একসূত্রে: মুনসিগঞ্জের পুজোয় ঠাকুর গড়ছেন রাম পাল। সামনে রমনরাজ-জাহাঙ্গির-আলম-বলবন্তরা মিলেমিশে
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ। যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।
নিস্তব্ধ ঘরে ছড়িয়ে পড়ল স্তোত্রধ্বনি। মাথার ফেজ টুপি খুলে খানিক ক্ষণ চুপ করে রইলেন শেখ জাহাঙ্গির। আঠারো বছর বয়স থেকে নিজে দুর্গাপুজো করছেন। অনেক স্তোত্রই এক নিশ্বাসে বলে যেতে পারেন এখন। খিদিরপুরের মুসলিম-অধ্যুষিত এই মহল্লার সব থেকে বড় উৎসব দুর্গাপুজো। কয়েকটা দিন মোটে বাকি, এখন আর নিশ্বাস ফেলারও সময় নেই কারও। পেশার কারণে সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করে না এই পাড়া। এখন সকাল থেকেই ব্যস্ততা তুঙ্গে। নৈঃশব্দ্য ভেঙে জাহাঙ্গির বলেন ‘‘উনি যে আমাদের মা। আমাদের শক্তি। সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি দিনগুলোর জন্য।’’
সামনেই মহরম। তার প্রস্তুতিও চলছে সমান তালে। ক্লাবঘরের এক দিকে ডাঁই করা আছে মহরমের নানা সরঞ্জাম। তার পাশেই ঠাকুরের সাজ, মুকুট, টুকিটাকি। উলটো দিকে তৈরি হচ্ছে প্রতিমা। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জাহাঙ্গির বলেন, ‘‘মা আর খোদার মধ্যে তো কোনও বিরোধ নেই। আমরা কেন নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরি বলুন তো?’’ পাশেই বসে ছিলেন পাড়ার আর এক বাসিন্দা বলবন্ত সিংহ। জাহাঙ্গিরের হাতে আলতো চাপ দিয়ে বললেন, ‘‘মা কি কখনও সন্তানের মধ্যে ভেদ করেন? তিনি যতটা আমার, ততটাই জাহাঙ্গিরদা’র।’’
এ এক অন্য পুজোর গল্প। জাঁকজমকহীন, কিন্তু ঐশ্বর্যে ভরপুর। উজাড় করা ভালোবাসার গন্ধ মাখানো। খিদিরপুরের গলি, তস্য গলির মধ্যে মুনসিগঞ্জ। এক চিলতে মহল্লার প্রতিটি কোণে দারিদ্রের ছাপ। মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দু পরিবারও কিছু আছে। এলাকার অনেকটাই নিষিদ্ধ পল্লি। দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোগাড়েই হিমশিম। তাও অনাবিল আনন্দ ঝরে পড়ে। আধা-তৈরি প্যান্ডেলের বাঁশ ধরে ঝুলছে, হেসে কুটোপাটি হচ্ছে মলিন জামা পরা শিশুর দল। বকতে গিয়ে হেসে ফেলছে বড়রা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মায়ের আঁচলের তলায় বড় হয়েছে সবাই। বাবার নাম জানা নেই অনেকেরই, ধর্ম তো নয়ই। মায়ের ধর্মই এঁদের ধর্ম। এতটা ঔদার্য, হৃদয়ের প্রসারতা এঁরা পেলেন কোথা থেকে, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই, কিন্তু জন্মাবধি এ রকমই দেখে এসেছেন সবাই।
১৯৯২ সালে রাম মন্দির-বাবরি মসজিদ ইস্যুতে যখন পুড়ছে দেশ, পরম নির্ভরতায় ওঁরা আঁকড়ে থেকেছেন একে অন্যকে। শীতের নরম রোদ গায়ে মেখে শুনশান রাস্তায় চুটিয়ে ক্রিকেট খেলেছে বাচ্চা বড় সকলে। রাস্তায় টহলরত পুলিশ মুচকি হেসে ছুড়ে দিয়েছেন রাস্তার ও পারে চলে যাওয়া বল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ক্লাবঘরের টিভিতে ক্রিকেট দেখেছেন সবাই। খবরও দেখেছেন, জেনেছেন পুরো ঘটনা। পর দিন সকালে কোহিনুর বিবির মা রান্না করে দিয়ে এসেছেন অসুস্থ বলবন্ত সিংহের মা’র ঘরে এসে। নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে এসেছেন ছোট্ট বলবন্তকে।
এ সব তো সে দিনের কথা। এই পুজো শুরু হয়েছে তারও অনেক বছর আগে। জাহাঙ্গিরের আগে এই পুজো করতেন তাঁর মামা। তারও আগে তাঁর নানা। পুজোর প্রতিটি বিধি নিষ্ঠা ভরে পালন করা হয়েছে বরাবর। শুভ দিন দেখে খুঁটিপুজো করেছেন জাহাঙ্গির। সাবেক নিয়ম মেনে প্রতিমার চক্ষুদান করবেন শিল্পী রাম পাল। পুজোর দিন সকালে উপবাস করে গঙ্গায় যান, নবপত্রিকা স্নান করিয়ে আনেন আলম, জাহাঙ্গিররা। প্রতি দিনই পুরোহিতের সঙ্গে দেবীর পায়ের কাছে বসে বিধিমতে পুজো করেন জাহাঙ্গির। অষ্টমী পুজোর দিন অঞ্জলি থেকে কুমড়ো বলি, ভোগ তৈরি, সবই করেন সবাই মিলে। দশমীর দিন কোহিনুর বিবি, সুরাইয়া বেগমরা ঠাকুরের মুখে পান-মিষ্টি দিয়ে বরণ করেন। সরস্বতী ঠাকুরের পায়ে ছোঁয়ান ছেলের বই। বিসর্জনের দিন অন্ধকার গঙ্গায় তলিয়ে যাওয়া ঠাকুরের মুখ প্রতি বার চোখ ভিজিয়ে দেয় জাহাঙ্গির আর রমনরাজদের। মনে মনে বলেন, আবার এসো মা। মেয়েরা গঙ্গার ঘাট থেকে চলে যান সোজা কালীঘাট। সেখানে পুজো সেরে বাড়ি ফেরেন। লক্ষ্মীপুজো হয় ঘরে ঘরে। কোজাগরীর রাতে বৃদ্ধ সুরাইয়া বেগম অশক্ত কাঁপা হাতে ভাঙা দরজার বাইরে লক্ষ্মীঠাকুরের পায়ের ছাপ এঁকে শাঁখে ফুঁ দেন।
দুর্গা পুজোর সঙ্গে সঙ্গে চলে মহরম উদ্যাপনও। গত কয়েক বছর ধরেই দুর্গাপুজোর গায়ে গায়েই মহরম আসছে। অষ্টমীর ভোগের মতোই, মহরমের সময় তৈরি হয় খিচড়া। সবাই মিলে রান্না করার পর খিচড়ার পাত্র এনে রাখা হয় দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে। ছোট ছোট হাঁড়িতে ভাগ করে দেন বলবন্ত। বিলি করেন জাহাঙ্গির। মহরমের চাঁদোয়া এসে দাঁড়ায় প্যান্ডেলের সামনে। সম্ভ্রম আর শ্রদ্ধায় একে অপরকে জায়গা করে দেন। এক বার মহল্লার বাইরে থেকে কিছু লোক এসে তাজিয়া যাওয়ার জায়গা নিয়ে ঝামেলা করেছিল। রুখে দাঁড়িয়েছিলেন জাহাঙ্গির। তাঁর ‘দেবী মা’-এর গায়ে আঁচটুকুও লাগতে দেননি। শুধু হিন্দু উৎসবগুলিই নয়, সব মুসলিম পরবও মুঠো-ভর্তি খুশি ছড়িয়ে দেয় মুনসিগঞ্জের হাওয়ায়। জাহাঙ্গিরদের সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ রায়, প্রমথ সাউ, বলবন্ত সিংহ এর মতো আরও অনেকে রোজা রাখেন।
মুনসিগঞ্জের ফাইভ স্টার ক্লাবের পুজোর বয়স প্রায় আশি বছর। তাক লাগিয়ে দেওয়া মণ্ডপ, স্পনসর ধরার ছুটোছুটি, থিমের চমক, প্রথম হওয়ার দৌড়— কিছুই নেই। বাজেট মাত্র এক থেকে দেড় লাখ টাকা। সেটা জোগাড় করতেই হিমশিম খেয়ে যান উদ্যোক্তারা। এ বার তো বন্ধই হয়ে যেতে বসেছিল পুজো। এত আশার, ভালবাসার পুজো বন্ধ হয়ে যাবে? সাহায্যের আশায় দোরে দোরে ঘুরেছে সারা মহল্লা। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় কিছু হিন্দু যুবক আপ্রাণ চেষ্টায় বেশির ভাগ টাকাটাই জোগাড় করে দিয়েছেন। কথা বলতে বলতে নামাজ পড়ার সময় হয়ে গিয়েছে। উঠে গেলেন জাহাঙ্গির। প্রতি দিন নিয়ম করে নামাজ পড়েন। আজ পর্যন্ত অন্যথা হয়নি।
শরতের মায়া আকাশ। আলোর চাদরে মোড়া রাত। ধূপধুনো নৈবেদ্যের পবিত্র গন্ধ। পুজো বা মহরম এখানে শুধুই উৎসব নয়। হাতে হাত ধরে রাখার অঙ্গীকারও বটে। মুনসিগঞ্জের জাহাঙ্গির আর বলবন্তরা জানেন, এতেই তাঁদের মঙ্গল। সবার কল্যাণ।