নতুন বাঙালি

বাংলা ভাষা নয়, বরং হিন্দিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। নিজেদের ভাষা, রাজ্য নিয়ে তারা আত্মবিশ্বাস হারিয়েছে। মল কালচার, স্মার্টফোন, ফেসবুক-টুইটারপ্রেমী, বর্ষশেষের রাতে উল্লাসমুখর এই প্রজন্ম নিজেদের রোজগার ও বিনোদনের ব্যবস্থা নিজেরাই করে, বঞ্চনা এখন আউট অব ফ্যাশন। বাংলা ভাষা নয়, বরং হিন্দিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। নিজেদের ভাষা, রাজ্য নিয়ে তারা আত্মবিশ্বাস হারিয়েছে। মল কালচার, স্মার্টফোন, ফেসবুক-টুইটারপ্রেমী, বর্ষশেষের রাতে উল্লাসমুখর এই প্রজন্ম নিজেদের রোজগার ও বিনোদনের ব্যবস্থা নিজেরাই করে, বঞ্চনা এখন আউট অব ফ্যাশন।

Advertisement

জহর সরকার

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

প্রতীকী ছবি।

একটা জিনিস খেয়াল করে দেখেছেন? আজকাল কোনও কল সেন্টার থেকে আপনাকে ফোন করে কেউ একটা মোবাইল কানেকশন নেওয়ার জন্য যখন ঝোলাঝুলি করেন, সাধারণত প্রায় পুরো সময়টাই তিনি হিন্দিতে কথা বলেন। যিনি ফোন করেছেন তাঁর উচ্চারণ শুনে আপনি বুঝতে পারবেন যে ছেলেটি বা মেয়েটি বাঙালি, তাঁর হিন্দিতে বাংলা টানটাও বেশ টের পাবেন আপনি, কিন্তু কথাবার্তা হিন্দিতেই চলবে। সুইগি বা মিন্ট্রাকে ফোন করার সময়, ব্যাঙ্কে বা বড় বড় মল-এ, অ্যাপ ক্যাব-এর চালকদের সঙ্গে, বস্তুত প্রায় সর্বদা এবং সর্বত্রই আমরা আজকাল হিন্দিতে কথা বলি। হিন্দি বলায় চোস্ত হয়ে উঠতে না পারলে আজকাল খুব মুশকিল। আমাদের তরুণ প্রজন্ম নিজেদের মধ্যে বাংলা-ইংরেজি-হিন্দির একটা মিশেলে কথাবার্তা বলে। প্রথম দুটো ভাষায় কথা বলাটা পুরনো ব্যাপার হলেও, হিন্দির ব্যবহার এখন যে পরিমাণে বেড়েছে, তা লক্ষণীয়। হিন্দি ভাষায় বেশ স্বচ্ছন্দে কথা বলে বাঙালি ছেলেমেয়েরা, তাতে যদিও একটা স্পষ্ট বাংলা টান থাকে, যে টানটা অবাঙালিরা শুনে ভালই ধরতে পারেন। এরা যখন গান গায়, বেশির ভাগ সময় এটা প্রায় অবধারিত যে সেটা হিন্দি গান হবে। অনেক বাঙালি ছেলেমেয়ে তো জানেই না যে, ‘ইয়ে শাম মস্তানি’, ‘তুম বিন যাউঁ কহাঁ’ কিংবা ‘কহিঁ দূর যব দিন ঢল যায়ে’— সবই আসলে বাংলা গানের হিন্দি রূপ। ভুলে যাওয়া বিচিত্র নয়, কারণ হিন্দি সিনেমা এখন আর বাংলা সিনেমাকে অনুসরণ করে না, আমরাই বরং বলিউডের মতো, কিন্তু তার চেয়ে নিম্নমানের সিনেমা বানাই, যেখানে, ‘মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে’-র মতো ডায়ালগ থাকে। এমনকী মধ্যবয়স্করাও এখন কোনও পার্টিতে গিয়ে যখন গানবাজনা করেন, তাঁরা সচরাচর পুরনো হিন্দি সিনেমার জনপ্রিয় গানগুলিই গেয়ে থাকেন। আগে এ সব জায়গায় রবীন্দ্রসঙ্গীতই বেশি গাওয়া হত। এমন কিন্তু নয় যে, কোনও হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী বসে বসে ছক করছেন— কী করে বাঙালিদের হিন্দির দাস বানানো যায়। বরং আমরাই উৎসাহী হয়ে নিজেদের উদ্যোগে বিয়ের আগে হিন্দি-স্টাইলে ‘সঙ্গীত’ আয়োজন করছি। এমনকী বিভিন্ন আবাসনে আজকাল মহিলারা একসঙ্গে মিলে ‘করবা চৌথ’ উদ‌্‌যাপন করেন। এটা স্বীকার করতেই হবে যে আমরা স্বেচ্ছায়, কিংবা হয়তো সুবিধের তাগিদেই, অথবা ‘সংস্কৃতিমান বাঙালি’ হয়ে ওঠার মধ্যে আর কোনও গৌরব খুঁজে পাই না বলেই, হিন্দি-সংস্কৃতিকে বরণ করে নিয়েছি। বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের অনেকেরই আত্মবিশ্বাস হারিয়ে গেছে। এর সব দোষই বিশ্বায়নের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। যদি বিশ্বায়নই এর কারণ হত, তা হলে ইংরেজির একাধিপত্য থাকত। এবং এই ব্যাপারটা ঠিক আজকেরও নয়, এর শুরু অনেক আগেই। সেই আশির দশকেই ‘অপসংস্কৃতি’র সমস্ত অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়ে সিপিএম নেতা ও মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী ‘হোপ ৮৬’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। পরে তিনি কুমার শানুকে দিয়ে রাজ্যের গ্রামেগঞ্জে গান গাইয়েছিলেন, তা ভোলার নয়।

Advertisement

একটা কথা মনে রাখা দরকার। ভাষা কেবলমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নয়, ভাষা হল সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের একটা প্রক্রিয়া এবং সেই প্রক্রিয়াটি অনেক সময়েই অ-সম। হিন্দু সৈনিকরা যখন তুর্কি শাসকদের অধীনে কাজ করতেন, তখন তাঁদের প্রত্যেক দিন আরবি ও ফারসি ভাষার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হত। তাঁদের আর কোনও উপায় ছিল না, তাই হিন্দি ভাষাকে ভিত্তি হিসেবে নিয়ে, ওই দুটি বিদেশি ভাষার বহু শব্দ ব্যবহার করে তাঁরা নিজেদের ভাষা তৈরি করে নিয়েছিলেন। কালক্রমে জ়ুবান-ই-উর্দু বা ‘সেনা-ছাউনির ভাষা’ই রূপান্তরিত হল নতুন একটি মিষ্টি ভাষায়— উর্দু। আবার, যখন পূর্ব ভারতে বাংলার বিশেষ আধিপত্য ছিল, তখন প্রতিবেশী রাজ্যের মানুষজন বাঙালিদের মতোই বেশ ঝরঝরে বাংলা বলতে পারতেন। কিন্তু ১৯৭০-এর দশক থেকে যখন বাংলার অধোগতি স্পষ্ট হয়, তার পর থেকেই দেখা গেল, পরের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বাংলা বলতে চাইছেন না। বাংলা ভাষাটা ভাল বুঝলে বা জানলেও তাঁরা, সামাজিক অবস্থা অনুসারে, হিন্দি বা ইংরেজিতে কথা বলেন। গত দুই শতাব্দী ধরে যাঁরা বাংলার বাইরে থেকে এসে থেকে গিয়েছিলেন, এবং যাঁদের পদবি থেকে বোঝা যেত যে তাঁরা আদতে বাংলার মানুষ নন, তাঁরা এটা বোঝাতে খুব চেষ্টা করতেন যে, আসলে তাঁরা খাঁটি বাঙালিই। কিন্তু এখন আর সে জমানা নেই। চাকা পুরো ঘুরে গিয়েছে। আমাদের এখন মেনে নিতেই হবে যে, পশ্চিমবঙ্গ ভারতের ২৯টি রাজ্যের মধ্যে একটি মাত্র। এবং তার বিশেষ কোনও মর্যাদাও আর নেই, কারণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাক্ষরতা— কার্যত যে কোনও সূচকের বিচারেই দেশের মধ্যে এ রাজ্যের স্থান মাঝামাঝি বা শেষের দিকে। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র এবং শরৎচন্দ্রের লেখা বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে, নানা প্রদেশের মানুষ সুভাষচন্দ্র বসুর নামে ছেলের নাম রেখেছেন, কিন্তু আজ সে সবই ইতিহাস। কর্মসূত্রে দেশে ও দেশের বাইরে রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের জন্মের সার্ধশতবর্ষ পালনের সময় একটা অপ্রিয় সত্য আমি উপলব্ধি করেছিলাম। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কিছু মুষ্টিমেয় ভক্ত ছাড়া আর কারওই এঁদের নিয়ে কিছু যায় আসে না। বাংলার সাংস্কৃতিক কৃতিত্ব নিয়েও এঁদের কোনও মাথাব্যথা নেই।

আর তাই, যখন বাঙালিরা অনেকেই কথায় বা হাবেভাবে বোঝান যে তাঁরাই পৃথিবীর কেন্দ্রে বিরাজ করছেন, তখন বড় অবাক লাগে। তাঁরা বাকি দেশ বিষয়ে বিশেষ খবর রাখেন না, বড়জোর টুরিস্ট হিসেবে অমুক স্পেশাল বা তমুক স্পেশাল-এর সঙ্গে ভারত ভ্রমণ করেন, অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে পরিচয় বলতে এইটুকুই। এই পরিণতির জন্য কোনও একটি বিশেষ সরকারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরা প্রতিবাদকে চিরদিন খুব রোম্যান্টিক ব্যাপার বলে ভেবেছি আর আন্দোলন নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি— বঙ্গভঙ্গ থেকে শুরু করে যুগান্তর-অনুশীলন সমিতি পর্যন্ত। ষাটের দশক থেকে আবার ঘেরাও আর বন্‌ধ হয়ে উঠল বাঙালির কাছে বীরত্বের বিশুদ্ধ রূপ। আন্দোলনকারীরা বুঝতেই পারেননি যে পুঁজি স্বভাবে লক্ষ্মীর মতোই— চঞ্চলা, অস্থিরমতি, যে কোনও সময় তিনি ছেড়ে চলে যেতে পারেন। এবং তা-ই হয়েছে। পুঁজি আমাদের একেবারেই ছেড়ে চলে গিয়েছে। অদূরদর্শী ইউনিয়ন নেতারা বুঝতেই পারেননি বা চাননি, যে সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তাঁরা লড়াই করছেন এবং তার দশ গুণ বেশি অসংগঠিত কর্মীদের দুর্ভাগ্যের পথে ঠেলে দিচ্ছেন— সেই কর্মীরা এক বার তাঁদের ফ্রিজ, টিভি, গাড়ি, দু’কামরার ফ্ল্যাট পেয়ে গেলে আর আন্দোলনের দিকে ফিরেও তাকাবেন না। এই নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যাঁরা রাস্তার দোকান থেকে, ছোট ব্যবসা থেকে নিজেদের ভাগ্য ফিরিয়েছেন, তাঁরাই আন্দোলনের রাজনীতিকে হারিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ‘পরিবর্তন’ নিয়ে এসেছেন। শ্রমিক আন্দোলনের প্রকাশ হিসেবে সত্তর-আশির দশকের ঘেরাও হয়ে থাকা মালিক, ম্যানেজারদের ভয়াবহ সব কাহিনি সারা ভারতকে জানিয়েছে বাংলার আগ্রাসী শ্রমিক আন্দোলনের কথা। এবং সেই সব আন্দোলন, সমৃদ্ধ পশ্চিম ভারত থেকে আগামী একশো বছরে বাংলায় যেন কোনও বিনিয়োগ না হয়, সে ব্যবস্থা পাকা করেছে। পর পর দুই মুখ্যমন্ত্রী যতই রাজ্যে বিনিয়োগ টানার চেষ্টা করুন না কেন, তা বিফলেই গিয়েছে।

Advertisement

তবে কিনা, অন্য দিকটাও দেখা দরকার। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আগের প্রজন্মের মতো কেবল পাড়ার মোড়ে বা রকে বসে আড্ডা না দিয়ে, কিংবা সরকারি চাকরি হল না— এই ক্ষোভে নিজেদের নষ্ট না করে রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা করে। স্থানীয় কাউন্সিলরের আশীর্বাদে ধন্য হলে তারা ছোট ছোট হকার স্টল খোলে কিংবা জ়োম্যাটো, সুইগি, ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজ়ন-এর মতো সংস্থার হয়ে মোটরবাইক চড়ে ডেলিভারি বয়ের কাজ করে। তারা কল সেন্টার বা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে, আন্দোলনের চাহিদা ছাড়াই। তারা ঘাম ঝরায়, কিন্তু ১২ জুলাই কমিটির নাম শোনেনি কোনও দিন। এরা ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ দুনিয়ায় ওতপ্রোত জড়িত, মোবাইল রিচার্জ বা ওটিপি ব্যবহারে চোস্ত, কিন্তু এরা কেউ কোনও দিন সাহিত্যপত্রিকা বা জীবনানন্দের কবিতা পড়েনি।

এরা দিনরাত্রি কাজ করে, মৃণাল সেনের ছবির সর্বহারাদের মতো মোটেই নয়। বরং এরা এখন ‘সব পেতে হবে’র দলে। বঞ্চনা এখন আউট অব ফ্যাশন, ঠিক যেমন আদর্শ আর বুদ্ধিচর্চা। আরও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, উন্নাসিক শিক্ষিত শ্রেণি ব্যবসাকে আর অপমান বা অপরাধ হিসেবে দেখে না। তারা আগমার্কা মধ্যবিত্ত বাঙালি পাড়ায় এখন হাজার হাজার খাবারের দোকান খুলেছে, উৎকৃষ্টতম শাড়ি, পোশাক, হ্যান্ডলুমের কাপড় কিনে ফেলছে এবং নতুন ভাবনার মোড়কে পুরে সে সব জমিয়ে বিক্রি করছে।

সমস্ত শ্রেণির মানুষই এখন বদলে গিয়েছে। কর্মরত মহিলা স্বামীকে বলেন, রাতে বাড়ি ফেরার সময় যেন ডিনারের জন্য ফুটপাতের স্টল থেকে বিরিয়ানি বা হাত-রুটি তুলে নেন। সন্ধ্যাবেলায় আমরা কোনও দাদার বাড়ি গিয়ে চা আর থিন অ্যারারুট বিস্কুট খেতে খেতে আড্ডা মারি না। বউদির হাতের ডিমের অমলেট ভাজার গন্ধ আর মনেই পড়ে না। এখনকার দাদারা বাড়ি গেলে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেন, ‘‘কী দেব, জল না সোডা?’’ 

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন