ধর্মতলা স্ট্রিট’-এর ওপর পুরনো আমলের বাড়ি। আদ্যিকালের হাতে চালানো ‘ওটিস’ লিফটে চড়ে তিন তলায়। বিরাট ফ্ল্যাট। উঁচু সিলিং, বড় জানলা। কাচের শার্সি আর কাঠের খড়খড়ি পাল্লা খুললেই, রাস্তার ও পারে সেক্রেড হার্ট গির্জার ঘড়িঘর। তবু বাড়িতে একাধিক ঘড়ি। কাঠের তৈরি বেঁটে ফরাসি চাইমিং ক্লক, পালিশ করা পেতলের ডায়ালের ঢাউস দেওয়ালঘড়ি, কালো কষ্টিপাথরে ব্রোঞ্জের ডায়াল বসানো ম্যান্টল ক্লক। ‘‘পার্সিদের একটু ঘড়ির বাতিক আছে। দে হ্যাভ দিস ‘টিং’ ফর ক্লকস্, ইউ নো!’’ মুচকি হাসলেন নভাজ গারদা।
আরও পড়ুন: শিক্ষার স্বাধিকার বজায় রেখেই তিনি শহিদ
নভাজের হাতে যদিও সময় নেই। সকাল এগারোটা। লেসের ঢাকা দেওয়া আবলুস কাঠের বিরাট ডাইনিং টেবিলে নানা মাপের টিফিনকৌটো। নিয়ে যেতে হবে সেই সব পার্সি বুড়োবুড়িদের কাছে, যাঁদের দেখাশোনার কেউ নেই। কেউ নিঃসন্তান, কারও ছেলে–মেয়ে প্রবাসী। উনিশ শতকের কলকাতায় এক লক্ষ পার্সির বাস ছিল। এখন মাত্র শ’দেড়েক পরিবার, সদস্য সংখ্যা ৪৩৩। ৬০ শতাংশেরই বয়স সত্তরের ওপরে। অনেকেই অসুস্থ। প্রতি দিন এঁদের খাবার পৌঁছে দেন নভাজের মতো কয়েক জন। এই প্রবীণ পার্সিরা অনেকেই একই বাড়িতে, পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকেন। ৮৪ লেনিন সরণির ‘ম্যাডান ম্যানসন’–এ আছে এ রকম ২৫টা ফ্ল্যাট, ৬ গ্র্যান্ট লেনে আরও ১০টা। এগুলোর মালিক কলকাতার পার্সি ট্রাস্ট। ১৮৬৬ সালে, এজরা স্ট্রিটের আদি অগ্নি–মন্দিরে বসে যে ট্রাস্টের পত্তন করেন কলকাতার তিন পার্সি ব্যবসায়ী— মানেকজি রুস্তমজি, কাওয়াসজি পেস্টনজি এবং নওরোজি পেস্টনজি ডালা। চাঁদা তুলে সেই আমলে ১২,২৯৭ টাকার তহবিল তৈরি হয়েছিল।
প্রবীণদের আদর–যত্নে রাখার এই সামাজিক প্রকল্প ওই পার্সি ট্রাস্ট এবং স্বেচ্ছাশ্রমের ভরসায়। নভাজ গারদা চাকরি করতেন ডাচ বিমানসংস্থা কেএলএম–এ। স্বেচ্ছা-অবসর নিয়ে এখন ব্যস্ত সমাজসেবায়। আরও কয়েক জন আছেন সঙ্গে। শুধু খাবার পৌঁছনোই নয়। কেউ হয়তো ব্যাঙ্কে যাবেন, কারও ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট। সঙ্গে যান ‘কেয়ার গিভার’রা। রাতবিরেতে হাসপাতাল যেতে, ডাকলেই গাড়ি নিয়ে হাজির দুই তরুণ স্বেচ্ছাসেবী। এ ছাড়া আছে ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সিনেমা–থিয়েটার, কখনও বেড়াতে যাওয়া। বা উইকএন্ডে ময়দানের পার্সি ক্লাব। তার জন্যে আলাদা বাস আছে। বাড়ি থেকে নিয়ে আসে, পৌঁছে দিয়ে যায়। তার দায়িত্বে কেসি এঞ্জিনিয়ার। ছোটখাটো, হাসিখুশি মানুষ। মার্চেন্ট নেভির ক্যাপ্টেন ছিলেন। কেসি যে বাড়িতে থাকেন, সেই ২৬ লেনিন সরণির ‘পার্সি ম্যানসন’–এও কয়েক ঘর বয়স্ক পার্সি মানুষের বাস। সন্তানতুল্য কেসি এখন তাঁদের অভিভাবক।
কেসি বিয়ে করেননি। তাঁরও দু’বেলার খাবার আসে কিড স্ট্রিটে কলকাতার একমাত্র পার্সি রেস্তোরাঁ মাঞ্চেরজি’স থেকে। মজার কথা, এটি চালান এক বাঙালি। সুপ্রিয়া। জন্মসূত্রে পূর্ববঙ্গের। মায়ের থেকে ইলিশ পাতুরি যেমন শিখেছেন, শাশুড়ির থেকেও শিখেছেন ‘পত্রানি মচ্ছি’। এক ধরনের রান্না, তবে রেসিপি আলাদা। মশলা আসে পুণের এক দোকান থেকে। এই পদটি রোজ না হলেও ‘ধানশাক’ রোজ পাওয়া যায়। চিকেন অথবা মাটন ধানশাক। অফিসপাড়ায় রোজ ১২০০ খাবারের প্যাকেট যায় মাঞ্চেরজি’স থেকে। আগাম অর্ডারে ‘প্রন পোলাও’, বা পার্সি বিয়েবাড়ির শেষপাতের ‘লগান নু কাস্টার্ড’ও। নামগুলো গুজরাতি। ইরান থেকে ছিন্নমূল পার্সিরা ভারতে প্রথম এসে পা রাখেন গুজরাতের নভসারি–তে। সেই থেকে গুজরাতিই ওঁদের ভাষা। নভসারিতেই এখনও সযত্নে রক্ষিত পার্সিদের পবিত্র আগুন। কলকাতার মেটকাফ স্ট্রিটের অগ্নি–মন্দিরের আগুন নভসারি থেকেই এসেছিল। হাতে ধরে, ৭৩ দিন ধরে পায়ে হেঁটে। সেই আগুনের সঙ্গে কাঠের ছোঁয়া লাগা বারণ বলে, কাঠের তক্তা ফেলা হাওড়ার ভাসমান পন্টুন ব্রিজ পেরনো হয়েছিল লোহার খড়ম পরে।
মাঞ্চেরজি সুপ্রিয়ার শ্বশুরের আদত পদবি নয়। শ্বশুরমশাইয়ের বাবার নাম। চেয়ার–টেবিলের ব্যবসা করতেন, তাই মাঞ্চেরজি কুর্সিওয়ালা। পার্সিদের ও রকম নাম হত। যিনি খালি শিশি–বোতলের ব্যবসা করেন, তিনি বাটলিওয়ালা। তেমনই দারুওয়ালা, মোটরওয়ালা! যার নিবাস যেখানে, সেই নামেও পদবি হত। পুণেওয়ালা, বম্বেওয়ালা। নভরোজি সোরাবজি উমরিগর খুব বড় ব্যবসায়ী ছিলেন কলকাতায়। তিনি বাঙালি সমাজের জন্য এত কিছু করেছিলেন, যে তাঁর ছেলেদের পদবিই উমরিগর থেকে ‘বাঙ্গালি’ হয়ে গিয়েছিল! তাঁর নাতি সোরাবজি শাপুরজি বাঙ্গালি বম্বেতে (মুম্বই) শিক্ষাব্রতী হিসেবে নাম করেছিলেন। আর নভরোজি ১৮২২ সালে ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে বেলেঘাটায় বানিয়েছিলেন কলকাতায় পার্সিদের একমাত্র ‘ডোকমা’। মৃতদেহ সৎকারের জায়গা। ইংরেজিতে ‘টাওয়ার অব সাইলেন্স’। এখনও বহাল। চৌহদ্দির মধ্যে ঢোকা গেলেও উঁচু কুয়োর আকৃতির মূল জায়গাটিতে যাওয়া যায় না। পার্সিদেরও অনুমতি নেই, যদি সঙ্গে মৃতদেহ না থাকে। ময়দানে পার্সি ক্লাবের তাঁবুর সামনে বসে বলছিলেন জিমি বিলিমোরিয়া। পার্সি অগ্নি–মন্দিরের অন্যতম ট্রাস্টি। ক্লাবের মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে পার্সিরা। অধিকাংশই বয়স্ক।
প্রতিবেশী: কলকাতা শহরের চার পার্সি পুরোহিত। ছবি: লেখক
এঁরা কেউ যখন মারা যাবেন, ওখানেই...? বিলিমোরিয়া মাথা নাড়লেন। কিন্তু কলকাতায় এখন শকুন কোথায়? ওখানে তো রেখে আসা হয়, যাতে চিল–শকুন মৃতদেহ ছিঁড়ে খেতে পারে! ‘‘সেই কারণেই ডোকমায় সোলার প্যানেল বসেছে। প্রচণ্ড উত্তাপে যাতে দেহগুলো পুড়ে যায়। তবে সময় বদলাচ্ছে। মুম্বই, সুরাতে এখন অনেক পরিবারই ইলেকট্রিক চুল্লিতে দাহ করে। কলকাতাতেও হয়তো এক দিন শুরু হবে,’’ জানালেন বিলিমোরিয়া।
তবে এমন অন্ত্যেষ্টি শাস্ত্রসম্মত কি না, সেই নিয়ে মতবিরোধ আছে। যেমন, পার্সি ছেলেরা সমাজের বাইরের কোনও মেয়েকে বিয়ে করলে, তাদের ছেলেমেয়েরা জরথ্রুস্ত্রীয় পার্সি হিসেবে স্বীকৃত হয়, অগ্নি–উপাসনার অধিকার পায়। তার জন্য, ৭ থেকে ৯ বছর বয়সের মধ্যে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে ‘নভজোত’ হয়। ব্রাহ্মণদের পইতের মতো কয়েক ছড়া সুতো কোমরে পরিয়ে দেওয়া, ঊর্ধ্বাঙ্গে বিশেষ কাপড়ের অন্তর্বাস। পার্সিত্বের চিহ্ন। কিন্তু বিবাদ বেধেছে যে পার্সি মেয়েরা সমাজেই বাইরে বিয়ে করছেন, তাঁদের সন্তানদের নিয়ে। এখন যদিও তাদেরও নভজোত হচ্ছে, কিন্তু অগ্নি-উপাসনার অধিকার তাদের নেই। তারা অগ্নি–মন্দিরে ঢুকতে পারে না। বিষয়টা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
অথচ ধর্মীয় অনুশাসনের দিক দিয়ে পার্সি সমাজ বেশ মুক্ত, উদার। কলকাতার অগ্নি–মন্দিরের চার পুরোহিতের এক জন, ৪৪ বছরের এরভার্ড জিমি তারাপোরওয়ালা। ২০ বছর বয়সে পরীক্ষা দিয়ে পুরোহিত হয়েছিলেন মূলত মায়ের ইচ্ছেয়। মায়ের বাবা পুরোহিত ছিলেন। কিন্তু জিমির বাবা ছিলেন ব্যাঙ্কার। ভাই সফ্টওয়্যার এঞ্জিনিয়ার।
পুরোহিতদের দ্বিতীয় কোনও পেশা নেই? ‘‘না। পবিত্র আগুনের খেয়াল রাখা ৭ দিন, ২৪ ঘণ্টার কাজ। ছোট বাচ্চার ওপর যে ভাবে নজর রাখতে হয়।’’ আর নিজের বাচ্চাকাচ্চা? ‘‘থাকে। পার্সি পুরোহিতদের বিয়ে–সন্তানে কোনও নিষেধ নেই। স্বাভাবিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও কোনও কিছু বারণ নয়। ধর্ম আলোচনা বা উপদেশ দেওয়ার জন্য বড় পুরোহিতরা আছেন। আমরা ব্যবহারিক প্রয়োজনের পুরোহিত,’’ বোঝালেন জিমি। ‘‘নভজোতের প্রথাগুলো কী ভাবে মানতে হবে, বলে দিই। কেউ মারা গেলে পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মে সাহায্য করি। আর আছে ‘জশন’। শান্তি–স্বস্ত্যয়ন। বছরের শেষ ১০ দিন পার্সিরা সমবেত প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে পালন করেন। তার পর আসে নভরোজ। পার্সিদের নববর্ষ। সেটা অগস্টের মাঝামাঝি। এর বাইরে ধর্মাচরণের বাধ্যবাধকতা নেই। পার্সিদের জীবনদর্শন বরং খুব সোজাসাপটা। খাওদাও, ভাল থাকো। একা নয়, সবাইকে নিয়ে।’’
‘‘আসলে পার্সিদের সম্পর্কে বাইরের লোকের ধারণাটা সব সময় ঠিক নয়,’’ বলছিলেন নুমি মেটা। বিজ্ঞাপন সংস্থা ‘সেলভেল’–এর বর্তমান কর্ণধার। ‘‘এই যে ডোকমায় মৃতদেহ রেখে আসা, বা অগ্নি–উপাসনা— এগুলো থেকে লোকে পার্সিদের রক্ষণশীল ভাবে। কিন্তু শুধু আগুন নয়, প্রকৃতির সব শক্তিকেই পার্সিরা সম্মান করে। আর পার্সি সমাজে মেয়েরা বরাবর পুরুষদের সমান, অনেক সময় পুরুষদের থেকে এগিয়ে। পেশাগত ক্ষেত্রেও পার্সিরা অনেক দূর এগিয়েছে। দেশের সেরা ডাক্তার, আইনজীবী, চার্টার্ডদের অনেকেই পার্সি।’’
তা হলে পার্সিদের নবীন প্রজন্ম কলকাতায় থাকল না কেন? হাসলেন নুমি। ‘‘আমাদের যে ছেলেমেয়েরা অন্য শহরে বা বিদেশে চলে গেছে, ডাকলে হয়তো তারা ফিরে আসবে। কিন্তু কী বলে ডাকব? সুযোগ কোথায়? ব্যবসাও তো সুযোগসন্ধানী। সুযোগ না থাকলে ব্যবসা হবে?’’
নববর্ষে: মেটকাফ স্ট্রিটের অগ্নিমন্দির প্রাঙ্গণে হাসিঠাট্টা, আড্ডা ও উপহার বিনিময়ে মশগুল কলকাতার পার্সি দুনিয়া। আছে ভূরিভোজেরও আয়োজন। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
দেশের বাণিজ্যিক ভরকেন্দ্র যখন কলকাতা থেকে বম্বে সরে গেল, পার্সিরা অনেকেই শহর ছেড়েছিলেন। তবে বড় ধাক্কাটা এল ১৯৭০–’৮০–এর দশকে। ইউনিয়নবাজি, ঘেরাও আর ধর্মঘটের ঠেলায় উঠে গেল বহু ব্যবসা। প্রায় সব বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কলকাতা থেকে সদর দফতর সরিয়ে নিল। পার্সি ব্যবসায়ীরাও শহর ছাড়লেন।
কলকাতার প্রথম পার্সি ব্যবসায়ী দাদাভাই বেহরামজি বানাজি। ১৭৬৭ সালে এসেছিলেন সুরাত থেকে। পশ্চিম ভারতের ওই বন্দর শহরেই প্রথম পার্সি কলোনির পত্তন। সেখানকার ব্রিটিশ প্রশাসক জন টার্নার বানাজির নামে প্রশস্তিপত্র লিখে দেন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নরকে। দু’বছর পর টার্নার নিজেই বাংলার গভর্নর হয়ে এলেন। ফুলেফেঁপে উঠল বানাজির ব্যবসা। উৎসাহিত আরও কয়েক জন চলে এলেন কলকাতায়। ১৮১২ সালে এলেন দাদাভাইয়ের এক আত্মীয় রুস্তমজি কাওয়াসজি বানাজি। তিনি উদ্যমী পুরুষ। কলকাতা বন্দর থেকে চিনের সঙ্গে আফিম ব্যবসায় আটকে না থেকে, টার্নার নামে এক সাহেবের সঙ্গে ‘রুস্তমজি টার্নার অ্যান্ড কোম্পানি’ বানিয়ে খিদিরপুর ডকটাই কিনে নিলেন। শুরু করলেন বিমার ব্যবসা, কাগজ আর সুতোর কল। ২৭টা জাহাজ ছিল রুস্তমজির, ভাড়া খাটত ব্রিটিশদের কাছে। দু’হাতে দানধ্যান করতেন। গরিবের জন্যে বাড়ি, রাস্তাঘাট, নিকাশি নালা, ফেরি সার্ভিস। মেয়ো হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, পশু হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ‘রুস্তমজি বাবু’, ভালবেসে ডাকত বাঙালিরা। যেখানে তিনি থাকতেন, সে জায়গার নামই হয়ে গেল পার্সিবাগান।
বিশ শতকের শুরু, কলকাতার পার্সিদের বড় সুখের সময়। ১৯০১ সালে বম্বে থেকে এসে, গড়ের মাঠে তাঁবু খাটিয়ে ‘বায়োস্কোপ’ দেখিয়ে মাত করে দিয়েছেন জামশেদজি ফ্রেমজি ম্যাডান। চালু করেছেন ‘করিন্থিয়ান থিয়েটার’। সেখানেও সিনেমা হয়। পাশাপাশি নাটক করেন পার্সিরা। ১৯০৭ সালে তৈরি হয়েছে পার্সি অ্যামেচার ড্রামাটিক্স ক্লাব। সম্ভ্রান্ত ঘরের পার্সি মহিলারা অভিনয় করেন। বিনা টিকিটে দেখা যায় নাটক। ইন্টারভ্যালে নিখরচায় ‘ভিমটো’ আইসক্রিম-সোডা বিলি করে এডুলজি শাপুরজি ওলপাডওয়ালা–র ‘বায়রন’ কোল্ড ড্রিংক কোম্পানি। দিলদরিয়া লোক। কলকাতায় পার্সি ট্রাস্টের দফতর এখন যে বাড়িতে, সেই ৫২ চৌরঙ্গিতেই ছিল তাঁর বিশাল বাংলো। দান করেছিলেন ট্রাস্টকে। মৃত্যুর পর জানা যায়, শেষ জীবনে কপর্দকশূন্য ছিলেন এডুলজি। বাজারের টাকাও থাকত না। কিছু দিন পর পরই কোনও অ্যান্টিক বিক্রি করে দিতেন। বায়রন কোম্পানি আগেই উঠে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কলকাতায় মার্কিন সৈন্যরা সঙ্গে এনেছিল কোক আর পেপসি। লড়াই হেরেছিল দিশি ভিমটো।
‘‘আসলে সময়ের সঙ্গে বদলাতে পারা ব্যবসায় টিকে থাকার অন্যতম শর্ত। বায়রন কোম্পানির অত বড় ব্যবসা, কিন্তু কোক–পেপসির সঙ্গে পাল্লা দিতে নিজেদের পণ্যের স্বাদবদল করেনি। আমার পূর্বপুরুষ জামশেদজি ফ্রেমজি ম্যাডান যেমন। এক সময় ১২৭টা সিনেমাহলের চেন, দেশের অর্ধেক বক্স অফিসের কর্তৃত্ব ছিল ম্যাডান থিয়েটার্সের হাতে। কিন্তু তার প্রযুক্তি, পরিকাঠামো, সবই নির্বাক ছবি-কেন্দ্রিক। ‘টকি’ আসার পর নতুন বিনিয়োগের দরকার ছিল, করেননি,’’ বলছিলেন সাইরাস জে ম্যাডান।
যদিও ১৯৩১ সালে প্রথম বাংলা টকি ‘জামাইষষ্ঠী’ ম্যাডান থিয়েটার্সেরই প্রযোজনা। যেমন ১৯১৯ সালে প্রথম বাংলা নির্বাক ছবি ‘বিল্বমঙ্গল’। কিন্তু ১৯৩৭ সালের পর সিনেমার ব্যবসা থেকে সরে যান ম্যাডানরা। চলে যান বিলিতি মদের পাইকারি কারবারে। এক সময় কলকাতার যে ব্যবসার বড় অংশই ছিল পার্সিদের।
তবে সুরা নয়, আফিম ব্যবসার সঙ্গে পার্সিদের যোগাযোগটা ঐতিহাসিক। অমিতাভ ঘোষের ‘রিভার অব স্মোক’ উপন্যাসে আছে, বম্বের মিস্ত্রি পরিবারে জামাই হয়ে আসা নভসারি–র বেহরাম মোদি শ্বশুরমশাইকে জোরাজুরি করছেন চিনের সঙ্গে আফিম ব্যবসার অনুমতি দিতে। বম্বে প্রেসিডেন্সিতে তখনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিপত্তি কম, যতটা বেশি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে। কলকাতায় দ্বারকানাথ ঠাকুর নামে কোম্পানির এক এজেন্ট আফিম ব্যবসা শুরু করেছিলেন, সুবিধে করতে পারেননি।
এ দিকে ব্রিটিশদের চায়ের নেশা ভালমত ধরে গেছে। সেই চা আমদানি হচ্ছে চিন থেকে। চা আর চিনা সিল্ক। কিন্তু রপ্তানির কিছু নেই। ব্রিটেনের উল, বা মেশিনে বোনা সুতির কাপড়ে চিনের অনাসক্তি। প্রতি মাসে খালি জাহাজ গিয়ে ভিড়ছে ক্যান্টন বন্দরে। কাজেই চিনাদের আফিম ধরাতে না পারলে মহারানির কোম্পানির লোকসান হয়ে যাচ্ছে। যে পালতোলা জাহাজে চা-পাতা বোঝাই হয়ে আসে, সেই ক্লিপার শিপ–ও তৈরি করে সুরাতের ওলন্দাজরা। তাদের শাগরেদ আরমানি আর পার্সিরাও জাহাজ তৈরিতে দক্ষ। চড়া দামে সেই জাহাজ কিনতে হয় কোম্পানিকে।
ধুরন্ধর ব্রিটিশ ভারত থেকে ওলন্দাজদের খেদিয়ে দিলেও সঙ্গে রেখে দিল আরমানি আর পার্সিদের। ১৭৩৬ সালে জাহাজ তৈরির বিরাট ব্যবসা ফেঁদে বসল সুরাতের ওয়াদিয়া পরিবার। সে বছরই কোম্পানি বম্বে জাহাজঘাটা তৈরির বরাত দিচ্ছে লভজি নুসেরওয়ানজি ওয়াদিয়া-কে, আজকের নুসলি আর নেস ওয়াদিয়ার পূর্বপুরুষ। পরের ১০০ বছরে যেমন ইংলন্ডেশ্বরীর উপার্জন বাড়ছে, তেমনই বাড়বাড়ন্ত পার্সিদের। অনেকেই গুজরাত ছেড়ে বম্বে চলে আসছেন। পার্সিদের টাকাতেই গড়ে উঠছে বম্বে শহর। এ দিকে কলকাতাতেও পার্সি বদান্যতায় তৈরি হচ্ছে রাস্তাঘাট, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল।
কলকাতার পার্সি ক্লাব। ১৯০৮ সালে পত্তন। সেখানে দেখা হল প্রোচি মেহতার সঙ্গে। পরনে দৌড়ের পোশাক, স্নিকার্স। প্রোচি নুমি মেহতার স্ত্রী এবং সেলভেল–এর অংশীদার। ১৯৪৫ সালে প্রোচির বাবা রুশি বি গিমি–ই তিন বন্ধুকে নিয়ে সেলভেল শুরু করেছিলেন। প্রোচি হকি, বাস্কেটবল খেলেছেন রাজ্য পর্যায়ে। অ্যাথলেটিক্সে এসেছেন দেরিতে, মেয়েরা একটু বড় হওয়ার পর। জাতীয়, আন্তর্জাতিক স্তরে পঁয়ত্রিশ–ঊর্ধ্বদের প্রতিযোগিতায় সোনা জেতার অভ্যেস করে ফেলেছিলেন। ৩৫–৩৯ এবং ৪০–৪৫ বছরের বিভাগে ১০০, ২০০ আর ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে তাঁর রেকর্ড এখনও অধরা। এখনও যান কম্পিটিশনে? ‘‘মাঝে কয়েকটা বছর যাইনি, তবে প্র্যাক্টিস চালু রেখেছি। এখন নাতিরা একটু বড় হয়ে গেছে, আবার যাব ভাবছি।’’ বললেন প্রোচি।
পার্সি ক্লাবেই দেখা হল ইয়াসমিন কাপাডিয়ার সঙ্গে। সুন্দরী ছিলেন, শখের মডেলিংও করেছেন। বিয়ে করেননি মধ্য–সত্তরের ইয়াসমিন। নিজের থেকেও বাবার কথা বলতে বেশি আগ্রহী। বাবা জেহানবক্স কাপাডিয়া ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের করদ রাজ্য জামনগরের রাজার ব্যক্তিগত বিমানের ওয়্যারলেস রেডিয়ো অপারেটর। ৭৮ বছরের তরতাজা বয়সে অ্যাথলেটিক্সে আগ্রহী হন জেহানবক্স। পরের ১৩ বছর প্রবীণদের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়, ভেটেরান্স অলিম্পিকে সোনা, রুপো, ব্রোঞ্জ জিতেছেন দাপটে। শেষ করেছেন ডারবানে, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে তিনটে রুপো জিতে, মাত্র ৯১ বছর বয়সে!
বেঁচে থাকার অদম্য আগুনকে এখনও জ্বালিয়ে রেখেছেন এই শহরের পার্সিরা।