কোনও পরিচয়পত্রে নিজের ধর্ম লেখেননি। আমৃত্যু শিখিয়েছেন মানবধর্ম কেমন করে পালন করতে হয়
History

অন্যকে ঘৃণা করে বিদ্বেষ ছড়িয়ে ধর্ম হয় না

বলেছিলেন গৌরী আইয়ুব। চিরকাল প্রচারের আলো থেকে সরে থাকলেও মানুষের কল্যাণসাধনের সঙ্কল্প থেকে সরেননি কখনও।

Advertisement

সফিয়ার রহমান

শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২১ ০৭:০৫
Share:

মনস্বিনী: গৌরী আইয়ুব। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিরক্ষা ছিল তাঁর সাধনা

আগের দিন রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। পরদিন সকালে শান্তিনিকেতনের জায়গায় জায়গায় রাঙামাটির কাদা। তবে সে মিহি কাদা পায়ে লাগে না তেমন। সেই রাঙামাটির পথে সে দিন খালি পা রেখেছিল উনিশ বছরের একটি মেয়ে। উদ্দেশ্য কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে ভর্তি হবে। শালবীথির পথ ধরে পূ্র্বপ্রান্তে দ্বারিক বাড়িতে এসে পৌঁছল সে। সেখানেই তখন শিক্ষাভবনের অফিস। সে দিন শিক্ষাভবনের অফিস সামলাচ্ছিলেন যে মানুষটি, তাঁর নাম ভুজঙ্গ। ছাত্রছাত্রীদের ভুজঙ্গদা। বেশ হাসিখুশি মুখেই সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন ভুজঙ্গদা। তিনিই চট করে ভর্তি হওয়ার ফর্ম বার করে দিলেন মেয়েটিকে। মেয়েটি নামধাম লিখে ফর্ম পূরণ করল, জমা দিল ভুজঙ্গদার হাতে। কিন্তু সেই পূরণ করা ফর্ম হাতে নিয়ে চোখ বুলোতেই ভুজঙ্গদার চোখ চড়কগাছ, মুখের হাসি উধাও। মেয়েটি পুরো ফর্ম ঠিকমতো পূরণ করলেও ‘রিলিজিয়ন’-এর জায়গায় কিছু না লিখে কাটাকুটি দিয়ে রেখেছে! ভুজঙ্গদা ভুরু কুঁচকে বললেন, “এ আবার কী হল?”

Advertisement

শান্ত মেয়েটি স্মিত হেসে স্পষ্ট গলায় জানাল, “আমি তো চিরকাল এই রকমই লিখে এসেছি। ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফর্মেও রিলিজিয়ন কিছু লিখিনি তো।”

ভুজঙ্গদার বিরক্তিপূর্ণ স্বগতোক্তি, “এখনকার ছেলেমেয়েদের... যত্তসব…” তখন স্বাধীনতার বয়স মাত্র তিন বছর। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এই ধরনের কাজ নিশ্চিত ভাবে দুঃসাহসিকতা। তবে শুধু দুঃসাহস নয়, থাকতে হবে মুক্ত চিন্তাভাবনাও। অনেকেই তো বাইরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রদর্শনী করে, কিন্তু অন্তরালে চিরাচরিত মানসিকতা থেকে বেরোতে পারে না। কিন্তু এই মেয়েটি তাদের দলে নয়। সে যা বিশ্বাস করে, তা প্রকাশ করতে তার কোথাও আপত্তি হয়নি। মেয়েটি দার্শনিক অধ্যাপক ধীরেন্দ্রমোহন দত্তের কন্যা গৌরী দত্ত, পরবর্তী কালে গৌরী আইয়ুব। জন্ম পটনায়, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩১। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গৌরী তাঁর উদার মুক্তচেতনার হাত ছাড়েননি।

Advertisement

সমাজ, পরিবেশের শত বাধা অতিক্রম করেও তিনি অধ্যাপক আবু সয়ীদ আইয়ুবকে জীবনসঙ্গী করেছিলেন। আইয়ুবের সঙ্গে তাঁর বয়সের বিরাট ব্যবধান, আইয়ুবের অসুস্থ শরীরের কথা জেনেও পিছপা হননি। স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছেন ভালবাসার মানুষটিকে। যা সত্যি বলে জেনেছেন এবং কর্তব্য বলে মেনেছেন, কখনও সরে আসেননি সেখান থেকে। শান্ত স্মিতমুখী মেয়েটির ব্যক্তিত্ব ছিল ইস্পাতকঠিন।

সত্তর দশকের ঘটনা। একটি অনুষ্ঠান শেষে একই ট্যাক্সিতে উঠেছেন গৌরী আইয়ুব, শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ও ওস্তাদ সাগিরুদ্দিন খানের স্ত্রী। তিন জনের আলাপ-আলোচনা শুনে অবাঙালি ট্যাক্সিচালক বুঝতে পারে, ওস্তাদ সাগিরুদ্দিন খানের স্ত্রী হিন্দু। হঠাৎ ট্যাক্সি-ড্রাইভার স্পর্ধিত গলায় বিষোদ্গারের ভঙ্গিতে বলতে শুরু করে, মুসলমানরা কৌশল করে হিন্দু জেনানাদের শাদি করে। এই ভাবে হিন্দু সমাজের পবিত্রতা নষ্ট হয়। আর কিছু লেড়কি আছে, যারা হিন্দু হয়েও তাদের ধর্ম আর সমাজকে মুসলমানদের কাছে বিকিয়ে দেয়... এই ধরনের কথা বলতে বলতে যখন ড্রাইভারের ঔদ্ধত্য ও ক্রোধ ক্রমশ বাড়ছে, শুভাপ্রসন্ন তাকে চুপ করতে বলেন। গৌরী আইয়ুব কিন্তু গাড়িচালকের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলেছিলেন, ‘জানো, আমিও এক জন মুসলমানকে বিয়ে করেছি। কিন্তু আমরা তো এ রকম কিছু ভাবিনি। মানুষের ধর্মে আমাদের শ্রদ্ধা ছিল, মিল ছিল, আজও আছে। সেই মিলটাই তো দরকার। আমাকে দেখে কি তোমার মনে হয়েছে— আমরা দেশকে, ধর্মকে, সমাজকে নষ্ট করে দিয়েছি? যে ধর্মই তুমি পালন করো, বিশ্বাস করো— তা তো মানুষ হবার কথা শেখায়। অন্যকে ঘৃণা করে বিদ্বেষ ছড়িয়ে ধর্ম পালন হয় না।’ গৌরী আইয়ুব ট্যাক্সি-ড্রাইভারের ওপর তিলমাত্র বিরক্তি না দেখিয়ে, রূঢ় কথা না বলে তাকে ভাবনাচিন্তার এক উন্নত রাস্তা দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গৌরী আইয়ুবের ভিতরকার সেবাধর্ম এবং সাংগঠনিক শক্তির প্রকৃত পরিচয় মেলে। তাঁর সেবাধর্ম আরও স্থায়ী রূপ পেল মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে ‘খেলাঘর’ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। মৈত্রেয়ী দেবীর মৃত্যুর পর এর পুরো দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়েছিল গৌরীর উপর। খেলাঘরের অনাথ ছেলেমেয়েদের স্নেহ-আদর-যত্ন দিয়ে সুস্থ জীবনের আদর্শ গড়ে তোলার নিরলস প্রচেষ্টা করে গেছেন আজীবন। খেলাঘর দেখে অনুপ্রাণিত হয়নি, এমন মানুষ নেই।

গৌরী আইয়ুব লেখক, শিক্ষাবিদ ও সফল শিক্ষিকা। তবে শিক্ষিকারূপে গৌরী আইয়ুবের যথার্থ প্রকাশ ঘটে ‘খেলাঘর’-এর ছেলেমেয়েদের মানবিক বিকাশের জন্য তাঁর উদ্যোগে। যশ-স্বীকৃতির মোহ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। কল্যাণকর্মের প্রসঙ্গে তিনি ছিলেন নিরলস।

বিনয়, নম্রতা, স্বার্থত্যাগ আবার প্রয়োজনে দৃঢ়চেতা মনোভাব গৌরীর চরিত্রে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। তিনি এমন এক দুর্লভ গোত্রের মানুষ, যাঁর আপন-পর ভেদজ্ঞান ছিল না কখনও। তেমনই ছিল না কোনও রকম প্রচারের আলোয় আসার আগ্রহ। ১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশে যাওয়ার আগে তিনি আবু সয়ীদ আইয়ুবের ভাগ্নি ডক্টর সুলতানা এস জামানকে চিঠিতে লিখলেন, ‘আমি এই প্রথম ও শেষবার যাচ্ছি। উদ্দেশ্য আত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা এবং বাংলাদেশকে দু’চোখ ভরে দেখে আসা। আমি সভাসমিতি করতে চাই না, ভালবাসি না। শারীরিক ও মানসিক কষ্ট পাই। তোমরা আমাকে ওসব থেকে রক্ষা কোরো।’

বেগম রোকেয়ার জন্মশতবর্ষে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি বিশেষ নিবন্ধ লিখেছিলেন গৌরী আইয়ুব। ওই নিবন্ধ বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায়কে নাড়িয়ে দিয়েছিল। বেগম রোকেয়ার জীবনের নানা দিক তুলে ধরে তাঁকে নির্বাসন থেকে টেনে বার করে আনার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন গৌরী আইয়ুব। তা না হলে হয়তো রোকেয়াচর্চা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যেত। বেগম রোকেয়ার মতো গৌরী আইয়ুবও এক মুক্ত, সুস্থ, শিক্ষিত, স্বাধীন নারীসমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন।

হিন্দু ও মুসলমান, দুই সম্প্রদায়েরই কয়েকজন উদার মুক্তমনের মানুষকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল ‘সুরাহা-সম্প্রীতি’ মঞ্চ এবং তার সভানেত্রী ছিলেন গৌরী আইয়ুব। অসুস্থ হওয়ায় গৌরী যখন প্রায় গৃহবন্দি, তখন তিনি বার বার ‘সুরাহা-সম্প্রীতি’-র সভানেত্রীর পদ ছাড়তে চেয়েছেন। সহ-সভানেত্রী ইন্দ্রাণী বসুকে একটু অনুযোগের সুরেই বলেছিলেন, “কেন তোমরা আমায় ‘সুরাহা সম্প্রীতি’র সভানেত্রী হিসেবে এখনও রেখেছ। এক জন পঙ্গু মানুষকে এ ভাবে ধরে রেখে লাভ কী?” লাভ কী, তা গৌরী আইয়ুব না বুঝলেও ইন্দ্রাণীরা বুঝতেন। গৌরী আইয়ুব নামটিই প্রকৃত প্রস্তাবে ‘সুরাহা-সম্প্রীতি’র লোগো। কারণ তিনিই ছিলেন দুই সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির ধারক ও বাহক। হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে সহাবস্থান করার অর্থ তিনি শুকনো বক্তৃতা বা তত্ত্বকথা দিয়ে নয়, নিজের জীবনচর্যা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ‘সুরাহা-সম্প্রীতি’-র সহ-সভানেত্রী ইন্দ্রাণী বসু দ্বিধাহীন ভাবে এ কথা স্বীকার করেছেন, এই উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমান— এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কী ভাবে মিলনসেতু রচনা করা যায়, তা গৌরী আইয়ুবের কাছে শিক্ষণীয়।

১৯৯৮ সালের ১৩ জুলাই, ৬৭ বছর বয়সে কলকাতায় গৌরী আইয়ুবের মৃত্যু হয়। আজ উপমহাদেশের রাজনীতি যখন হিন্দু-মুসলিমের পারস্পরিক বিদ্বেষে ইন্ধন জোগায়, দাঙ্গা বাধানোর ফিকির খোঁজে, তখন গৌরী আইয়ুবের মতো উন্নতহৃদয় মানুষের অভাব আরও বেশি করে কষ্ট দেয়।

তথ্যঋণ: কৃতজ্ঞতার অশ্রুবিন্দু সম্পাদনা: মীরাতুন নাহার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন