! আমার পার্টি অবধি একটা বিজ্ঞাপন দেয় না! অথচ তোরা ছোটবেলা থেকে কী দেখে এসেছিস বল‌— ২ অক্টোবর জাতির জনক বাপু, ১৪ নভেম্বর আমার জনক চাচা নেহরু আর ১৯ নভেম্বর আমি— ভারতবাসীর জন্য এই তো ক’টা জন্মদিন! তোদের বাঙালিদের জন্য না-হয় নেতাজিটা ফাউ! কিন্তু এর মধ্যে সর্দার পটেল কোত্থেকে আসে! সব আরএসএস-এর চক্রান্ত!

প্রতি: এই দেখুন আপনার মুখোশের মুখ বেরিয়ে আসছে! এই ভাবেই তো আপনারা ৬৮ বছর ধরে দেশের ওপর, পার্টির ওপর পরিবারতন্ত্র চাপিয়ে রেখেছেন! কংগ্রেসের হাইকম্যান্ড মানেই আপনাদের কম্যান্ড! আর তাতে কান না পাতলেই পার্টি-পদ থেকে ঘ্যাঁচাৎ, নয়তো রাষ্ট্রপতি ভবনে পেনশন-জীবন! এই খেলাটা বউমাও কিন্তু আপনার চেয়ে খারাপ খেলেন না, বলুন?

ইন্দিরা: আরে যাঃ! তুলনাটা একটু বুঝেসুঝে কর! আমার মাঠটা ছিল অনেক বড়! পরিবারতন্ত্র বললে ওটাকে কেমন ‘হম দো, হমারে দো’ গোছের খেলো শোনায়। আমি পার্টি, পাবলিক— সব্বাইকে হাড়ে-হাড়ে বুঝিয়ে ছেড়েছিলাম ‘ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা, ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’! মকবুল ফিদা হুসেন আমাকে ভারতমাতা বানিয়ে ছবি এঁকেছিলেন! কিন্তু ক্ষমতার আড়েবহরে আমি ওই মাতাজির চেয়েও একটু বড়ই ছিলাম। আমি শুধু সঞ্জয়ের নয়, গোটা দেশের ‘মাম্মি’ ছিলাম। সঞ্জয় নেহাত আমার বাড়িতেই থাকত, তাই হয়তো ক্ষমতার মাছের মুড়োটা, দুধের সরটা একটু বেশি জুটেছে। কিন্তু তাই বলে আমায় একচোখো বলতে পারবি না। আমি ঘোর বুদ্ধিজীবী থেকে পেঁচোর মা— সব্বাইকে বোঝাতে পেরেছিলাম, গাঁধী পরিবারটাই দেশ— তাই গাঁধীদের বিপদ মানে দেশের বিপদ! লোকে সেটা খেয়েওছিল। এই যে লোকসভায় ৪৪টা সিট পেয়েও মা-ছেলে এখনও পার্টির চুড়োয় বসে আছে, সেটা ওটারই ‘ডিভিডেন্ড’ রে! আমার বউমা, আমার নাতি বলেই এখনও খাতির! পরিবারতন্ত্র নয়, আমি ভারতকে সেই আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। পিতৃতান্ত্রিক হিন্দুত্ববাদীদের সেটা সইছে না বলেই ওরা নেহরু-গাঁধী নিয়ে অত হল্লা করছে! একটা মাত্র পরিবারকে সবক্ শেখাতে হিন্দু-পুরুষদের গোটা সঙ্ঘ পরিবারকে ঝাঁপাতে হচ্ছে! এখানে জিতটা কার হল? আমাদের, মানে আমারই তো!

sanajkol@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement