রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৬ ০০:২৫
Share:

পাউরুটি

Advertisement

পিনাকী ভট্টাচার্য

পর্তুগিজরা এই দেশের মশলা থেকে মাণিক্য পর্যন্ত লুটে জাহাজ ভরে নিয়েছে ঠিকই, তবে দিয়েওছে টিফিনবাক্স ভর্তি করে। আমাদের রোজের জলখাবার পাউরুটিকে তো ওরাই রেখে গিয়েছে।

Advertisement

পর্তুগিজরা এ দেশে এসে, আস্তানা গেড়েছিল পশ্চিম উপকূলের দিকটায়, কিছুটা গোয়ায় আর কিছুটা কোচিনে। নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার সময় ওদের মনে হল, এত দিনের অনুপস্থিতিতে মৌরসিপাট্টা অন্য কোনও দেশের হাতে চলে যেতে পারে। তাই এক দল থেকে গেল, যারা নতুন জাহাজ এলে তাতে ফিরবে, আর সেই জাহাজে আসা দেশবাসীরা থেকে যাবে পরের জাহাজের অপেক্ষায়। এই ভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ওরা পশ্চিম উপকূল দখল করে রাখল। এ দেশে ভাত খাওয়ার চল, তাই তাতেই নিজেদের অভ্যস্ত করল তারা, আর নিজেদের পছন্দসই স্বাদের কিছু পদও বানিয়ে নিল। কিন্তু বাদ সাধল রুটিতে। উত্তর ভারতে যে রুটি হয়, তা আটা দিয়ে তৈরি, তা কোনও ভাবেই পর্তুগিজদের মুখে রোচে না। এ দিকে কিন্তু ময়দার অভাব নেই। তত দিনে তো মুসলিম বণিকদের হাত ধরে আরব দেশ থেকে ময়দা এ দেশের দক্ষিণ উপকূলে পৌঁছেই গিয়েছিল— কিন্তু মুশকিল হল ইস্ট (yeast) ছাড়া ‘লোফ’ তৈরি হয় না। ইস্ট কী করে জোগাড় হবে এই দেশে! অবশেষে তার সুরাহাও মিলল। দেখা গেল ময়দায় কয়েক ফোঁটা টডি (তাল থেকে তৈরি মদ) দিয়ে দিলে টডি-ই ইস্ট-এর কাজ করে দেয়। ফলে পর্তুগিজদের মনপসন্দ রুটি তৈরি হতে লাগল। এই ‘পাও’ (পর্তুগিজরা যে নামে ডাকত) ছড়িয়ে পড়ল গোয়ার বাইরেও, এমনকী মুম্বইতেও। ব্রিটিশরা যখন এ দেশে তাদের ফ্যাকাশে সাদা ‘ব্রেড’ নিয়ে এসে পৌঁছল, তখন মধ্যবিত্ত সমাজে, বিশেষ করে দেশের পশ্চিম প্রান্তে তা এক্কেবারেই জায়গা করে নিতে পারল না। ব্রিটিশ ব্রেড কুলীন খাবার হয়ে রয়ে গেল। মোটে স্যান্ডউইচ আর টোস্ট বানানোতেই আটকে রইল সে। পাও হয়ে উঠল আমজনতার খাবার।

পাও কিন্তু প্রথম যুগে শুধু খ্রিস্টান আর মুসলমানদের মধ্যেই জনপ্রিয় ছিল। হিন্দুরা আটার রুটি আর পুরির বাইরে কোনও রকম পরীক্ষানিরীক্ষা করতে রাজি ছিল না, ময়দার ব্যবহার হিন্দুদের কাছে ছিল নিষিদ্ধ, কারণ তাদের মতে, ময়দা ছিল বিধর্মীদের খাবার। কিন্তু বাদ সাধল শিল্প বিপ্লব। ১৮৫০ সাল নাগাদ যখন মুম্বইয়ের সুতোর মিলগুলো একে অপরের সঙ্গে উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে, তখন মিলের শ্রমিকদের কাছে খাওয়ার সময় বাঁচানো খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, কারণ মিলে টিফিন করার সময়ও থাকত খুব কম। আর বাড়ি থেকে আনা ভারী খাবার খেয়ে কায়িক পরিশ্রম করা ছিল শক্ত। তাদের কথা ভেবে, এক দোকানদার বিভিন্ন পদ মিশিয়ে এক মশলাদার ভাজি তৈরি করে, পাওয়ের সঙ্গে পরিবেশন করতে শুরু করল। মুসলমান আর খ্রিস্টানরা এই খাবার তারিয়ে তারিয়ে খেল, আটকে গেল হিন্দুরা। তারা বাড়তি রোজগারের প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়তে লাগল। অবশেষে কিছুটা নিরুপায় হয়েই তারাও শুরু করল পাওভাজি খাওয়া। অচিরেই নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত নির্বিশেষে হিন্দু হেঁশেলেও ঢুকে পড়ল ময়দার তৈরি পাও আর তার সঙ্গে চাকুমচুকুম ভাজি।

বিদর্ভে আর পশ্চিমে সিকি মাপকে ‘পাও’ বলা হয়। আর একটা রুটি, লোফের সিকি ভাগের হয়। সেখান থেকে পাওরুটি নামের উৎপত্তি। কিন্তু উচ্চ বংশের হিন্দুরা ‘পাও’-এর কাছে হারের জ্বলুনি ভোলেনি— সুযোগ বুঝে তারা প্রচার করে, পা দিয়ে ময়দা দলে এই রুটি তৈরি হয়, তাই এর নাম পাউরুটি। বোঝো কাণ্ড!

pinakee.bhattacharya@gmail.com

২৫০ গ্রাম চালে রবীন্দ্রনাথের টিকিট

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

ট্র্যাফিক সিগনালে রবীন্দ্রসংগীত আপন মনেই বাজে। সব সময় যে উলটো পালটা গান হয় তেমন নয়। যেমন, কাঠফাটা রোদ্দুরে ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’ কিংবা ঘোর বর্ষায় ‘দারুণ অগ্নিবাণে রে’...— সব সময় এমন নয়। একদম ঠিক জায়গায় ঠিকঠাক গানও তো শুনেছি কত। যেমন গত বামফ্রন্ট সরকার পতনের পর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের মোড়ে ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না’, আলিপুর জেলের সামনে ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’।

রবীন্দ্রনাথ এমন এক দৈব লেবু যা চটকালেও তেতো হয় না। কিংবা সর্বত্র প্রলেপযোগ্য আশ্চর্য মলম কিংবা সর্বঘটে ব্যবহারযোগ্য কলা (শিল্প অর্থে)।

প্রাক্-রবীন্দ্র যুগে নানা উপলক্ষে গান রচিত হত। এখন দরকার নেই। মহাজনের গুদাম থেকে একটা বেছে নিলেই হল। রবীন্দ্রনাথ যে সব অনুষ্ঠান কল্পনাই করতে পারেননি, তাঁর মৃত্যুর ৭০ বছর পরেও দেখা যাচ্ছে সেই সব অনুষ্ঠানের গানও মজুত। গীতবিতানে ফুটবল মাঠের বার-পুজোর গান নেই। কিন্তু মাঠে শোনা গেল ‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি’।

বছর তিনেক আগে ট্র্যাফিক সিগনালের গান শুনে এক রিকশওয়ালাকে কাঁদতে দেখেছিলাম এয়ারপোর্টের এক নম্বর গেটের কাছে। মোড়ের লাল আলোয় থেমেছিল রিকশটা। মাইকে দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় গান শোনা যাচ্ছিল ‘মেঘ বলেছে ‘যাব যাব’ রাত বলেছে ‘যাই’।’ আলোর রং বদলে গেল, কিন্তু রিকশটা থেমেই রইল। আমি সিটে বসা সওয়ারি, বলি, কী হল? চলো। লোকটা চোখ মুছল। ভাবলাম চোখে কুটো পড়েছে বোধহয়। কিন্তু লোকটা আপন মনে বলছে: দুঃখ বলে ‘রইনু চুপে তাঁহার পায়ের চিহ্নরূপে’...বুকের ভেতরটায় কী যে হয়! ওর গলায় একটা অদ্ভুত আবেগ মিশে আছে। অবাক কাণ্ড! একটা রিকশওয়ালা রবীন্দ্রসংগীত শুনে কাঁদছে? নিশ্চিত হবার জন্য জিজ্ঞাসা করি, কাঁদছিলে? লোকটা মাথা নাড়ায়। রবীন্দ্রসংগীত শুনে যে কাঁদে, তাকে আর তুমি বলা যায় না। বলি, মানেটা বুঝেছিলেন? লোকটা বলল, আগে বুঝতাম না, এখন একটু বুঝি। বুঝতে গেলে আড়াইশো গ্রাম চাল লাগে। ওর হেঁয়ালি বুঝতে পারলাম না। সে দিন তাড়া ছিল, আর প্রশ্ন করা হয়নি।

সাদা কাকের জন্য চরিত্র দরকার। রিকশওয়ালার কথা মনে পড়ল। ওর তো নামটাই জিজ্ঞাসা করা হয়নি। ওখানে গিয়ে কী বলে খোঁজ করব? ‘রবীন্দ্রসংগীতে কান্না আসে’ ছাড়া শনাক্তকরণের কোনও উপায় ছিল না। এটাই বললাম, এবং কাজ হয়ে গেল। অন্য রিকশওয়ালারা বলল, ভজা। ভজন দাস। ও এখন আমেরিকা। বাউলরা বিলেত-আমেরিকা যায় জানি। ও কী করতে যাবে? শুনলাম, ওর দুই মেয়ে আমেরিকা। বাপ গেছে দেখা করতে। দু’মাস পরে ফিরবে।

কয়েক বারের চেষ্টায় দেখা পেলাম রিকশ স্ট্যান্ডেই। আমেরিকা থেকে ফিরে রিকশ চালাচ্ছেন ফের। ওঁর অল্প অল্প জীবনগল্প খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করি। জাতিতে চণ্ডাল। বাংলাদেশ থেকে আসা এক ভদ্রলোকের নিয়মিত রিকশওয়ালা ছিলেন। সেই ভদ্রলোকই একটি সংস্থায় কাজ জোগাড় করে দেন। রাতে পাহারা, দিনে রিকশ। তিন মেয়ে। রবীন্দ্র-বঙ্কিম-বিবেকানন্দের বাণী নয়, ওঁর অনুপ্রেরণা ছিল ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর’ এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের উপদেশ: ‘খাও বা না খাও, সন্তানদের শিক্ষা দাও।’ বড় মেয়ে স্কলারশিপ পেয়ে স্কুল পাশ করে কল্যাণীতে ডেয়ারি টেকনোলজি’তে ভর্তি হয়েছিল। ভজন ফুটপাত থেকে একটা বই কিনলেন, ‘দেশে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুলুকসন্ধান’। ১০ টাকা দামের ৩২ পাতার এই বইটাই জীবনটা পালটে দিল ভজনের। বড় মেয়ে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে চিজ-মাখন নিয়ে আমেরিকায় পিএইচডি করে বড় কোম্পানিতে চাকরি করে। টাকাও পাঠায়। মেজ মেয়েটাও পিএইচডি করছে, ছোটটা এমএ পড়ছে, বলছে জাতিভেদ প্রথার মূলে ঢুকবে, গবেষণা করবে নিজেদের চণ্ডালত্ব নিয়ে। একটা ছোট ফ্ল্যাটও কেনা হল।

—তবুও রিকশ চালান?

— কেন চালাব না? ছোট মেয়েটা পিএইচডি হয়নি এখনও।

তিন বছর আগেকার রবীন্দ্রসংগীতের মানে আর আড়াইশো চালের প্রসঙ্গ তুলি। উনি বলেন, আমার নিজের দাদা হল খেতমজুর। পরের জমিতে চাষ। জমির মালিক করল সূর্যমুখী ফুলের চাষ। মাঠ ভরা হলুদ ফুলের বীজ খাবে বলে আকাশ থেকি নেমে এল সবুজ রঙের টিয়াপাখি। কী দৃশ্য ভেবি দেখেন। এ সব দেখলি পরেই তো কবিরা লেখেন আহা মরি মরি। দাদার এ সব দেখার অধিকার ছিল না। টিয়া নামলেই টিন পিটোয়ে পাখি তাড়াত। দাদার ছেলে এখন অটো চালায়। চলার রাস্তায় সূর্যমুখী ফুল দেখলি বলতি পারে কী বিউটিফুল। সোন্দরকে সোন্দর বলি বুঝতি পারার একটা টিকিট লাগে। আড়াইশো চাল মানে বলতি চেয়েছিলাম সেই টিকিট। পেটে ভাতটা পড়লি অন্য কিছুর মানে বুঝাবুঝি। যে গানটার কথা বলছেন, ওরম কত গান শুনেছি। কিন্তু সে দিন হয়েছিল কী, মেয়ের ফোন এসেছিল অকালে। চাকরি পাওয়ার খবর। আর গান শুনলাম, মেঘ বলছে সরে যাব, রাত বলছে যাই। সাগর বলছে ওই তো কূল মিলে গেছে। আমার কথাই তো হচ্ছে, কিন্তু আরও যে বড় কথা গোঁজা আছে— ভিতরে— ভুবনটা বলছে আমার জন্য বরণমালা রেডি করে রাখিচে— সেটাও বোঝলাম।

ও সব কি খালি পেটে বোঝা যায় স্যর?

swapnoc@rediffmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন