রোহিত, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত বিস্ময়ে, আবেগে, মায়ায় নড়ে যাওয়ায়, ছবিটা কেঁপে গেছে।
প্রতিবেদক: এখন আপনাকে নিয়ে খুব হইচই হচ্ছে, আপনি দলিত আন্দোলনের আইকন, কিন্তু আপনিই তো থাকলেন না। তা হলে কী লাভ হল?
রোহিত: কী লাভ হল মানে? আন্দোলনটার লাভ হল। প্রশ্নটার লাভ হল। আপনি তো প্রথমেই ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেলেছেন। আমি আত্মহত্যা করলাম বলেই তো, আমি না-থাকতে বাধ্য হলাম বলেই তো এতটা নাড়াচাড়া পড়ল। আমি থাকলে তো হত না। কখনও কখনও একটা লোকের বেঁচে থাকার চেয়ে, একটা আইডিয়ার বেঁচে থাকার প্রয়োজন বেশি।
প্রতি: কথাটা শুনতে খুব ভাল, কিন্তু একটা আন্দোলনের পক্ষে কোনটা বেশি জরুরি, একটা দড়াম বিস্ফোরণ, না কি একটা স্টেডি লাগাতার কর্মস্রোত? ধরুন আপনি যদি সত্তর বছর বেঁচে থাকতেন, তা হলে অনেকগুলো প্রতিবাদ, মিছিল, স্লোগানে অংশ নিয়ে কি আন্দোলনটাকে বেশি এগিয়ে নিতেন না?
রোহিত: হাহাহা, কচ্ছপ আপনার চেয়ে অনেক বেশি দিন বেঁচে থাকবে। তার মানে কি তার জীবন আপনার চেয়ে অনেক বেশি সার্থক? বেঁচে থাকা আর টিকে থাকার মধ্যে কিছু তফাত আছে মশায়। অনেক দিন বাঁচলেই আমি ঠিকঠাক বেঁচে থাকতাম? হয়তো অনেক বেশি অপমান সইতে হত, অনেক বেশি প্রত্যাখ্যান। হয়তো বিমর্ষ বা সিনিক হয়ে বাঁচতাম। তার চেয়ে মাথা উঁচু করে দাপিয়ে এই যে এখন বাঁচছি, তা অনেক মূল্যবান নয় কি? মৃত্যুর পর বেঁচে থাকার চেয়ে বড় বেঁচে থাকা হয়?
প্রতি: কিন্তু সত্যিই কি এই তথাকথিত মহান বেঁচে থাকার চেয়ে একটা রক্তমাংসের বেঁচে থাকা অনেক জরুরি ও আশ্চর্য নয়? যেখানে আপনি সত্যি জিভে সত্যি পাঁউরুটির স্বাদটা বুঝতে পারবেন...
রোহিত: পাঁউরুটির সঙ্গে চাবুকের স্বাদটা মিশে সেটাকে ডেলি তেতো করে দিচ্ছিল বলেই তো স্টেপটা নেওয়া। রক্তমাংসের থ্যাঁতলানিটা আর নিতে পারছিলাম না!
প্রতি: তা হলে এমন ভাব দেখাচ্ছেন কেন, এটা একটা প্রোটেস্ট! এটা তো একটা হেরে যাওয়া!
রোহিত: এমন একটা হেরে যাওয়া, যা থেকে অনেকের জিত-এর শুরু। আপনি সাড়ে-সাইকায়াট্রিস্টের মতো, আমার আত্মহত্যার ইনটেনশনটাকে অত খোঁচাবেন না। আত্মহত্যার এফেক্ট-টা দেখুন। আর আপনার কি ধারণা, আমি চিঠিটা লেখার সময়ে আশা করিনি, এটা থেকে একটা দাউদাউ দাবানল ঘটুক? রাগ করে যখন আপনি ভাত ফেলে দিয়ে খালিপেটে থেকে নিজেকে কষ্ট দেন, সেটা কি একটা প্রোটেস্ট নয়?
প্রতি: কিন্তু ক’দিনের? এখন আপনি ছবিতে খুব মালা পাচ্ছেন বটে, কিন্তু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এসে গেলেই তো আপনি মুছে যাবেন।
রোহিত: এ কথাটা অনেকটা সে রকম হল: শেষ অবধি যখন মারাই যাবে, তখন আর সন্তানকে পৃথিবীতে আনব কেন? শুধু মিডিয়ায় রিপোর্টের কনটেন্ট দিয়েই কি আর মানুষের মনের ম্যাপ মেপে ফেলা যায়? কিছু মানুষ নিশ্চয় থাকবেন, আজ থেকে দশ বছর পরেও যাঁদের আমার কথা হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়বে হট করে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে দলিতদের বিপক্ষে নৃশংস সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভবিষ্যতের ভিসি-রাও অনেক বার ভাববেন। যে লেখাগুলো এখন লেখা হচ্ছে, তারাও কিছু দিন থাকবে, নতুন দাপুটে ভাবনাও প্রসব করবে। আর, যদি দেখা যায়, দলিতদের কথা বলতে গেলে, অত্যাচারিতের দাবি জিইয়ে রাখতে গেলে, পাবলিকের মনোযোগের ফোকাস-বৃত্তে জ্যান্তে-মরা’দের রাখতে গেলে, ইকুয়াল ইন্টারভ্যালে একটা লোকের আত্মহত্যা করার দরকার হচ্ছে, তা হলে তা করা হবে! আমি মুছে যাব, নতুন আত্মহত্যাকারী আমার হাত থেকে ব্যাটন নিয়ে নেবে। সুইসাইড বম্বার হতে পারে, সুইসাইড চেতনা-বম্বার হতে পারে না?
প্রতি: এই তো ফের নিজেকে সচেতন প্রতিবাদী বলছেন। কিন্তু চিঠিতে তো উলটো লিখেছেন! কেউ আপনার মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়, এই নিয়ে যেন আপনার বন্ধু বা শত্রুদের ঝঞ্ঝাটে না ফেলা হয়।
রোহিত: লিখেছি, কিন্তু এগুলো যে ফর্মালিটি, তাও লিখেছি। এবং যোগ করেছি পুনশ্চ-র ধরনে। তা ছাড়া আমি চেয়েছিলাম, চিঠিটা একেবারে প্রখর পার্টিজান না হয়ে, একটু ক্ষমা আর দরদে ভরা থাক। অনেকটা অশ্রু থাক, অনেকটা থুতুর বদলে।
প্রতি: কিন্তু প্রতিবাদ জোরালো করতে গেলে তো কাব্য নিয়ে ব্যস্ত হলে চলবে না, বরং তা কিছু কর্কশ হওয়াই ভাল।
রোহিত: এই ধারণাটার মধ্যে মাঝারিপনা ম-ম করছে। একগুঁয়ে একঝোঁকা একবগ্গা প্রতিবাদ বেশ বোদা, আর অনেকটা দিনকানা। ওই ধর্মের লেখাজোখা থেকেও বুদ্ধির দীপ্তি আর হৃদয়ের সজলতাটা চলে যায়। বিপ্লব-রেডি হতে গেলে, লেখাকে খারাপ বা ফ্ল্যাট হতে হবে? আপনি একটা সোজা কথা বলুন তো, চিঠিটা পড়তে কেমন লেগেছে?
প্রতি: চমৎকার। আপনার লেখার হাত ছিল। যে ভাবে ‘শ্যাডোজ টু দ্য স্টারস’ লিখেছেন, বা ওইখানটা: আমাদের অনুভূতিগুলো সেকেন্ড-হ্যান্ড, বিশ্বাসগুলো রং-করা।
রোহিত: এও বলেছি, মানুষ আসলে নক্ষত্রের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি। একটা লেখাকে গাঁকগাঁক চিল্লাতে হবে, তবেই তা প্রতিবাদী হবে, মানে নেই। বরং ঠিকঠাক একাচোরা কান্নায় পাহাড় টলে যায়। আর, এটাই তো আমার সবেধন লেখা। তাই ঝিলমিলগুলো একটু ডিসপ্লে দিয়েছি। মনে হয় না, যাওয়ার বেলায়, আমার গুঁড়োগুলো একটু দিয়ে যাই?
প্রতি: সেটা করতে গিয়ে পেল্লায় বেগড়বাঁইও করেছেন। অনেকে বলছে, আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। নিজেই নিজেকে মনস্টার বলছেন।
রোহিত: ডিপ্রেশন কি নিজস্ব লিভার থেকে গজায়? ব্যক্তির বিষাদে কি সমাজের দায় থাকে না? যখন একটা লোক, যে কোনও লোক, নিজেকে মেরে ফেলার আগে লেখে, কেউ দায়ী নয়, কতটা অভিমান নিয়ে তা লেখে! কারণ সে তো আর এক দিনে এক মুহূর্তে আত্মহত্যা করছে না, কোটি কোটি বেদনামুহূূর্তের দহন সহ্য না করতে পেরে করছে! আসলে সে সারা পৃথিবীকে দায়ী করে যাচ্ছে। অভিমানী উচ্চারণকে যারা ফেসভ্যালুতে নেয়, তারা কী ভীষণ স্বেচ্ছামুখ্যু! আমার শৈশবের দুঃসহ একাকিত্বের জন্যে কি তারা দায়ী নয়, যারা দলিত বলে আমাকে খেলতে নেয়নি? আমার শরীর ও সত্তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার জন্য কি তারা দায়ী নয় যারা আমাকে শুধু আমার শরীরের রং ও তকমা দিয়ে বিচার করেছিল? আমার নিজেকে মনস্টার মনে হওয়ার জন্যে কি তারা দায়ী নয় যারা আমাকে মনস্টার ভেবে গায়ে ঢিল ছুড়েছিল খেদিয়ে দিয়েছিল ফেলোশিপ কেড়ে নিয়েছিল আর মাঠে ঠান্ডায় তাঁবুতে বাস করলেও বলেনি, ও আমাদের ভাই, ও আমাদের সঙ্গেই থাকবে?
প্রতি: এই খেয়েছে, ব্যক্তিগত আর সমষ্টিগত গুলিয়ে যাচ্ছে।
রোহিত: তাই যায়, ক্রমাগত যায়। আমরা সব্বাই নিজেদের ভাবি ব্যক্তি, আর অন্যদের সাহেব, মুসলিম, হিজড়ে, ভিখিরি। আমিও হয়তো কত সহপাঠীকে প্রথমে উচ্চবর্ণ, তার পর ব্যক্তি ভেবেছি। আবার, আমার নক্ষত্রযাত্রা যেই কুপিয়ে দেওয়া হল, সমষ্টির আকাশজার্নিও পিছিয়ে গেল অনেকটা। ইকুয়েশনটা এক গলার দড়িতে মাপা যাবে না।