ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৩০
Novel

দৈবাদিষ্ট

দ্রোণ ও ধৃষ্টদ্যুম্ন উভয়েই ক্ষণকাল তড়িদাহতের মতো বসে রইলেন, তাঁদের অন্নমুষ্টি হাতেই রয়ে গেল। কঠোর নিষেধ ছিল দ্রোণের— ধৃষ্টদ্যুম্নের গুরুগৃহবাসকালে কেউ যেন কখনও এই প্রসঙ্গ উত্থাপিত না করে!

Advertisement

সৌরভ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২২ ০৭:০৪
Share:

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

পূর্বানুবৃত্তি: ধৃষ্টদ্যুম্নকে অস্ত্রশিক্ষা প্রদান প্রসঙ্গে বিস্তর মতান্তর ও মনান্তর হয় দ্রোণ এবং তাঁর পুত্র অশ্বত্থামার মধ্যে। দ্রোণ তাকে সাময়িক ভাবে উত্তর পাঞ্চালের প্রাসাদে বসবাসের পরামর্শ দেন। অশ্বত্থামাকে সাক্ষী হতে হয় না ধৃষ্টদ্যুম্নের অস্ত্রচর্চার, কিন্তু কৃপীকে অসহায় ভাবে স্বামীর ভবিষ্যৎ-হন্তারকের প্রশিক্ষণপর্ব দেখে যেতে হয়। আকাশবাণী কি অখণ্ডনীয়?— কৃপীর এই প্রশ্নের উত্তরে মহামতি ব্যাস বলেন, কালের নির্দেশ বড় বিচিত্র, মানুষের উচিত তাকে শান্তচিত্তে গ্রহণ করা।

Advertisement

কৃপী দেখছেন, সত্যই দ্রোণ বড় শান্তচিত্তে গ্রহণ করেছেন কালের অমোঘ লিখনটি। অচঞ্চলচিত্তে মান্যতাই দিয়েছেন। তাই তিনি এত প্রসন্ন, এত স্বাভাবিক! দ্রোণপত্নী জানেন, শিক্ষার্থীর অঙ্গুলি কর্তন করে নেওয়ার সেই বহুবর্ষপ্রাচীন ও অনপনেয় কলুষটি সম্পর্কে তাঁর স্বামী অন্তরপীড়িত থাকেন নিরন্তর। এর বিপ্রতীপে, দৈব-ঘোষিত ঘাতককে স্বগৃহে আপ্যায়িত করে শস্ত্রশিক্ষা দিচ্ছেন আচার্য— ইতিহাসে এটিও কথিত থাকবে নিশ্চিত! দ্রোণের অন্তর্দাহ হয়তো কিছু শমিত হবে। তাই তাঁকে তৃপ্ত দেখায় ইদানীং।

...“এই চার পক্ষকাল গুরুগৃহে শাকান্নভোজন করে অতি কৃচ্ছ্রে অতিবাহিত হল তোমার, হে ধৃষ্টদ্যুম্ন!” অন্নে ব্যঞ্জন মাখতে মাখতে বললেন দ্রোণ, “আগামী কাল থেকে উত্তম উপাদেয় রাজভোগ!”

Advertisement

“আপনিও তো অর্ধরাজ্যের অধীশ্বর, আচার্য!” সুরসিক ধৃষ্টদ্যুম্ন সহাস্য প্রত্যুত্তর করে, “সে বিচারে, আপনার গৃহেও তো আমি রাজভোগই পেয়েছিবলা চলে!”

“অভ্যাস অব্যাহত রেখো পুত্র। তুমি শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষণ পেয়েছ, তোমার মেধা অতুলনীয়। নিত্য অনুশীলন করে তাকে ক্ষুরধার রেখো। যেমন খড়্গটিকেও, তেমন বিদ্যাটিকেও...”

ধৃষ্টদ্যুম্ন সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, সহসা কৃপীর ঈষৎ-কম্পিত কণ্ঠস্বর শুনে সে থেমে গেল।

“বৎস দ্রৌপদ! তুমি কি সত্যই...”

ধৃষ্টদ্যুম্ন গুরুমাতার দিকে তাকাল। কৃপীর মুখ বিবর্ণ, দৃষ্টি ত্রস্ত, ওষ্ঠ নীরক্ত ও কম্পমান। তিনি কয়েক মুহূর্ত অপলক চেয়ে থেকে, সামান্য জড়িত স্বরে বললেন, “সত্যই কি তুমি তোমার গুরুকে হত্যা করবে, কখনও?”

দ্রোণ ও ধৃষ্টদ্যুম্ন উভয়েই ক্ষণকাল তড়িদাহতের মতো বসে রইলেন, তাঁদের অন্নমুষ্টি হাতেই রয়ে গেল। কঠোর নিষেধ ছিল দ্রোণের— ধৃষ্টদ্যুম্নের গুরুগৃহবাসকালে কেউ যেন কখনও এই প্রসঙ্গ উত্থাপিত না করে!

বাস্তবিক, দুই মাস একটিও শব্দ সে বিষয়ে উচ্চারণ করেননি কৃপী। কিন্তু আজ তিনি উদ্গত অশ্রু রোধ করতে পারছেন না, অন্তরের আলোড়ন গোপন রাখতে পারছেন না আর! দীর্ঘ কাল অবরুদ্ধ উদ্বেগ-আতঙ্ক আজ তপ্ত দুগ্ধফেনের মতো পাত্র ছাপিয়ে এল!

মাথা নত করে মৃৎ-মূর্তির মতো বসে রয়েছে পাঞ্চালকুমার।

দ্রোণ সংবিৎ ফিরে পেয়ে তিরস্কার করলেন পত্নীকে, “ছি, শারদ্বতী! কত বার বলেছিলাম...”

কৃপী যেন শুনতেই পাচ্ছেন না! তাঁর মুখের রেখাগুলি ভঙ্গুর, কণ্ঠ বাষ্পবিকৃত, নেত্র ও নাসা প্লাবিত হচ্ছে, তিনি পুত্রসম যুবার সমক্ষে যুক্তকর হয়ে বসেছেন। কাঁদছেন আর বলছেন, “বলো না, পুত্র! তুমি পারবে? পারবে... গুরুর কণ্ঠে অস্ত্রাঘাত করতে, বলো?”

৪৭

ক্ষুধার্ত অগ্নির জিহ্বা অগণন। এখন তারা অভ্রলেহী হয়ে উঠছে। অরণ্যের এ-পার থেকেও মধ্যরাতের কৃষ্ণবর্ণ আকাশে স্পষ্ট দৃশ্যমান লুব্ধ শিখাগুলির আভা। গঙ্গার নির্জন তীরভূমি ধরে হাঁটতে হাঁটতে পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী এক বার পিছন দিকেতাকিয়ে দেখলেন।

অট্টালিকাটি দাউদাউ করে জ্বলছে। যে গৃহে বিগত কয়েকটি মাস তাঁরা অতিবাহিত করেছেন, আনন্দ-আহ্লাদ-ভোজন-শয়ন করেছেন যে সুন্দর প্রকোষ্ঠগুলিতে— দগ্ধ হচ্ছে সব। দহনশব্দ এত তীব্র যে, এত দূর থেকেও তা সহজশ্রাব্য। সাধারণ মৃত্তিকা, প্রস্তর এমনকি দারুনির্মিত ভবনও এমন হাহারবে ও লেলিহান শিখায় অগ্নিগ্রস্ত হয় না, অন্তত এত স্বল্পকালের মধ্যে তো নয়ই! এ গৃহ সাধারণ ভাবে তৈরি হয়নি। বংশ, শন, ঘৃত, বসা, লাক্ষা— এই সব তীব্র দাহ্যবস্তু ছিল ওই গৃহের উপাদান। এমন কৌশলে নির্মাণ করিয়েছিল পাপী পুরোচন— যাতে নিমেষে ছড়িয়ে পড়ে আগুন, সর্বত্র! নিদ্রাভঙ্গ হতে যেটুকু সময়, তার মধ্যেই অগ্নিবেষ্টন সম্পূর্ণ হবে, আর নিষ্ক্রমণের পথ মিলবে না!

প্রথম দিন থেকেই এ তথ্যটি জানা ছিল যুধিষ্ঠিরের। পুরোচনের সাদর আপ্যায়নে বারণাবতের অরণ্য-সংলগ্ন এই যে সুরম্য ভবনে তাঁরা প্রবেশ করছেন, এটি বস্তুত জতুগৃহ। তিনি ঘ্রাণ পেয়েছিলেন দাহ্যবস্তুগুলির।

পূর্বপ্রস্তুতি ছিল তাঁর। হস্তিনা থেকে তাঁদের যাত্রার ঠিক পূর্বমুহূর্তে বিদুর এই চক্রান্তের চূড়ান্ত সংবাদটি সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। তখন একান্তে ডাকার সুযোগ ছিল না, তাই প্রকাশ্যেই অন্যের অবোধ্য ম্লেচ্ছভাষায় জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবকে কয়েকটি সঙ্কেত দিয়ে দেন। তাতে ইঙ্গিত ছিল, তাঁদের গৃহে অগ্নিসংযোগ হতে পারে। রক্ষা পাওয়ার পন্থানির্দেশও ছিল। সুড়ঙ্গ-খনন।

যথাকালে গুপ্ত-খননকারীও নিযুক্ত হয়েছিল ক্ষত্তারই গোপন নির্দেশনায়। দহনমুহূর্তে সেই পরিখাতেই কুন্তী-সহ পাণ্ডবরা আত্মরক্ষা করেছেন, এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে অরণ্য পেরিয়ে জাহ্নবীতীরে উপনীত হয়েছেন নিঃশব্দে।

এখানে একটি নির্জন ঘাটে একটি ক্ষুদ্র কিন্তু দ্রুতবেগসম্পন্ন তরণী প্রস্তুত থাকবে, অদ্ভুতকর্মা বিদুর তারও ব্যবস্থা করেছেন। সেই নৌকোটির উদ্দেশেই এখন এই মধ্যরাতে অন্ধকার অরণ্যপ্রান্তে পদব্রজে চলেছেন রাজমাতা ও পাঁচ রাজকুমার।

কুন্তী একটি কাতরোক্তি করলেন। বিনিদ্র রজনী, প্রবল মানসিক উত্তেজনা, শত্রুভয়, শারীরিক কষ্ট। আর হাঁটতে পারছেন না। বললেন, “উফ্‌, ঘাট আর কত দূর, বাছারা?”

একমাত্র মহাবল ভীমসেন অক্লান্ত। অবশিষ্ট পাণ্ডবরাও তেমন অধিক কষ্টসহিষ্ণু নন, কাতর তাঁরাও। মায়ের কষ্ট দেখে তাঁরা ব্যাকুল হয়ে উঠলেন, কিন্তু প্রতিকারে অপারগ। এখানে থামাও চলে না, শত্রুপুরী থেকে যথাসম্ভব দ্রুত দূরে যেতে হবে।

ভীম কথাটি না বলে মাতাকে নিজ স্কন্ধে তুলে নিয়ে বললেন, “চলো হে সবাই। আর কারও আবশ্যক হলে বোলো, ক্রোড়ে নিয়ে নেব’খন!”

অনেক ক্ষণ নীরবে হাঁটার পর নকুল বললেন, “এত ক্ষণ নিশ্চয় বারণাবতের নাগরিকরা জ্বলন্ত ভবনের চারিপাশে সম্মিলিত হয়েছে। নিশ্চয় প্রবল হয়ে উঠছে কোলাহল হাহাকার বিশৃঙ্খলা!”

“সকলেই বুঝতে পারবে এ দুর্যোধনের চক্রান্ত!” সহদেব বললেন, “সর্বসমক্ষে পুরোচনের ভূমিকাটিও স্পষ্ট হবে...”

ভীম একটু নিষ্ঠুর হেসে টিপ্পনী দিলেন, “দুর্যোধনের নামে অভিসম্পাত-বৃষ্টি, ধৃতরাষ্ট্রের মুণ্ডপাত! আর ‘পাপিষ্ঠ পুরোচনকে ধরে আনো’ বলে চিৎকার করছে ক্রুদ্ধ জনতা— এ আমি মনশ্চক্ষে দেখতেই পাচ্ছি! আগুন নিভলে অবিশ্যি দেখতেই পাবে পুরোচন কী পুরস্কার পেয়েছে...”

রাজ্ঞী কুন্তী আজ সন্ধ্যায় এক ভোজন-অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। রবাহূত দরিদ্র প্রজা এমনকি অরণ্যবাসী অনার্যরাও বঞ্চিত হয়নি। ভোজন-ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল পুরোচনকে। সারা দিনের পরিশ্রমের শেষে সে ক্লান্ত ছিল, তাই যুধিষ্ঠিরের প্রস্তাবে নৈশাহারের পর নিজের গৃহে না ফিরে পাণ্ডব-ভবনেরই অতিথি-প্রকোষ্ঠে বিশ্রামমগ্ন হয়ে পড়ে। ভীম তার পানীয়ে চেতনানাশক রসায়ন মিশিয়ে দিয়েছিলেন। জ্বলন্ত লাক্ষাগৃহ ত্যাগের আগে, অগ্নিময় মশালটি যখন সেই প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করছেন বৃকোদর— তখনও সে ঘোর নিদ্রায় নিমজ্জিত!

হ্যাঁ, আগুন তো বৃকোদরই স্বহস্তে লাগিয়েছেন। পুরোচনের পরিকল্পনা ছিল, আর কয়েক দিনের মধ্যেই সেই কাজটি করবে সে স্বয়ং— তার আগেই পাণ্ডবরা তাঁকে অতিক্রম করে ফেললেন! হতভাগ্য ভেবে নিয়েছিল দীর্ঘকাল বারণাবত-বাসের পর পাণ্ডবরা নিঃসংশয়ে তাকে বিশ্বাস করেছেন, এ বার সে যখন ইচ্ছা তাঁদের পরপারে পাঠাবে!

অন্ধকারে অর্জুনের কণ্ঠ শোনা গেল এ বার। যেন একটু ক্ষুব্ধ।

“কিন্তু... নিষাদপুত্রদের দগ্ধ করা কি খুব আবশ্যক ছিল? তাদের জননী-সহ?”

সামান্য নীরবতা। তার পর যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, “ছিল, প্রিয় ফাল্গুনি! তুমি নিজেও যথেষ্ট জানো সে প্রয়োজনের কথা। পাঁচটি পুরুষ ও একটি স্ত্রীলোকের দগ্ধ দেহ ওই গৃহের অভ্যন্তরে আবিষ্কৃত হওয়া চাই... তবেই তো জনমানসে নিরঙ্কুশ ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হবে!”

ক্রমশ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন