কথা বলতে বলতে তারা শিয়ালদা স্টেশনে চলে এসেছিল। নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য শিয়ালদা স্টেশনের জনাকীর্ণ চত্বরের চেয়ে ভাল জায়গা পল্টনের জানা নেই। অনেক ক্ষণ ধরে দুজনে বুঝিয়েছিল তাকে। তবু যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না পল্টনের। হিজড়েদের ব্যাপার সে ঠিক জানত না তখন। রাস্তাঘাটে, গঙ্গার ধারে, ধর্মতলা পাড়ার আনাচে-কানাচে যে ওদের দেখেনি তা নয়, কিন্তু কখনও কাছে ঘেঁষেনি। সেই হিজড়েদের পাল্লায় পড়েছে রতন! সে নিজেও নাকি হিজড়ে! কিন্তু হিজড়েদের কেমন কাঠ-কাঠ পুরুষালি চেহারা হয়। এ তো দারুণ সুন্দরী একটা মেয়ে!
এই পরিবর্তনটা কী ভাবে হয়েছিল, সেটা আজও ঠিক জানে না পল্টন। তবে কানাঘুষোয় শুনেছে, এটা ঘটিয়েছিল বুলাকিদাই। এর জন্য নাকি বহু কাঠখড় পুড়িয়ে খিদিরপুরের কোনও প্রাইভেট নার্সিংহোমে অপারেশনের ব্যবস্থা করেছিল বুলাকিদা। ডাক্তারির ব্যাপারটা ঠিক বোঝে না পল্টন, কিন্তু তাদের বনগাঁর বাড়িতে শুনেছে, কোন সার্জেন নাকি রত্নাকে দেখে বলেছিলেন, সে আসলে মেয়েই। প্রকৃতির কোনও অপ্রকৃতিস্থ খেয়ালে নাকি তার শরীরে ক্রোমোজোম বলে একটা জিনিসের গোলমালে সে নারী-জননেন্দ্রিয়র সঙ্গে ছোট্ট একটা পুরুষাঙ্গের মতো অনভিপ্রেত একটুখানি ঝুলন্ত অস্থিচর্ম নিয়ে জন্ম নিয়েছিল। মফস্সল শহরে সেই শিশুকে পুত্রসন্তান বলে ভুল করেছিল সকলে।
এখন রত্না নারী না পুরুষ, তা নিশ্চিত করে বলতে পারবে না সে। সে বিষয়ে রত্না নিজেও বোধহয় পরিষ্কার নয়! সমাজ তাকে হিজড়ে বলেই দেখবে বরাবর। যেমন দেখেছে বুলাকিদাকে। ওই আর এক জন মানুষ। সে নারী না পুরুষ, কোনও দিন কেউ সাহস করে জিজ্ঞেস করে উঠতে পারেনি বুলাকিদাকে। কোনও কিছু অপছন্দ হলে একটা স্থির, পাথরের মতো চোখের দৃষ্টি ছিল বুলাকিদার। পলক পড়ত না। সেই দৃষ্টিকে ভয় পেত রত্নাও। আর কোনও কিছু বলতে হত না কাউকে। তবে বেশির ভাগ সময় মানুষটা কিন্তু হাসিখুশিই থাকত। মাঝে মাঝেই মশকরা করে বলত, ‘হামে হিজড়া আছে!’
বনগাঁর বাড়িতে আশ্রিতের সংখ্যা কম নয়। সব মিলিয়ে পঁচিশটা পাত পড়ে সকাল-বিকেলে। কোলাহলমুখর বাড়িটায় জীবন আবর্তিত হত দুটি মেরুকে কেন্দ্র করে— রত্না আর বুলাকিদা।
সেই বুলাকিদা নেই, ব্যাপারটা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না পল্টন। আজ একটা হেস্তনেস্ত সে করবেই।
প্রথম দিনই বুলাকিদা তাকে সঙ্গে করে বনগাঁয় নিয়ে আসতে চেয়েছিল। রাজি হয়নি পল্টন। শিয়ালদা পাড়া চট করে ছাড়বে না সে। আর ফটিকদার ডেরায় তার যাওয়া-আসা বন্ধ হয়ে যাক, সে কিছুতেই চায় না। সেখানে তখন তীব্র, গোপন এক আকর্ষণ তার।
ঘটনাটা শুরু হয় বছর দুয়েক আগে, এক বর্ষার রাত্রে! সে দিন বাড়ি ছিল না ফটিকদা। অপরাধ-জগতের কোন অলিগলিতে ফটিকদার বিচরণ, তার সম্পূর্ণ চিত্রটা দলের কেউই জানত না। কাউকে বলত না ফটিকদা। তবে মাঝে মাঝেই যখন দু’তিন দিনের জন্য উধাও হয়ে যেত, তখন সবাই বলত— অপারেশনে গেছে। কী অপারেশন, কোথায়, এ সব নিয়ে কারও কোনও প্রশ্ন করার সাহস ছিল না।
কোনও কোনও দিন মদ খেয়ে চুর হয়ে ফিরে বউকে কারণে-অকারণে প্রচণ্ড মারত ফটিকদা। সে সব মুহূর্তেও দলের কেউ তাকে কিছু বলতে সাহস পায়নি কোনও দিন। অথচ অত অত্যাচার সহ্য করেও জয়াবউদি কখনও গলা তুলত না। দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস করে বলত, ‘মারো, আরও মারো। এ ছাড়া মর্দানি দেখাবার আর তো উপায় নেই তোমার!’ এ কথাটায় পাগলের মতো গজরাতে থাকত ফটিকদা। হাতের সামনে যা পেত, ছুড়ে ভেঙে ফেলত।
এই তাণ্ডবের মাঝে শীতল ছায়ার মতো স্থির থাকত জয়াবউদি। উদাস হয়ে ঘরের মাঝামাঝি কোনও একটা অনিশ্চিত দূরত্বের দিকে তাকিয়ে থাকত। গরিব ঘরের মেয়ে, গরিব ঘরের বউ। কিন্তু কী অসম্ভব, গভীর কালো দুটো চোখ! টলটলে দিঘির নাব্যতা সেই চোখে। রং খুব ফরসা ছিল না জয়াবউদির, খুব কালোও না। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন নিখুঁত মমতায় গড়েছেন ঈশ্বর। ঢলঢলে নদীর মতো জোয়ার-ডাকা যৌবন। কিন্তু রূপসি নারীর কোনও দেমাক নেই। সব মিলিয়ে অসামান্য একটা ব্যক্তিত্ব ছিল জয়াবউদির। কিন্তু তখন কতই বা বয়স মেয়েটার, বড়জোর উনিশ-কুড়ি! সামান্যই বড় পল্টনের থেকে।
সে রাত্রে জয়াবউদিই থেকে যেতে বলেছিল পল্টনকে।
‘আজ তো পাগলের মতো ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে যাবে কী করে ঠাকুরপো?’
‘ফটিকদা কখন আসবে?’ সরল বিশ্বাসে প্রশ্ন করেছিল পল্টন।
‘ও কি আর আজ ফিরবে? এই ঝড়-জলে? মনে তো হয় না!’
‘তা হলে?’
‘তা হলে কী? ও না থাকলে তুমি থাকোনি নাকি আগে? ও ঘরে বিছানা করে দেব তোমায়।’
রাজাবাজারে একটা বহু পুরনো দোতলা বাড়ির এক কোনায় দুটো ঘর আর এক চিলতে রান্নাঘর নিয়ে ছিল জয়াবউদির সংসার। নীচে এজমালি কলঘর আর চৌবাচ্চা।
ঘরে সবুজ রঙের দেওয়াল। টিউবলাইটের ফ্যাটফেটে আলো। খাটের পায়ার তলায় ইট দিয়ে উঁচু করা। নীচে সস্তার টিনের ট্রাঙ্ক, জাবদা সুটকেস। অপরিসর জায়গাটুকুও পরিপাটি করে সাজানো। বিছানার ফুলকাটা চাদরটা টানটান করে পাতা। ঘরের কোনায় সেলাই মেশিনটা একটা লেসের কাজ করা সুজনি দিয়ে ঢাকা। দেওয়ালে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ছবির ফ্রেমে, কাচে এতটুকু ধুলো জমে নেই। অন্য ঘরটায় কোনও আসবাব নেই, শুধু সস্তার দুটো প্লাস্টিকের লাল চেয়ার আর একটা প্লাস্টিকের সাদা, ছোট টেবিল। জয়াবউদির হাতের ছোঁয়ায় সব চকচকে পরিষ্কার।
সে দিন রান্নাঘরে বসে খেয়েছিল দুজনে। ভাত, আলু-কুমড়োর একটা ছেঁচকি আর ডিমের ডালনা। অমৃত। সামনের ঘরের চেয়ার-টেবিল এক পাশে সরিয়ে পরিপাটি করে বিছানা করে দিয়েছিল জয়াবউদি।
‘নীচে কলঘরে বালতিতে জল তোলা থাকে। সিঁড়ির দরজার পাশে গামছা টানানো থাকে, লাগলে নিয়ে যেও,’ বলে নিজের ঘরের দরজা যখন বন্ধ করেছে জয়াবউদি, তখনও অঝোরে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। সামনের দোকানটার টিনের ছাদে বৃষ্টির তবলা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিল পল্টন।
নরম, তীব্র আশ্লেষে যখন ঘুম ভাঙল, তখন কত রাত পল্টন জানে না। টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম রেলগাড়ি তখনও অবিশ্রাম। উত্তপ্ত ঠোঁটের স্পর্শ গালে, ঘাড়ে, গলায়। গলিত লাভার হলকা।
‘ক্... কে... কী...’ ধড়মড় করে উঠে বসতে গিয়েছিল পল্টন।
‘শ্-শ্-শ্...’
নরম হাতে আলতো করে ধরেছিল চুলের মুঠি। টেনে নামিয়ে এনেছিল তাকে সুডৌল স্তনের উষ্ণতায়। পল্টন তখন জয়াবউদির শাড়ির খসখস, চুলে জবাকুসুম তেলের মিষ্টি গন্ধে হারিয়ে যাচ্ছে। শরীরের প্রতিটি কোষে ছলকে উঠছে উন্মাদনা! দুজনে দুজনকে আলিঙ্গন করে আছে। ভিজে অন্ধকার ভরে উঠেছে তপ্ত নিশ্বাসে। উঠে বসেছে দুজনেই, ছবির বইয়ে দেখা খাজুরাহোর মূর্তির ভঙ্গিমায়। পল্টনের কোলে উঠে বসল জয়াবউদি। শাড়ির নরম জমির স্পর্শ পল্টনের তলপেটে। অভ্যস্ত হাতে আলগা হল কাপড়ের বাঁধন। পল্টনকে আঁকড়ে ধরে তপ্ত নিশ্বাসে নিজের শরীরকে ঠিক জায়গায় নিয়ে গেল জয়াবউদি।
ষোলো বছরের কিশোর দমবন্ধ আবেগে তিলে তিলে ডুবে গেল বিশ বছরের গৃহবধূর কামার্ত উষ্ণতায়। দিনের বেলায় জলাশয়ের মতো শান্ত রূপ দেখা যায় জয়াবউদির!
‘আরে, আপনি এখনও বসে আছেন?’
চিন্তায় যতি পড়ল পল্টনের। ওসি সাহেব ফিরে এসেছেন। মাথার টুপিটা খুলে টেবিলের উপর ছুড়ে ফেলে দিলেন। পল্টন চট করে এক বার দেওয়ালের ঘড়ির দিকে তাকাল। প্রায় পৌনে চারটে। মানে সে আড়াই ঘণ্টা ঠায় বসে আছে!
‘আপনি তো একেবারে নাছোড়বান্দা দেখছি! বললাম না এখন হবে না!’
‘এক বার যদি একটু চেষ্টা করে দেখেন স্যর? আপনারা যা যা বললেন, সব ডকুমেন্ট তো নিয়ে এসেছি স্যর। মিসিং পার্সন রিপোর্ট, ভোটার আই-ডি, সব।’
‘আরে এখন হবে না। মাসখানেক পরে আসবেন।’
‘মাসখানেক তো অনেক দিন স্যর।’
আজ সকালে চিত্তরঞ্জনে এসে নেমেছে পল্টন। বুলাকিদার ডেডবডি এখনও মর্গে পড়ে আছে। সকালে এসেই এক বার হাসপাতালের মর্গে ঘুরে এসেছে। তার পর থেকে জিআরপি’র এই অফিসে ধর্না দিয়ে পড়ে আছে। ওসি ভদ্রলোকের নাম অলকেশ লাহিড়ী। এঁর নো-অবজেকশন ছাড়া বডি পাওয়া যাবে না। কিন্তু ইনি কোনও কথা শুনতেই রাজি হচ্ছেন না। কেন, ঠিক বুঝতে পারছে না পল্টন। সে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ঘুষের কথাটাও তুলেছে, কিন্তু ভদ্রলোক পাত্তাই দেননি। ভদ্রলোক ঠিক কী চান, ঠিক ধরতে পারছে না পল্টন। তাই তার বারে বারে মনে হচ্ছে রত্নার কথা। রত্না এ সব ব্যাপার খুব ভাল বুঝতে পারে। কথাবার্তাতেও খুব চৌকস।
‘বললাম তো, মাসখানেক পরে আসবেন, বডি নিয়ে যাবেন।’
‘স্যর, একটু কনসিডার করা যায় না? অনেক দূর থেকে আসছি স্যর।’
‘আরে আপনি অনেক দূর থেকে আসছেন আর আমরা কি এখানে বসে আঙুল চুষছি নাকি? সামনে কী আসছে জানেন?’
‘স্যর?’
‘আরে কয়েক সপ্তাহ পরে কী আসছে জানেন? খবর রাখেন কিছু? কাগজ পড়েন? টিভি দেখেন?’
‘কয়েক সপ্তাহ পরে? মানে...’
‘স্বাধীনতা দিবস। এ বারে স্বাধীনতার ষাট বছর হতে চলেছে। খবর রাখেন এ সব?’
‘না... মানে স্যর... স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে ডেডবডির কী সম্পর্ক?’
প্রশ্নটা কি একটু বেয়াড়া শোনাল? মনে মনে জিভ কাটল পল্টন।
‘সম্পর্ক এই যে, স্বাধীনতা দিবসে বড় অনুষ্ঠান হয় আমাদের। এ বারে ষাট বছর বলে বিরাট করে ফাংশন হবে। সে সব নিয়ে আমরা সবাই খুব ব্যস্ত। এখন কি একটা হিজড়ের ডেডবডি নিয়ে নাচানাচি করার সময় আছে আমাদের? নিজেই তাকিয়ে দেখুন না, চার দিকে কেউ কি বসে আছে দেখছেন?’
‘না, মানে স্যর, আপনি ব্যস্ত মানুষ, ঠিকই স্যর। কিন্তু একটা নো-অবজেকশনের তো মামলা...’
‘আরে নো-অবজেকশন তো দিলেই হল না। ইনভেস্টিগেশন শেষ হতে হবে তো...’
‘কীসের ইনভেস্টিগেশন?’
‘বাহ্। ট্রেনের কামরায় এক জনের এ রকম হঠাৎ মৃত্যু হল, তার তদন্ত হবে না?’
‘স্যর, ইনভেস্টিগেশনের কথা তো আগে...’
‘আগে কী? আগে শোনেননি? তা আপনার পারমিশন নিয়ে ইনভেস্টিগেশন হবে নাকি? আচ্ছা একটা কথা বলুন তো?’
‘কী কথা, স্যর?’
‘বডি আপনি চাইছেন, আপনার রিলেটিভ বলছেন, চাইতেই পারেন। কিন্তু বডি নিয়ে কী করবেন আপনারা?’
‘মানে, স্যর? বডি নিয়ে একটা সৎকার তো করতেই হবে আমাদের। ধর্মীয় প্রথা তো স্যর।’
‘ধর্মীয় প্রথা? ডেথ সার্টিফিকেট তো আপনার নেই, পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ট্র্যান্সসেক্সুয়াল না হিজড়া কী যেন একটা লেখা আছে। কোন ক্রিমেটোরিয়ামে এই বডির সৎকার হবে? কোন কবরখানায়?’
‘অ্যাঁ?’
এটা ভেবে দেখেনি পল্টন! সত্যিই কি বুলাকিদার দেহ কেউ দাহ করতে দেবে না? নাকি এটা নিছকই তাকে তাড়াবার জন্য বলছেন পুলিশের এই কর্তাটি? হিজড়েদের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হয় না, এটা দেখেছে পল্টন। ভর্তিই করতে চায় না। ডাক্তার পাওয়াও খুব অসুবিধা। বনগাঁর ওই বাড়িটা চিহ্নিত, কোনও ডাক্তার চট করে আসতে চায় না। নেহাত পাড়ার এক জন তরুণ ডাক্তার আছেন, একটু আদর্শবাদী টাইপ, কারও অসুখ করলে তাকেই ডেকে আনে পল্টন। খুব সজ্জন ছেলেটি, মন দিয়ে চিকিৎসা করে। না হলে বিপদ হত। কোনও ইস্কুলে, বা গানের ইস্কুলে হিজড়েপল্লির কারও ভর্তি হওয়ার তো কোনও প্রশ্নই নেই।
ক্রমশ