প্রেমের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প

সে দেশের নিয়মকানুন একুশে আইনের চেয়েও আজব! যে অভাগাদের বিয়ে হয়নি, বা ডিভোর্স হয়ে গেছে, তাদের ৪৫ দিনের জন্য একটা হোটেলে পুরে দেওয়া হবে। ওই সময়ের মধ্যে যারা কোনও সঙ্গী/সঙ্গিনী জোটাতে পারবে না, তাদেরকে তাদেরই পছন্দমাফিক একটা জন্তু বানিয়ে পাশের জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হবে। ঝকঝকে পাঁচতারা হোটেলটা আসলে রম্য-মোহন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প!

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৬ ০০:১০
Share:

সে দেশের নিয়মকানুন একুশে আইনের চেয়েও আজব! যে অভাগাদের বিয়ে হয়নি, বা ডিভোর্স হয়ে গেছে, তাদের ৪৫ দিনের জন্য একটা হোটেলে পুরে দেওয়া হবে। ওই সময়ের মধ্যে যারা কোনও সঙ্গী/সঙ্গিনী জোটাতে পারবে না, তাদেরকে তাদেরই পছন্দমাফিক একটা জন্তু বানিয়ে পাশের জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হবে। ঝকঝকে পাঁচতারা হোটেলটা আসলে রম্য-মোহন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প! সেখানে বউ-পালানো, নিপাট ভালমানুষ ডেভিড আসে ভাইয়ের হাত ধরে। বা আর একটু পরিষ্কার করে বললে, ইতিমধ্যেই কুকুর বনে যাওয়া ভাইটির গলায় আঁটা চেনটা হাতে ধরে।

Advertisement

হোটেলের ম্যানেজার যখন জিজ্ঞেস করে, সঙ্গিনী না-জুটলে সে কোন জন্তুটা হতে চায়, ডেভিড বলে ‘লবস্টার’, মানে গলদা চিংড়ি! কারণ চিংড়ি নাকি একশো বছরেরও বেশি বাঁচে আর অনেক দিন অবধি যৌন-সক্ষম থাকে। কোনও সঙ্গিনী জোটাতে না পেরে, মরিয়া ডেভিড ঠিক করে, এখানকার ‘হৃদয়হীনা’ বলে পরিচিত মেয়েটিকেই সে পটাবে। মেয়েটি তাকে পরীক্ষা করার জন্য দম আটকে মরতে বসার ভান করে, ডেভিড ফিরেও তাকায় না। ‘মিস হৃদয়হীনা’ ভেবে নেয়, এ পুরুষটিও তার মতোই খটখটে পাথুরে-হৃদয়। দুজনের জমবে ভাল। কিন্তু তাদের নতুন সম্পর্কের ট্রায়াল রানের শুরুতেই হোঁচট। হৃদয়হীনা ঠান্ডা মাথায় ডেভিডের কুকুর ভাইটিকে খুন করে, রক্ত-মাখা হাতে-পায়ে তাকে এসে ঘটনাটা জানালে, সে গোড়ায় কিচ্ছু-যায়-আসে-না ভাব দেখালেও একটু পরেই ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলে। নারীটি বুঝে যায়, তাদের এ সম্পর্ক ভয়ানক ‘মিথ্যে’র ওপর দাঁড়িয়ে। এ পুরুষের হৃদয়ভর্তি এখনও প্রচুর মায়া-মমতা। মেয়েটি ‘বিশ্বাসঘাতক’ ডেভিডকে হোটেল ম্যানেজারের হাতে তুলে দিতে চায়। ডেভিড তার খপ্পর এড়িয়ে হোটেলের চৌহদ্দি ছেড়ে শেষমেশ জঙ্গলে পালিয়ে যায়।

পরিচালক তাঁর প্রথম ইংরেজি ছবিতে এ ভাবেই নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমাজের চাপিয়ে দেওয়া তেলচিটে ময়লা ধারণাগুলোকে তুমুল ঠাট্টা করেছেন। নারী আর পুরুষকে জোড়ায় জোড়ায় থাকতেই হবে, আর দুজনকেই হতে হবে অ্যাক্কেবারে এর-ওর মনের মতো— পাশের বাড়ির পিসিমা থেকে অনলাইন ডেটিং সাইটগুলো অবধি সব্বাই এই যে চচ্চড়ি বেচে যাচ্ছেন, ছবিটা তার গালে ঠাটিয়ে থাপ্পড়! ছবির ওই অ্যালিগরিক্যাল হোটেলে, নাক থেকে রক্ত বেরনো মেয়ের ‘যোগ্য প্রেমিক’ হওয়ার জন্য ছেলেটিকে শক্ত টেবিলে নাক ঠুকে রক্ত বের করতে হয়। হৃদয়হীনার জন্য হৃদয়হীন সাজতে হয় ডেভিডকে। আমরা যে ভাবে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির মধ্যে প্রাণপণ খুঁজি আমার সঙ্গে ‘কমন’ পড়বে এমন বৈশিষ্ট্য: ‘ও’-ও গান ভালবাসে তো, বা পাহাড়?

Advertisement

তবে জঙ্গলে এসেও যে ডেভিড খুব মুক্তি পায়, তা নয়। দম্পতিদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন একলা নারী-পুরুষ ওখানে দল পাকিয়ে থাকে। তাদের পান্ডা যে মেয়েটি, তার ভাবসাব জঙ্গি গেরিলা সংগঠনের নেত্রীর মতো। হোটেলে যেমন মানুষের মনের হদিশ না রেখেই জোর করে প্রেম করানো হয়, সেই একই রকম পালটা ফ্যাসিবাদী হিংসা দিয়েই এখানে রোমান্সের গলা মুচড়ে দেওয়া হয়।

তবু অনুভূতিহীনতার এই তাসের দেশেও ডেভিড সত্যি সত্যি একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়। ডেভিডের মতোই সে মেয়েরও চোখের নজর একটু কম। ওদের প্রেমের আন্দাজ পেয়ে, মেয়েটিকে গেরিলা-নেত্রী জোর করে অন্ধ করে দেয়। ছবির একেবারে শেষে ওরা পালায়, কিন্তু ‘কাছাকাছি’ আসার জন্যে ডেভিডও অন্ধ হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ওদের রোমান্সের তখন হাতে-পায়ে কোনও শিকল-বেড়ি না থাকলে কী হবে, দুজনে হবহু দুজনের মতো হয়ে ওঠার সেই বাধ্যতা তো আছেই! শেষ দৃশ্যে রেস্তরাঁর টেবিল থেকে ছুরি-কাঁটা নিয়ে ডেভিড বাথরুমে যায়, নিজের চোখ গেলে দেওয়ার জন্য। শেষ অবধি সে অন্ধ হয় কি না, আমরা জানি না। হয়তো মহান আবেগ ‘প্রেম’ বিষয়ে তার চোখ খুলে যায়!

sanajkol@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন