ভাইরাস শিকারি

৯৯৭ সালের মার্চ। ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়িতে বসে কাগজের পাতা ওলটাচ্ছিলেন ডা. য়োহান হুল্‌তিন। প্রায় বছর দশেক হল প্যাথোলজিস্ট হিসেবে অবসর নিয়েছেন। ডাক্তার হলেও উন্মাদ, খ্যাপা, ছিটেল হিসেবেও য়োহানের বেশ খ্যাতি। চাকরি-জীবনে বিনা কারণে হাসপাতাল বদলেছেন। মায়ো ক্লিনিকের পাকা চাকরি ভাল লাগল না, তো ২৫০ ডলার দিয়ে একটা জং-ধরা, ধ্যাড়ধেড়ে গরু-মোষ নিয়ে যাওয়ার গাড়ি কিনে, তাতে বউ, চার ছেলেমেয়ে আর সব জিনিস চাপিয়ে চললেন অন্য শহরের পথে, বিনা নোটিসে।

Advertisement

নির্মাল্য দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

১৯৯৭ সালের মার্চ। ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়িতে বসে কাগজের পাতা ওলটাচ্ছিলেন ডা. য়োহান হুল্‌তিন। প্রায় বছর দশেক হল প্যাথোলজিস্ট হিসেবে অবসর নিয়েছেন। ডাক্তার হলেও উন্মাদ, খ্যাপা, ছিটেল হিসেবেও য়োহানের বেশ খ্যাতি। চাকরি-জীবনে বিনা কারণে হাসপাতাল বদলেছেন। মায়ো ক্লিনিকের পাকা চাকরি ভাল লাগল না, তো ২৫০ ডলার দিয়ে একটা জং-ধরা, ধ্যাড়ধেড়ে গরু-মোষ নিয়ে যাওয়ার গাড়ি কিনে, তাতে বউ, চার ছেলেমেয়ে আর সব জিনিস চাপিয়ে চললেন অন্য শহরের পথে, বিনা নোটিসে। ১৯৮৮ সালে তো হঠাৎ করে ২১ ডিসেম্বর অবসরই নিয়ে ফেললেন। ২১ ডিসেম্বর কেন? কারণ ওটাই বছরের সবচেয়ে ছোট দিন। ‘শেষ দিনে আমি বাপু বেশি কাজ করতে পারব না।’ ১৯৮৫-তে ৬০ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিয়ের সময়, নতুন স্ত্রী এলিনকে অনুনয়-বিনয় করে ‘আর একটি বার অভিযানে যেতে দাও’ বায়না ধরেছিলেন। গিয়েছিলেন কোথায়? পাকিস্তানে, কারাকোরামের এক অনামা শৃঙ্গ জয় করতে। ৫৭ বছর বয়সে সবচেয়ে বয়স্ক হিসেবে চিনের মাস্তাগ আটা থেকে ২৫,০০০ ফুট স্কি করে নামতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন। মারাই যেতেন, কিন্তু অন্ধকার-ঠান্ডা-খিদে সব তুচ্ছ করে খালি মনের জোরে বেঁচে ফেরেন। এলিন তো সব সময় ভয়ে থাকেন, তাঁর এই ‘অপূর্ব উন্মাদটি’ আবার কখন কী করে বসেন।

Advertisement

উন্মাদটি পায়ের ওপর পা তুলে পাতা ওলটাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা খবরে চোখ আটকে গেল। ‘ঘাতক ভাইরাসের খোঁজ’। প্রথম লাইনটা পড়েই টানটান হয়ে বসলেন ৭২ বছরের য়োহান। আমেরিকান সেনাবাহিনীর এক প্যাথোলজিস্ট, জেফ্রি টবেনবার্গার, ১৯১৮ সালের বীভৎস ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ ভাইরাসের জিনের নকশার কিছুটা অংশ আবিষ্কার করেছেন।

১৯১৮-র এই নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসটির ঘাতক আক্রমণ প্রথম শুরু হয় স্পেনে। সে জন্য এর নাম স্প্যানিশ ফ্লু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য তখন সৈনিক, নাবিক, উদ্বাস্তুরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ছিল, আর তাদের সঙ্গে সঙ্গে এই মারণ ফ্লু-ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল সারা পৃথিবীতে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্ত হয়েছিল ৫০ কোটি মানুষ, পৃথিবী জুড়ে। মৃত্যুমিছিল পৌঁছেছিল পাঁচ কোটিতে, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহতের সংখ্যার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি। কিন্তু সে সময় মলিকিউলার বায়োলজি এত উন্নতি করেনি, তাই সেই ফ্লু ভাইরাসের জিনের নকশাও জানা যায়নি, আর কী ভাবে সংক্রমণ হল, তা-ও জানা যায়নি। এখন কাগজের খবরটি হল— ৩৬ বছরের প্যাথোলজিস্ট টবেনবার্গার আর আণবিক জীববিজ্ঞানী অ্যান রিড সেই সময়কার স্প্যানিশ ফ্লু-তে মৃত ৭৮ জন সৈনিকের ফর্মালিনে সংরক্ষিত ফুসফুসের টুকরোর নমুনা ঘেঁটে, শেষে এক মৃত সৈনিকের নমুনা থেকে এই ভাইরাসের যেটুকু আরএনএ অণু পেয়েছেন, তাই দিয়ে ভাইরাসের ছোট্ট একটু জিন-বিন্যাসই উদ্ধার করতে পেরেছেন। টবেনবার্গারের আশা, অন্যান্য গবেষকরাও যদি তাঁদের সংরক্ষণাগারে স্প্যানিশ ফ্লু-তে মৃতের ফুসফুসের নমুনা তন্নতন্ন করে খোঁজেন, হয়তো এই মারণ-ভাইরাসের সম্পূর্ণ জিন-বিন্যাস তৈরি করা সম্ভব হবে।

Advertisement

শেষ অংশটা পড়ে য়োহানের রক্ত টগবগিয়ে ফুটতে লাগল। মনে মনে ফিরে গেলেন ৪৮ বছর আগে। তখন তিনি ২৪ বছরের জোয়ান। মাতৃভূমি সুইডেনে ডাক্তারি পড়তে পড়তে আমেরিকায় চলে এসেছিলেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে। মাইক্রোবায়োলজিতে আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর হওয়ার পর, ইচ্ছে ছিল ভাইরাস নিয়ে ডক্টরেট করবেন। যোগ দিলেন বিখ্যাত ইনফ্লুয়েঞ্জা বিজ্ঞানী ডা. অ্যালবার্ট ম্যাকি’র ল্যাবে। কাজ শুরু করলেন ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে। ম্যাকির ল্যাবে এক দিন এক প্রবীণ ভাইরোলজিস্ট এলেন। গল্প হচ্ছিল স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাস নিয়ে। উনি দুঃখ করে বলছিলেন, নমুনার অভাবে এ নিয়ে কাজ বেশি দূর এগোল না। কিন্তু কারও এক বার আলাস্কায় যাওয়া উচিত। ওখানে বহু গ্রাম উজাড় হয়ে গিয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু-তে। ওখানকার ভূগর্ভস্থ অঞ্চলে ওই অসুখে মৃত লোকেদের গণকবর পাওয়া যাবে। সেখান থেকে ওই ভাইরাস উদ্ধার করা সম্ভব।

শেষ কথাগুলো পাগলা য়োহানের সাঁকো নাড়াবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। সঙ্গে সঙ্গে য়োহান গাইডকে গিয়ে বললেন, এটা কি আমার পিএইচডি-র বিষয় হতে পারে? গাইড ম্যাকি রাজি।

য়োহান প্রায় তক্ষুনি রওনা দিলেন আলাস্কার পথে। ১৯৪৯-র গ্রীষ্মকালটা য়োহান আলাস্কায় কাটালেন জীবাশ্মবিদ ওটো গাইস্ট-এর সহকারী হয়ে। গাইস্ট ওই অঞ্চলে আগেও কাজ করেছেন, আর ওখানকার এস্কিমোদের মধ্যে কাজ করা মিশনারিদের সঙ্গেও ওঁর ভালই পরিচয়। য়োহান মিশনারিদের কাছ থেকে এস্কিমো গ্রামগুলোতে ১৯১৮-’১৯-এর মহামারীতে মৃত্যুর নথি সংগ্রহ করলেন। তার পর গেলেন সেনাবাহিনীর কাছে। সেনাবাহিনীই সে সময় খনি-শ্রমিকদের দিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে বিশাল জায়গার বরফ খুঁড়ে মৃতদেহগুলোকে কবরস্থ করেছিল। তাদের নথি থেকে য়োহান আলাস্কার চিরহিমায়িত অঞ্চলের সেই গণকবরের অবস্থানের আন্দাজ পেলেন। দুই নথি মিলিয়ে দেখে, য়োহান শেষ পর্যন্ত তিনটি গ্রামকে চিহ্নিত করলেন ভাইরাস খোঁজার জন্য।

দু’বছর বাদে, সব পরিকল্পনা করে য়োহান প্রথমে গেলেন নোম গ্রামে। দেখলেন ১৯১৮ থেকে ১৯৫১, এই ৩৩ বছরে নোম আর গ্রাম নেই, রীতিমত শহর। আর ১৯১৮-র সেই গণকবরের কাছে এসে দেখেন, নদীর গতিপথও বদলে গেছে, চিরতুষার অঞ্চলও গলে গেছে। য়োহান বুঝলেন এখানে ওঁর কাজ হবে না, কারণ বরফ গলে মৃতদেহ পচে গেছে এত দিনে। উনি ছোট্ট একটা প্লেন ভাড়া করে উড়ে গেলেন দ্বিতীয় গ্রামের দিকে। কিন্তু এখানেও বরফ গলে গেছে। পাইলটকে নিয়ে এ বার উড়ে চললেন ব্রেভিগ মিশনের দিকে, কিন্তু সেখানে প্লেন ল্যান্ড করার কোনও জায়গাই পাওয়া গেল না। অন্য একটা গ্রামে গিয়ে প্লেন ল্যান্ড করাতে হল। তার পর একটা নৌকো করে কিছুটা এলেন। এর পর ভেজা স্যাঁতসেঁতে তুন্দ্রা অঞ্চল দিয়ে ছ’মাইল হেঁটে আছাড় খেতে খেতে পৌঁছলেন ব্রেভিগে। গণকবরের জায়গাটা দেখলেন। মনে হল, হ্যাঁ, এখানে খঁুড়লে ফল পাওয়া যেতে পারে।

কিন্তু খোঁড়ার জন্য গ্রাম সংসদের অনুমতি দরকার। এস্কিমোদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। সবচেয়ে বড় পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক মহিলাই সংসদের মাথা। য়োহান জানতে পারলেন, ১৯১৮-র সংক্রমণের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া তিন জন এখনও এই গ্রামে থাকেন। য়োহান তখন তাঁদের অনুরোধ করলেন, গ্রামবাসীদের সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বলতে— কী ভাবে এক সপ্তাহের মধ্যে এই গ্রামের ৮০ জনের মধ্যে ৭২ জনই মারা গিয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু-তে।

তার পর য়োহান বললেন, আমি এই কবর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে নিয়ে যাব, যদি সব ঠিকঠাক থাকে, এর থেকে ভ্যাকসিন বানাব। আবার এ রকম ভাইরাসের আক্রমণ হলে ওই ভ্যাকসিন আপনাদের বাঁচাবে। ভ্যাকসিন ব্যাপারটা গ্রামবাসী মোটামুটি জানত। কারণ এখানে এর আগে সরকারের তরফে পক্স ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। কথাটা সংসদের কর্ত্রী জেনি ওয়ানা-র মনে ধরল। ফলে আর বাধা রইল না।

য়োহান খুঁড়তে শুরু করলেন। ফুটখানেক খোঁড়ার পরই পেলেন বরফের এক প্রচণ্ড কঠিন আস্তরণ। ভেসে আসা কাঠ-কুটো জড়ো করে আগুন জ্বালালেন। গলতে শুরু করল বরফ। দ্বিতীয় দিনে চার ফুট খোঁড়ার পর বছর দশ-বারোর একটি বাচ্চা মেয়ের দেহ পেলেন। মেয়েটির দেহে এত দিন বাদেও একটুও পচন ধরেনি। য়োহান বুঝলেন, আরও নীচে গেলে দেহগুলি আরও অবিকৃত পাওয়া যাবে। মোট ৭২টা দেহ এখানে সমাধিস্থ আছে। পর দিন ওঁর গাইড, গাইস্ট, আর শব-ব্যবচ্ছেদের জন্য আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়েরই বিখ্যাত প্যাথোলজির প্রফেসর জ্যাক লেটনও এসে পৌঁছলেন ব্রেভিগে। চার জন মিলে তিন দিন খোঁড়ার পর, ফুট ছয়েক নীচে তিনটি অবিকৃত দেহ পেলেন। ডা. লেটন শবগুলো ব্যবচ্ছেদ করে দেখলেন ফুসফুসগুলো সম্পূর্ণ অবিকৃত, এবং ফুসফুসে জমাট বাঁধা রক্ত দেখেই বুঝলেন, মৃত্যুর কারণ স্প্যানিশ ফ্লু। স্টিলের কৌটোয় বিভিন্ন দেহাংশ সংগ্রহ করে ওঁরা কবরগুলো আবার বুজিয়ে দিলেন।

আইওয়ার ল্যাবে ফিরে এসে য়োহান তো মহা উৎসাহে কাজ শুরু করলেন। কিন্তু সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস কেটে গেল, কিছুতেই উনি আর ভাইরাস বাঁচিয়ে তুলতে পারলেন না। জীবজন্তুকে সংক্রামিত করার চেষ্টা করলেও তাদের ওপর কোনও প্রভাব পড়ল না। আলাস্কা থেকে সংগ্রহ করা সব নমুনাও ফুরিয়ে গেল। সঙ্গে ফুরিয়ে গেল য়োহানের পিএইচডি-র স্বপ্নও। ধসে যাওয়া য়োহান ঠিক করলেন, আবার সুইডেনেই ফিরে যাবেন, আর অর্ধসমাপ্ত ডাক্তারিটাই শেষ করবেন। সৌভাগ্যক্রমে আইওয়াতেই সুযোগ পেলেন ডাক্তারি পড়ার। প্যাথোলজিতে এমডি করে বিভিন্ন নামী হাসপাতালে প্যাথোলজিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন এত দিন। সাফল্য, সম্মান পেয়েছেন নিজের ক্ষেত্রে।

সাফল্য পেয়েছেন অন্য ক্ষেত্রেও। অবসর সময়ে গাড়ির স্বয়ংক্রিয় নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা করে ১৯৬৪ সালে পেয়েছিলেন অটোসেফটি পুরস্কার। ১৯৬৮-তে স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ইঞ্জিনিয়ারিং শাখায় স্বয়ংক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিভাগ খোলার অনুমোদন পেয়েছিলেন। অপূর্ব কাঠের কাজ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তবুও, এত পরিশ্রম আর চেষ্টার পরেও পিএইচডি না পাওয়া ওঁর হৃদয়ে কাঁটার মতো বিঁধে আছে।

কাগজে এত দিন পর ওই ভাইরাস-শিকারের চেষ্টার কথা পড়ে, উনি একটা মেল করলেন টবেনবার্গারকে, ব্রেভিগ মিশনে ওঁর সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা জানিয়ে। লিখলেন, ‘যদি তুমি আরও নমুনা চাও, আমায় জানাও, আমি তা হলে আলাস্কায় যাব।’

বেশ কিছু দিন কেটে গেল। উত্তর আসে না। য়োহান হাসলেন। ভাবলেন, তাঁর ঠিক অর্ধেক বয়সি টবেনবার্গার তাঁকে এক বাহাত্তুরে উন্মাদ ভেবেছে, যেমন অন্য অনেকে ভাবে। কিন্তু কিছু দিন বাদে ফোন এল। টবেনবার্গার জানালেন— মেল পেয়েছিলেন ঠিক সময়েই। মনস্থির করতে সময় নিচ্ছিলেন। য়োহানের প্রস্তাবে উনি ভীষণ উজ্জীবিত। বললেন, আপনি কবে নাগাদ যেতে পারবেন?

য়োহান বললেন, এই হপ্তায় তো একটু মুশকিল, তবে পরের হপ্তায় নিশ্চয়ই যেতে পারব।

টবেনবার্গার বললেন, পরের সপ্তাহে! কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তো টাকাকড়ি জোগাড় করা যাবে না!

য়োহান বললেন, কুছ পরোয়া নেই! কত আর খরচা হবে? তিন-চার হাজার ডলার। ওটুকু আমি নিজেই দিতে পারব।

টবেনবার্গার বললেন, অ্যাঁ! সে কী! আর যন্ত্রপাতি?

য়োহান গলা নামিয়ে বললেন, আমার বউয়ের বাগান কোপানোর জিনিস আছে তো। ও আমি চুপিচুপি হাতিয়ে নিয়ে চলে যাব। ব্যাপারটা আবার পাঁচকান কোরো না, কারণ আমার বউ জানতে পারলে কিছুতেই ওগুলো নিতে দেবে না।

১৯৯৭ সালের অগস্ট মাসে আবার য়োহান ব্রেভিগে এসে পৌঁছলেন। ৪৬ বছর পর। প্রথমেই দেখা করলেন মিশনারিদের সঙ্গে। দেখলেন এক জন যাজক ওঁর ১৯৫১ সালের খোঁড়াখুঁড়ির ব্যাপারটা জানেন। কিন্তু তিনি বললেন, আবার নতুন করে খোঁড়াখুঁড়ি করতে হলে তো নতুন করে ওদের অনুমতি নিতে হবে। মনে হয় না আপনি দ্বিতীয় বার অনুমতি পাবেন। তাও চলুন আপনাকে গ্রাম সংসদের কর্ত্রী রিটা ওয়ানার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। আলাপের পর য়োহান রিটাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, আচ্ছা, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেও আমি এখানে এসেছিলাম। তখন গ্রাম সংসদের কর্ত্রী ছিলেন জেনি ওয়ানা। আপনি কি তাঁর কেউ হন? রিটা হেসে বললেন, উনি আমার দিদিমা। দিদিমার কাছে আপনার কথা শুনেছি। জানি, আপনি আগেও কী পরিশ্রমটাই না করেছেন। এখনও আপনাদের গবেষণার গুরুত্ব বুঝতে পারছি। কিন্তু ব্যাপার হল, আবার খোঁড়াখুঁড়ি করলে ওই ভাইরাস যদি বেঁচে ওঠে? যদি আবার মহামারী হয়?

য়োহানের মুখে একটা বেদনার্ত হাসি দেখা দিল। হাজার চেষ্টাতেও যে ওই ভাইরাস আর জীবন্ত হবে না, সে ওঁর চেয়ে ভাল আর কে জানে। তিনি ব্যাপারটা সব গ্রামবাসীকে বুঝিয়ে বললেন। রিটা অনুমতি দিলেন। কিন্তু যোহান বুঝলেন, উনি যতই এটাকে ‘বিরাট কাজ’ বলে সবাইকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করুন, গ্রামের কেউই নিজের হাতে কবর খুঁড়ে মৃতদেহ ঘাঁটতে চাইছে না। যা করার ওঁকেই করতে হবে।

শেষে সংসদ চার জন যুবক-এস্কিমোকে য়োহানের সাহায্য করার জন্য নিযুক্ত করল। তারাও একটু গাঁইগুঁই করছিল— প্রেতাত্মার ভয়ের কারণে। কেউ এক জন ওদের বোঝাল, যেহেতু এদের খ্রিস্টীয় মতে কবরস্থ করা হয়েছে, এদের আত্মা পরম পিতার কাছে ফিরে গেছে। প্রেতাত্মার ভয় নেই।

প্রথম দিন পাঁচ ফুট খুঁড়েও কিছু পাওয়া গেল না। তা হলে কি জায়গাটা য়োহান ভুল করলেন! পরের দিন আরও দু’ফুট খোঁড়ার পর একটা কঙ্কাল পাওয়া গেল। আরও একটু খুঁড়তেই পাওয়া গেল মোটামুটি অবিকৃত একটি দেহ। বছর তিরিশের এক মহিলার। কাপড়-জামা ফেটে গেলেও, দেহত্বক মোটামুটি অটুট আছে। বোঝা যাচ্ছে মহিলা বেশ মোটা ছিলেন।

য়োহান ব্যবচ্ছেদ করলেন। জমাট রক্ত ভর্তি ফুসফুস দুটো দেখেই বুঝলেন, স্প্যানিশ ফ্লু-তেই এর মৃত্যু হয়েছিল। য়োহান মহিলার নামকরণ করলেন লুসি। সামান্য সময়ের জন্য বরফ গললেও, লুসির চর্বির স্তর তাপ-অপরিবাহী হিসেবে কাজ করায়, ফুসফুসে তাপমাত্রার তারতম্য পৌঁছতে পারেনি। তাই ফুসফুস দুটি অক্ষত আছে। নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলেন য়োহান। কারণ এস্কিমোরা সাধারণত মোটা হয় না। তাদের খাবারের উৎস সীমিত, আর খাবারের জন্য প্রচুর পরিশ্রমও করতে হয় (অন্তত ১৯১৮-তে তো করতে হত বটেই)। কিন্তু এই লুসির খাবারের কোনও অভাব ছিল না। নিজের মনেই রসিকতা করে য়োহান বললেন, ওর বর নিশ্চয়ই ওকে খুব ভালবাসত আর ওর জন্য সিলটা-সিন্ধুঘোটকটা শিকার করে আনত, যে জন্য ওর দেহে এই অতিরিক্ত চর্বি জমেছিল। লুসির ফুসফুস দুটিকে য়োহান বিশেষ এক দ্রবণে চুবিয়ে রাখলেন, যাতে ওর মধ্যেকার ভাইরাসের আরএনএ নষ্ট না হয়।

বাড়ি ফিরে য়োহান সাইবেরিয়ায় পরবর্তী অভিযানের পরিকল্পনা করছেন, আর অপেক্ষা করছেন, কবে টবেনবার্গার খবর পাঠান। এ বারও কি সেই সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হবে! কিন্তু দিন দশেক পরেই টবেনবার্গারের উত্তেজিত ফোন, দারুণ নমুনা, আর পাঠিয়েছও অনেক। দুর্দান্ত কাজ হবে। এত দিন ফর্মালিনে ডোবানো ফুসফুস থেকে নেওয়া নখের মতো ছোট্ট টুকরো দিয়ে কাজ সারতে হত, আর তুমি তো গন্ধমাদন পর্বত তুলে আনার মতো গোটা ফুসফুসটাই নিয়ে এসেছ। নিঃসন্দেহে এটা দিয়ে আমরা স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাসের পুরো জিন-বিন্যাস উদ্ধার করতে পারব। য়োহানের স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল। ১৯৫১-তে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, ১৯৯৭-এ এসে হয়তো তা শেষ হল।

দু’বছর গবেষণার শেষে, স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের হিমাগ্লুটনিন, যেটি দিয়ে ভাইরাস মানবকোষকে আঁকড়ে ধরে সংক্রমণের সময়, তার সম্পূর্ণ জিন-বিন্যাস অ্যান রিড আর টবেনবার্গার মিলে বের করে ফেললেন। প্রকাশিত হল বিখ্যাত আমেরিকান জার্নালে, সহ-গবেষক হিসেবে নাম থাকল য়োহান হুল্‌তিনেরও। স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাস নিয়ে প্রথম পেপারটা ছাপতে য়োহানকে প্রথম অভিযানের পর প্রায় পঞ্চাশ বছর অপেক্ষা করতে হল!

এর পর অ্যান আর টবেনবার্গার পর পর বেশ কয়েকটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যাতে ভাইরাসের অন্যান্য জিনের বিন্যাস উদ্ধার করা হয়েছিল। তা ছাড়াও সারা পৃথিবী জুড়ে অনেক বিজ্ঞানী এই নিয়ে মূল্যবান গবেষণা করেছেন, এখনও করছেন, অনেক আশ্চর্য দামি তথ্য জানা গেছে, যা পৃথিবী আন্দাজই করতে পারত না, খ্যাপা য়োহান আলাস্কায় না গেলে!

nirmalyadg@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement