শব্দপ্রাণ: ‘নুকুবাবু’, সুশীল চট্টোপাধ্যায়। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
ভালবাসার জন্য চুপটি করে অপেক্ষায় আছেন তিনি। আর ভালবাসা-রা নিজেরাই ঘুরেফিরে এসে তাঁকে খুঁজে নিচ্ছে। উত্তর কলকাতার এক অখ্যাত গলির কোণে, ৯৩ বছরে পা দেওয়া জীবনটির নির্যাস বলতে এটুকুই।
এখনও স্পষ্ট কানে শোনেন তিনি। খন্না সিনেমার পিছনে শ্যামচাঁদ মিত্র লেনের চিলতে পরিসরে শীতের রোদের মধ্যে অশ্রুত শব্দও তাঁর কানকে ফাঁকি দিতে পারে না।
ধবধবে গেঞ্জি-ধুতির ছিপছিপে নবতিপরকে ঘিরে শব্দেরই জগৎ। বাড়ির দোতলার ঘরের বারো আনা জুড়ে মান্ধাতার আমলের রেডিয়োর চোঙা কিংবা আদ্যিকালের বিদেশি সাউন্ড প্রোজেক্টর। যা হয়তো কেজি দরে কোনও লোহার দোকানে বিকিয়ে গিয়েছিল বা ঠাঁই পেয়েছিল কাবাড়িওয়ালার ঝুলিতে! মুমূর্ষু রোগীকে ফুটপাত থেকে তুলে নেওয়ার মতোই ঘরের মালিক তাঁদের কোল দিয়েছেন, আদরে সারিয়ে তুলে ফিরিয়ে দিচ্ছেন যৌবনের লাবণ্য।
তিনি সুশীল চট্টোপাধ্যায়। কাছের-দূরের চেনাজানারা এক ডাকে চেনেন, ‘নুকুবাবু’ বলে। বয়সকে তুড়ি-মারা বলিষ্ঠ স্বরে যিনি বলেন, ‘‘আমি ওদের দয়া করে তুলে আনিনি। আমার ভালবাসার টানে ওরাই এয়েছে, আমায় খুঁজে নিয়েছে।’’ এক অসমবয়সি বন্ধুর সদ্য এনে দেওয়া কচ্ছের যাযাবরদের উটের গলার ঘণ্টি থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের ব্রিটিশ মিলিটারির যুদ্ধক্ষেত্রের ‘মেসেজ রিসিভার’— সবার শব্দেই কাঁটা দেয় বৃদ্ধের গায়ে। স্ত্রী অসুস্থ, শয্যাশায়ী আজ পাঁচ বছর। কাউকে চিনতেই পারেন না তিনি। কিন্তু নুকুবাবুর গেরস্থালির এই অচেতন শব্দভাণ্ডার নাকি সমানে কথা বলে তাঁর সঙ্গে। এই বয়সেও সবাইকে নিজের হাতে ঝাড়পোঁছ করে তকতকে করে তোলেন। হাত থেকে ছোটখাটো কিছু পড়ে গেলে অনায়াসে নিচু হয়ে মাটিতে হাতড়ে খুঁজে আনেন। হাসেন, ‘‘এই তো বেশ কোমরের ব্যায়াম হয়ে গেল! ’’
আদি যুগ থেকে এখনও পর্যন্ত রেডিয়োর শরীরের যাবতীয় ‘ভাল্ভ’ রয়েছে নুকুবাবুর জিম্মায়। উনিশ শতকের ডোয়ার্কিন কোম্পানির ছাপ-মারা পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্রও। পিয়ানো বাজানোর সময়ে ‘বিট’ ঠিক করার মেট্রোনোম (তালবাদ্য)— তা-ও মিলবে। সে-যুগের ব্রিটিশ গোয়েন্দা-কাহিনির সিনেমায় যেমন দেখা যায়, অপরাধীদের চলাফেরার গোপন ছবির তথ্যপ্রমাণ খুঁটিয়ে দেখার জিবি বেল অ্যান্ড হাওয়েল কোম্পানির ভিডিয়ো রিল— এক পরিচিতের কাছ থেকে নুকুবাবু কিনেছিলেন ২২০০ টাকায়। ১৯২৬ সালের জনস্টন রেডিয়োর সঙ্গী মার্কনি ফোনের লাউডস্পিকারটি তো কাবাড়িওয়ালার থেকে জলের দরে ১২ টাকায় কেনা। সেই যন্ত্রকেও বাঁচিয়ে তুলেছেন নিজের হাতে। এদের সবার শব্দ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে শোনাই নুকুবাবুকে এখনও সচল রেখেছে।
শব্দের সঙ্গে এই ভালবাসাবাসি অবশ্য আশৈশব। ব্রিটিশ আমলের কলকাতায় বাবার ছিল রিয়েল এস্টেটের কারবার। ধলভূমগড়েও বাড়ি ছিল চাটুজ্যেদের। সিংভূমের সেই প্রকৃতির পাঠশালাতেই শব্দের জগৎ ধরা দিল বালকের কাছে। মেয়েদের গায়ে যেমন আলাদা-আলাদা ঘ্রাণ থাকে, হাওয়া চললে বাঁশঝাড়, বটগাছ বা শালবনের জটলাও আলাদা-আলাদা ভাষায় কথা বলে যায়। রাতের আঁধার চিরে দূর থেকে ভেসে আসে ঝিঁঝির স্বর আর সাঁওতাল মেয়েদের পাতা নাচের তালের দ্রিদিম দ্রিম!
ওই বয়সেই দাদার এনে দেওয়া সাবেক রেডিয়োগ্রাম যেন জীবন পালটে দিল। মাথায় ভূত চাপল, এক সঙ্গে রেডিয়ো চলে, রেকর্ড বাজে, এমন যন্ত্র নিজে তৈরি করতে হবে। মায়ের কাছে বায়না করে আদায় করা ২১ টাকা খরচে মাথা খাটিয়ে সে-স্বপ্ন সফল হল।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হচ্ছে। এর কিছু দিন বাদেই রেডিয়োয় গভীর রাতে জাপান থেকে নেতাজির বার্তা শোনার নেশায় মাতাল হয়ে ওঠা। ব্রিটিশ আমলে সেই নিষিদ্ধ স্বর শোনা চাট্টিখানি কথা ছিল না। পুলিশের ভয়ে জোরে শোনা যাবে না! আবার মর্স কোডে কারিকুরি করে সেই শব্দের পথে দেওয়াল তুলে ধরে ব্রিটিশ সরকার। গ্রে স্ট্রিটের ‘রাঙাদা’র পরামর্শে রেডিয়োর অ্যান্টেনায় বাড়তি ভাল্ভ বসিয়ে চুপিচুপি অবাধে সেই কণ্ঠস্বর শোনার বন্দোবস্ত করল নাছোড় কিশোর।
এর কিছু দিন বাদে পাড়ার হাঁদুদার ইলেকট্রোগ্রামের শব্দ শুনেও কান ভোঁ-ভোঁ করছে। এ কী করে সম্ভব, এ তো ঘরের মধ্যে আস্ত ব্যান্ডপার্টি! সে যুগে ৫৩০ টাকা জোগাড় করে টুকরোটাকরা কিনে চার বছরের চেষ্টায় সেই যন্ত্রও নিজের হাতে গড়ে দেখালেন শ্যামবাজারের ছেলে।
বিএসসি পাশের পরও সিনেমা-হলে অ্যাম্পলিফায়ার সারানো, শব্দপ্রযুক্তি বসানোর কাজেই ডুব দিয়েছিলেন শব্দপাগল! শব্দের থেকে তাঁকে আজও কেউ বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। তবে এ কালের ডিজিটাল শব্দে নুকুবাবুর মনে ভরে না। বড্ড বেশি নিখুঁত! কৃত্রিম। সাবেক যুগের শব্দের প্রাণটা নেই যেন!
৪০ বছর ধরে মিতাহারী মানুষটি শাক-চচ্চড়ি খেয়ে থাকেন। বাড়ির বাইরে এক কাপ চা-ও খান না। কিন্তু এখনও ভালবেসে হাতিবাগানে বাজার করেন, পুরনো কোনও যন্ত্রের খোঁজ পেলে টুকটুক করে বেরিয়ে পৌঁছে যান তার কাছে। ‘‘জীবনে পয়সা করা হল না ঠিকই! তবে ব্রহ্মাণ্ডের স্বাদ পেয়েছি শব্দে।’’
ঘর-ভর্তি পুরনো রেডিয়ো, প্রোজেক্টর, বাদ্যযন্ত্রের মিহি-কড়া স্বরের সঙ্গে পুরনো রেকর্ড ও কণ্ঠস্বরের সংগ্রহেও আস্ত একটা জাদুঘর রয়েছে নুকুবাবুর জিম্মায়। হিটলার-রুজভেল্ট-চার্চিল-নেতাজি থেকে রাইচাঁদ বড়াল— সকলের স্বরই সংরক্ষিত তাঁর কাছে।
ঝিম-ধরা দুপুরে ঘরভরা শব্দের রাজ্যপাটে গমগম করে মান্না দে-র কাকা ‘কানাকেষ্ট’র স্বর, ‘হরি চরণ মে সফল হো সব পূজা’! গত শতকের তিরিশের দশকে ‘বিদ্যাপতি’ ছবির গান শুনতে শুনতে আর এক সমর্পণের গল্প শোনান নুকুবাবু। ‘‘শুধু ভাবি, শব্দেরা দয়া করে মহাভাবের দরজা খুলে দিয়ে আমার জীবন ধন্য করেছে। জীবনপথের সব মানুষের বিষয়ে এমন ভাবা গেলে, কী দারুণ হত ভাবুন তো!’’