আমজনতার ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ

অল্প বয়স থেকেই শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরী ভঞ্জ, অমিতা সেনদের মতো আশ্রমকন্যা, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী-র মতো আশ্রমিকদের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বহু অজানা কথা জেনেছি।

Advertisement

পঙ্কজ সাহা

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
Share:

মানুষের সঙ্গে। মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আছেন শরৎচন্দ্র বসু, সুভাষচন্দ্র বসুও।

অল্প বয়স থেকেই শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরী ভঞ্জ, অমিতা সেনদের মতো আশ্রমকন্যা, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী-র মতো আশ্রমিকদের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বহু অজানা কথা জেনেছি। কিন্তু শান্তিনিকেতনের প্রভাব থেকে অনেক দূরে যাঁরা জীবনযাপন করেন, যাঁরা সাধারণ মানুষ, তাঁদের চোখে রবীন্দ্রনাথ কেমন, তা জানার এবং দর্শকদের কাছে তা তুলে ধরার ভাবনা মাথায় এসেছিল। তাই ’৯০-এর দশকে ‘রবীন্দ্রনাথ নব্বই দশকে’ নামে একটা অনুষ্ঠান প্রযোজনা করি। শুটিং করেছিলাম গোপন ক্যামেরায়। বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কলকাতায়, কলকাতার বাইরে পথে পথে ঘুরে আমজনতার রবীন্দ্রনাথকে জানবার, জানাবার চেষ্টা করেছিলাম।

Advertisement

এক গ্রামে গিয়ে এক কৃষককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনেছেন? তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, ওই ঠাকুরের কথা আর কী বলব, তবে আমার ছেলে স্কুলে পড়ে, সে সেই ঠাকুরের লেখা পদ্য মুখস্থ বলতে পারে।’ এক খেতমজুর বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? না, আমাদের গ্রামে ওই ঠাকুরের কোনও মন্দির নাই।’ গরুর হাটে ঢুকে পড়েছিলাম, গরু কিনতে এসেছেন এক জন, তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম একই প্রশ্ন। তিনি বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথের নাম জানব না! আমি তাঁর কবিতাও জানি।’ বলেই গলা খুলে আবৃত্তি করতে লাগলেন, ‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু...’ আমি তাঁর আবৃত্তির খুব প্রশংসা করে বললাম, এটা তো কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা। তিনি একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে হেসে বললেন, ‘কী সুন্দর কবিতা, না?’ বলেই গরুর দরাদরি শুরু করলেন।

কলকাতার রাস্তায়, বাসস্ট্যান্ডে জনে জনে জিজ্ঞেস করেছি, আপনি নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছেন? তাঁরা বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ! কে না জানে রবীন্দ্রনাথকে! তাঁর কত কবিতা স্কুলে পড়েছি।’ কিন্তু খুব কম জনই বলতে পেরেছেন স্কুলের পাঠ্যে রবীন্দ্রনাথের কোন কোন লেখা ছিল। কেউ বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতার অংশ নিয়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে যে ব্যাখ্যা লিখতে বলা হত, তাতে আমি খুব ভাল নম্বর পেতাম।’ রবীন্দ্রনাথের কোনও বইয়ের নাম মনে পড়ে? বেশির ভাগ লোক বলেছিলেন, সঞ্চয়িতা। কেউ বলেছেন, ‘গীতবিতানের নাম জানি, আমার মেয়ে তো রবীন্দ্রসংগীত শেখে।’ এক-দুজন বলেছেন রক্তকরবী, বিসর্জন-এর নাম। এই বইগুলোই কেন, জিজ্ঞেস করায় বলেছেন, স্টেজে এই নাটকগুলো তাঁরা দেখেছেন, তাই নাম মনে আছে। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গল্প করার সময়, দুজন আমাকে বলেছিলেন, ‘সব রবীন্দ্রসংগীতই রবীন্দ্রনাথের লেখা, বলেন কী!’ এক জন বলেছিলেন, তাঁর রবীন্দ্রসংগীত খুব ভাল লাগে, মেয়ে বড় হলে তিনি তাকে রবীন্দ্রসংগীত শেখাবেন। এ-ও বলেছিলেন, তাঁদের পাড়ায় এক মাস্টারমশাই খুব ভাল রবীন্দ্রসংগীত লেখেন, তাই তাঁকে তাঁর খুব পছন্দ।

Advertisement

রবিবার সকালবেলায় কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির আড্ডায় উপস্থিত হয়ে জানতে চেয়েছি, রবীন্দ্রনাথের কোন ধরনের লেখা তাঁদের এখন ভাল লাগে। সবাই বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের কথা বলছেন! রবীন্দ্রনাথই আমাদের জীবন, ওঁকে নিয়েই তো বেঁচে আছি।’ কোন ধরনের লেখা ভাল লাগে? উত্তর পেয়েছি, সব ধরনের লেখাই। সম্প্রতি অথবা কয়েক বছরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কোন বই পড়েছেন, এ প্রশ্নের উত্তরে হেসে খুব স্মার্ট ভাবে বলেছেন, ‘সব সময়ই তো রবীন্দ্রনাথ পড়ছি। রাতে রবীন্দ্রনাথের বই মাথার কাছে রেখেই তো শুতে যাই।’ কিন্তু ‘কোনও একটা নাম একটু মনে করে বলুন যা সম্প্রতি পড়েছেন’, এর জবাবে কেউ কোনও বইয়ের নাম বলতে পারেননি। কেউ নীরব থেকে মৃদু হেসেছেন, কেউ বলেছেন, ‘কোন বইয়ের নাম বলি বলুন তো! কত বই-ই তো পড়েছি গত কয়েক বছরে।’ নাছোড়বান্দার মতো জিজ্ঞেস করেছি, তা তো বটেই, তবু কোনও একটা বইয়ের নাম বলুন, খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কোনও বইয়ের নামই কেউ বলতে পারেননি।

সাদার্ন অ্যাভিনিউতে নজরুল মঞ্চের দেওয়ালের খাঁজে একটা ঘুপচি চা-দোকানে পৌঁছলাম। হাফপ্যান্ট-গেঞ্জি পরা এক বলিষ্ঠ চেহারার লোক দোকান চালাচ্ছেন। চা আর লেড়ো বিস্কুট খেতে খেতে তাঁর সঙ্গে গল্প শুরু করলাম। গোপন ক্যামেরায় শুটিং চলছে, আমার পকেটে লুকোনো মাইক। দোকানের মালিককে জিজ্ঞেস করলাম, রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছেন? উত্তর এল, ‘রবীন্দ্রনাথের নাম কেন শুনব না, আমরা দুজন তো এক গাঁয়েরই লোক।’ এক গ্রাম! কোন গ্রাম? বললেন, ‘কেন, ভুবনডাঙা!’ আপনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কী জানেন? ‘কী জানতে চান বলুন না, চণ্ডালিকা, চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা, ডাকঘর, শারদোৎসব।’ বিস্মিত আমি খানিক ক্ষণ সেদ্ধ ডিমের মতো থ হয়ে থেকে বললাম, আপনি এ-সব জানলেন কী করে? তিনি আমাকে একেবারে তাচ্ছিল্য করে বললেন, ‘জানব না, আমি তো সেই অল্প বয়স থেকেই কত দিন শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের কিচেনে চাকরি করেছি। তার পর ডাক্তারবাবুর মেয়ের প্রেমে পড়ে তাকে নিয়ে কলকাতায় পালিয়ে এলাম। আমার ভাগ্যে তো ভাল জিনিস সয় না, ডাক্তারবাবুর মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেল, তার পর দেখুন এই চায়ের দোকান করে কোনও রকমে চালাচ্ছি। শান্তিনিকেতনে কিচেনে যখন চাকরি করতাম, কত রিহার্সাল দেখেছি শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, ডাকঘর নাটকের! কত গানের কথা, নাটকের ডায়ালগ, সব আমার মুখস্থ। শুনতে চাইলে আর এক দিন আসুন, এখন এই বিকেলবেলা আমার অনেক খদ্দের।’ বলেই তিনি চা ছাঁকতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।

উঠে পড়েছিলাম এক ট্রামে। কন্ডাক্টরের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি তো নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছেন? ট্রাম স্টপে এসে দাঁড়িয়েছে, তিনি ঘন্টি বাজিয়ে বলছেন ‘কালীঘাট কালীঘাট, কারা নামবেন, নামুন নামুন, ঠেলাঠেলি করবেন না, আগে নামতে দিন।’ ট্রাম চলতে শুরু করলে বললাম, আপনি নিশ্চয়ই স্কুলে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়েছেন? উত্তর পেলাম, ‘শুধু স্কুলে কেন, কলেজেও পড়েছি, এম এ-তে রবীন্দ্রনাথ আমার স্পেশাল পেপার ছিল।’ জোর ধাক্কা খেলাম। এখন রবীন্দ্রনাথ পড়েন? বললেন, ‘খুব একটা সময় পাই না, তবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা এখন আমাকে খুব একটা টানে না। বরং ওঁর প্রবন্ধ, ভাষণ, শান্তিনিকেতন প্রবন্ধাবলি পড়তে বেশি ভাল লাগে। ইদানীং রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র খুব মন দিয়ে পড়ছি। —উঠুন উঠুন, তাড়াতাড়ি উঠে আসুন।’ টং টং করে ঘন্টি বাজালেন। ‘তবে রবীন্দ্রনাথের গানই এখন সবচেয়ে বেশি টানে। আসলে আমি রবীন্দ্রসংগীত গাই তো।’ বললাম, একটা গান শোনান। খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘বলছেন কী! ডিউটি করতে করতে গান গাইব! আপনি কি চান আমি চাকরিটা খোয়াই?’ তখন তাঁকে খুলে বললাম, ওই দেখুন গোপন ক্যামেরা, আমরা শুট করছি। আপনি একটা গান করুন। টেলিকাস্টের আগে আমি কলকাতা ট্রামওয়েজের চেয়ারম্যানকে বলে নেব যাতে আপনার চাকরির কোনও ক্ষতি না হয়। তিনি তখন উদাত্ত মধুর কণ্ঠে গাইতে লাগলেন ‘জগৎ জুড়ে উদার সুরে আনন্দগান বাজে।’ অনুষ্ঠান টেলিকাস্টের আগে তৎকালীন চেয়ারম্যানকে সব বললাম। তিনি বললেন, কখন অনুষ্ঠান, আমি দেখব। পরে সেই কন্ডাক্টর ভদ্রলোক ফোন করে জানিয়েছিলেন, সহকর্মীদের কাছে তাঁর কদর বেড়ে গেছে। চেয়ারম্যান তাঁকে সংবর্ধনা দিয়ে, বক্তৃতায় বলেছেন, কলকাতা ট্রামওয়েজ তাঁর জন্য গর্বিত।

pankajsaha.kolkata@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন