জায়ফল

জায়ফলের বাড়ি ইন্দোনেশিয়ার বান্দা দ্বীপে। কিন্তু তাকে নিয়ে ইউরোপে যা পাগলামি হয়েছে আর যা রক্ত ঝরেছে, অন্য সব মশলা তার কাছে নস্যি।

Advertisement

পিনাকী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

জায়ফলের বাড়ি ইন্দোনেশিয়ার বান্দা দ্বীপে। কিন্তু তাকে নিয়ে ইউরোপে যা পাগলামি হয়েছে আর যা রক্ত ঝরেছে, অন্য সব মশলা তার কাছে নস্যি।

Advertisement

এমনিতে সাধারণ সর্দিকাশিতে জায়ফলের গুঁড়ো খুবই উপকারী। গর্ভপাত করানোর জন্যও তার খ্যাতি বহু দিন। এর ওপর জুড়ল এক অন্ধ বিশ্বাস। এ নাকি প্লেগ সারিয়ে দেয়। ফলে জায়ফলের দাম বেড়ে গেল। এক পাউন্ড জায়ফলের দামে সাতটা হৃষ্টপুষ্ট গরু কেনা যেত। ধর্মযাজকরা উদার সার্টিফিকেট দিতে থাকলেন জায়ফলকে। জায়ফল খাবারকে সুস্বাদু আর সুগন্ধি করে, ভেষজ উপকারিতাও অনেক। খাবারে দিলে সে খাবার চট করে নষ্ট হয় না। নবম শতাব্দীর শুরুর দিকে থিওডর দ্য স্টুডাইট তাঁর শিষ্যদের খাবারের ওপরে জায়ফল গুঁড়ো দিয়ে খেতে বলতেন। স্বাস্থ্য আর মনোযোগ দুই-ই ভাল হবে। তারও আগে, নালন্দায় থাকতে হিউয়েন সাং-কে রোজ কুড়িটা জায়ফল পরিবেশন করা হত। মধ্যযুগের ইতালির বিখ্যাত সালের্নো মেডিকাল স্কুল জায়ফল নিয়ে সতর্কবাণী শুনিয়েছিল। ‘একটা জায়ফল তোমার উপকার করবে, দুটো জায়ফল তোমার ক্ষতি করবে, আর তিনটে জায়ফল তোমায় মেরে ফেলবে।’ জায়ফল নেশার জগতেও দারুণ আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। কটু গন্ধ নেই, খেতে ভাল, চট করে তুরীয়ানন্দ— সব মিলিয়ে সেই সময়ের ধনীদের কাছে জায়ফল বড় আদরের। সান্ধ্য মৌতাতে জায়ফলকে পেতে যে কোনও দাম দিতে রাজি থাকতেন তাঁরা। তাতেই আরও মূল্যবান হয়ে উঠল জায়ফল।

একটা ছোট থলি ভর্তি জায়ফল বিক্রি করলে বাকি জীবন সেই টাকায় বসে খাওয়া যেত। তাই উটের পিঠে চাপিয়ে মরুভূমি পার হয়ে আরব বণিকরা যেটুকু জায়ফল নিয়ে যেতে পারত, তা-ই রোজগারের জন্য যথেষ্ট হত। বাদ সাধল অটোমানের জমানার তুর্কিরা। ১৪৯৩ সালে ইস্তানবুল হয়ে এশিয়া থেকে ইউরোপের বাণিজ্যপথ তারা বন্ধ করে দিল। আর মরিয়া হয়ে সমস্ত দেশ বেরিয়ে পড়ল আরব বণিকদের নিয়ে আসা মশলা, বিশেষত জায়ফল খুঁজতে। পর্তুগাল তো ১৫১১ সালেই খুঁজে বার করে ফেলল জায়ফলের দেশ। আলফানসো আলবুকার্ক সে বছর অগস্টে মালাক্কা জয় করলেন। স্থানীয়দের কাছে জানলেন জায়ফলের ঠিকানা। বন্ধু অ্যান্টোনিয়ো দি আব্রেউ’কে তিনটে জাহাজ সমেত পাঠালেন খবরের সত্যতা যাচাই করতে। আব্রেউ সাহেব এক মাস বাদে ফেরত এলেন তিন জাহাজ ভর্তি জায়ফল লবঙ্গ নিয়ে। তক্ষুনি পর্তুগিজরা আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত ছুঁয়ে তৈরি বাণিজ্যপথের সঙ্গে বান্দা দ্বীপকে জুড়ে দিয়ে, জায়ফলের ইউরোপ যাত্রার খরচা এক ধাক্কায় অনেকটা কমিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তাদের কপাল বরাবর খারাপ। লোকবল যথেষ্ট ছিল না। দ্বীপগুলোকে কব্জা করে শাসন চালাতে ব্যর্থ হল, অন্য শক্তিদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে রণে ভঙ্গ দিল। কিন্তু ইউরোপের কাছে জায়ফল জোগানের রাস্তাটা তো তৈরি করে দিল। সে রাস্তা দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী নেদারল্যান্ডস ও ইংল্যান্ড ব্যবসা চালিয়ে ফুলেফেঁপে উঠল। নেদারল্যান্ডস সেখানে শুরু করল ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের শাসন। অনেকের মতেই, সেই কোম্পানি বিশ্বের প্রথম বহুজাতিক সংস্থা। সেই কোম্পানি জায়ফল ব্যবসা কব্জা করার পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তাদের কর্মচারীর সংখ্যা ৫০,০০০ ছাড়ায়, জাহাজের সংখ্যা ২০০ আর সৈন্যের সংখ্যা ১০,০০০-এ দাঁড়ায়।

Advertisement

শেষ পাতে জানাই, এই জায়ফল হচ্ছে এক ধরনের বাদাম, তার মানিকজোড় সঙ্গী জয়ত্রি হচ্ছে সেই বাদামের খোসা।

pinakee.bhattacharya@gmail.com


আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement