ছবি: সুমিত্র বসাক।
আই নো হোয়াট ইউ ডিড লাস্ট সামার! চিড়বিড় হিসহিস গজগজ করে বলেছিলেন: উফ্ফ্ কী গরম! জ্বলে গেলুম, পুড়ে গেলুম! বলেছিলেন, এত্ত গরম বাপু জম্মে দেখিনি! বলেছিলেন, এ বছরটা যেন একটু বেশি বেশি! কী, বলেছিলেন কি না? আরে বাবা, ফি-বছরই এমন গরমটাই পড়ে। আগের বছরের নিউজ দেখুন, বাঁকুড়া সেই বিয়াল্লিশ, শ্রীনিকেতন চুয়াল্লিশ, পুরুলিয়া সাতচল্লিশ পয়েন্ট পাঁচ। তো? তফাতটা কী হল? ডাক্তারের সেই এক নিদান— হালকা সুতির জামা পরুন। ছাতা, সানগ্লাস মাস্ট। রোদ মাথায় ঘরে ঢুকে নো ফ্রিজের জল ঢকঢক। বছরকে বছর খবরকাগজের রিপোর্ট অপরিবর্তনীয় হতে পারে, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনও অজোনিত্যঃশাশ্বতোহয়ংপুরাণো, আর গরমকালটা সেম জ্বালাময়ী হলেই দোষ?
বরং গরমকে এনজয় করতে শিখুন। হা-বৃষ্টি, ঘর্মভীরু পাবলিকের খাতায় নাম লেখাবেন না। ওদের সবেতেই তাং-করা স্বভাব। রক্তে দ্বিচারিতা, বোন ম্যারোতে কনট্রাডিকশন। এ দিকে টাকার গরম দেখলে যুগপৎ লাল ও দীর্ঘশ্বাস ফেলবে, রূপের গরম দেখলে বলবে, ‘ডুড, কেয়া অ্যাটিটুড!’ অথচ মেরেকেটে মাস-তিনেকের এই যে গ্রীষ্ম, সে কিঞ্চিৎ গরম দেখালেই তেড়ে গাল পাড়বে। কেন রে বাবা? এই সিজনটাকে একটু বোঝার চেষ্টা কর! গরমকালটা সোশালিস্টদের মতো। সাম্যবাদী। বউ থেকে বিধায়ক, রিকশাওয়ালা থেকে ঝুনঝুনওয়ালা, সব্বাইকে সমান জ্বালাবে। আই মিন তাপ দেবে আর কী। বর্ষার মতো ফিক্ল-মাইন্ডেড না, দমদমে তেড়ে ঢাললুম তো কবি সুভাষে ক্যাঁচকলা! শরৎ আয়ারাম-গয়ারাম, হেমন্ত মিউজিয়াম, আর শীত? ওর স্টেটাস তো হলি-ছবিতে বলি-অভিনেতার রোল। স-শেড ক্যামিয়ো, এ-দিকে চোখেই পড়ে না। এদের পাশে গ্রীষ্মকে দেখুন, পুরো সচিন তেন্ডুলকর। ভরভত্তি প্রেজেন্স। ডাগ আউটে বসে আছে, তাতেই কাঁপাকাঁপি। আবার এত ক্যারিশ্মা নিয়েও কেমন সাধুসন্নেসির মতো স্বভাব। মন-মুখ এক, নির্বিকার। সকাল ন’টাতেও ঝাঁ-ঝাঁ করছে, দুপুর দুটোয়ও ঠা-ঠা।
আর গরম না থাকলে গরমের ছুটিটা কোত্থেকে পেতেন শুনি? স্বয়ং কবি বলে গেছেন, ইফ সামার কাম্স, ক্যান সামার ভেকেশন বি ফার বিহাইন্ড? গরমকাল হল তীর্থ, ইশকুলের মাস্টারমশাইরা সেই তীর্থের কাক, আর বসে থাকেন চাতকপ্রায় সতৃষ্ণ, আমাদের ছুটি ছুটি আজ নেব লুটি! এখন আবার চার মাস আগে থেকে ট্রেনের টিকিট কাটা যাচ্ছে, তাই এ বার গরমে শিমলা না পিংলা, রাঁচি না করাচি, জানুয়ারিতেই বুক্ড! ছাদ ঢালাই থেকে ঘর সারাই, সেও গরমের ছুটিতে। এই সামারে কী কচ্ছিস? বিয়ে করছি! পাত্র নিউ জলপাইগুড়ি থেকে নব বারাকপুর এসে নববধূকে নিয়ে সাতপাক ঘুরে সাতপুরায় হনিমুন সেরে ফের চাকরিতে জয়েন, সব ওই গরমের ছুটিতে। কাজপাগল হেডমাস্টার বউকে বলছে: শোনো, ক্যালেন্ডার দেখে কনসিভ কোরো, গরমের ছুটিতে বাবুটা এসে গেলে ক’টা দিন তাও ঘরে থাকতে পারব! মমতাময়ী সরকার পর্যন্ত কেমন পনেরো দিনের ঘাড়ে এক্সট্রা সাত দিনের ছুটি অ্যাড করে দিচ্ছেন, যা রে ব্যাটা, সামার কোটা! এই সিজনটাকে যে ভ্যানিশ করতে চায়, সে সত্যিই দুষ্টু লোক।
কী বললেন? ইলেকট্রিক বিল বেশি আসে? ঘরের সব পাখা বনবন, তাতেও হয় না, দিনরাত এসি চালাতে হয়? বাঃ, আর ও-দিকে যে গিজার চালাতে হয় না? কল খুলতেই উষ্ণ প্রস্রবণ কলকলাচ্ছে! বুড়ো শ্বশুরমশাইয়ের গরম জলের অভ্যেস, বচ্ছরের এই তিনটে মাস আপনাকে গজগজ করতে করতে জল গরম করতে হয় না। দুপুরের দিকটায় সসপ্যানে জল ধরে ডিম চুবিয়ে দেখুন, সেদ্ধ হবেই, গ্যারান্টি! আর নিজেই যদি হন এসি কোম্পানির মালিক, তা হলে আপনাকে কে পায়। দোকানের সামনে পিলপিল আইপিএল-এর টিকিট লাইনকেও টেক্কা। এই গরমে যখন সব্বার ঘিলু ঘুলিয়ে ঘ্যাঁট, শুধু আপনিই বলবেন, হট ইজ দ্য নিউ কুল, ম্যান! সিইএসসি বা মোবাইল কোম্পানির কর্তা হলেও আপনার লাভ হি লাভ। লোকে তেড়ে ফ্যান চালাক, এসি লাগাক, মাথাগরম করে ফোনে ডবল গাঁক গাঁক করুক, আপনি গুনগুনান: আজ দিন হ্যায় সানি সানি সানি সানি সানি সানি!
বচ্ছরের আর কোন সময়ে এমন চোখের সুখ হয়, বলুন! এই যে পথে নামতেই অ্যাঁক, বাসে উঠতেই ছ্যাঁক, মেট্রোয় ভ্যাপসা, অটোয় ঝাপসা, এই বেবাক তাপজ্বালা হট করে মিলিয়ে যায় হটপ্যান্টবতীদের দেখে! সবাই কেমন এট্টুসখানি সাইজের পোশাক পরে ঘুরছে-ফিরছে! আর কোনও সিজনে বলতে পারবেন, স্মল ইজ বিউটিফুল? শীতকালটা বোরিং, আনখভুরু জাব্বাজোব্বা চাপিয়ে ঘোরে সবাই। বর্ষা এল তো সঙ্গে জুড়ল ছাতা। যা-তা! এদের পাশে রাখুন এই ঋতুটাকে। দেখুন, গরমে কেমন মরমে-শরমে ওইটুকু কাপড় লেপটে আছে গায়ের নরমে! সাক্ষাৎ হেমেন মজুমদারের পেন্টিং, শুধু পোস্ট-মড বসনে! সাউথ সিটিতে লোক গিজগিজ, আপনি ভাবছেন ফ্রিতে এসি খেতে? আজ্ঞে না। সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে— জীবনানন্দের কোব্তে সার্থক। ছেলে দেখছে ট্যাঙ্ক টপ সি-থ্রু, মেয়ে দেখছে স্যান্ডো গেঞ্জি ভি ত্ রু। চক্ষে আমার তৃষ্ণা ওগো, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।
বাড়ির গিন্নিরাও আরামে। কাজ বলতে তো অফিস যাওয়ার আগে বাবুর ঝোলভাতের বন্দোবস্ত, সে-ও করবে মিনতির মা। তার পর, ঘড়ির কাঁটা আটটা পঞ্চান্ন ছুঁতেই, মুখপোড়াটা গেছে? আমপোড়ার শরবত একটু কোরো তো মাসি! কত্তা যত তাড়াতাড়ি পারেন ব্রিফকেস গুছিয়ে অফিস, কাজ নেই তো কী, এসি তো আছে! ফিরতে বহুত রাত, মিটিং ছিল কিনা! গিন্নির আরও মস্তি: সন্ধের সিরিয়ালগুলো লাইন দিয়ে দেখা যাবে। ওঁর তো আবার ঘরে ফিরে হাকুচ্ছিত ইংরিজি নিউজ বা ঠাস-ঠাস টেনিস ছাড়া কিছু পোষায় না! ও-দিকে বাবুমশাইও কম যান না, গাড়িতে বসেই বান্ধবীকে মেসেজ: সি ইউ ইন দি ইভ, হানি। অলরেডি ফিলিং হট! মিটিংটা কীসের ছিল, তা না বললেই দিব্যি ইতি গজ!
ব্যক্তিগত মচ্ছবের কথা যদি-বা ছাড়ি, কেমনে ভুলি, এই ঋতু গোটা বাঙালি জাতটাকেই কেমন উৎসবের মওকা করে দিয়েছে! বাঙালির ‘হ্যাপি বেঙ্গলি নিউ ইয়ার’, ‘সুবো নোবোবোরষো’টা তো এই ঘেমো গরমেই, বাপ! কই তখন তো রোঁয়া ফুলিয়ে বলেন না, বোশেখটাকে আশ্বিনে সেলিব্রেট করলে হয় না! তখন তো ঘেমে নেয়েও কী আকুলিবিকুলি, এসো হে বৈশাখ! বা, এই যে জামাইষষ্ঠীতে শাশুড়িকে জপিয়ে গাড়ি-বাড়ি-টাকার কাঁড়ি-মেনল্যান্ড চায়না-রাজারহাটের জমির বায়না বাগান, সে আনন্দহিল্লোল কম কীসে? যে-সব কবি লেখে এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস, তারা কিস্যু জানে না। আমাদের এই হট অ্যান্ড ট্রপিকাল কান্ট্রির তাবড় হট অ্যান্ড টপিকাল কবিরা এই হট ঋতুতেই জন্মেছেন। রবীন্দ্রনাথকে দেখুন। সূর্য টপে, রবিও! নজরুলকে দেখুন। জষ্ঠি মাসের ওই গরগরে গরমে জন্মালেন বলেই না অমন বিদ্রোহী! ও, আর এক জন হট পার্সোনালিটির কথা মনে পড়ল। শিবঠাকুর। একটু প্রিমিটিভ সাবঅল্টার্ন টাইপ, কিন্তু চৈত্রের চাঁদিফাটা তাতের মতোই তেজিয়াল, র’! আর নিজের ইমেজের সঙ্গেই খাপ খাইয়ে, ওঁর উৎসবটাও হয় ওই সংক্রান্তির দিনটায়, তাই না? এমনকী দুর্গাপুজোটাও তো অরিজিনালি হাফ-গরমকালেই হত। দশরথের ব্যাটা ট্রান্সফার করিয়ে দিলে!
গরমের এমন কমল মিত্রসুলভ গাম্ভীর্য, রোগঅসুখও ‘আঁই বাপ!’ বলে পলায়তি। পেটের অসুখ, সে আবার রোগ? ও তো বাঙালির বছরে দু’বার হয়, ছ’মাস করে থাকে। ও-দিকে আর সব সিজনে দেখুন! শীতে জর্জর হাঁপানি, বসন্তে জ্বর-জ্বর কাঁপানি। বর্ষা তো রোগের হেডকোয়ার্টার্স! আর গরমে? হয় কেবল হিট-স্ট্রোক, সান-স্ট্রোক। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠাস করে পড়ে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। কী সুন্দর যন্ত্রণাহীন! তেতো বড়ি-পাঁচন গেলা নেই, ভেন্টিলেশন নেই, কেমো নেই, যন্ত্রণায় ছটফটানো নেই, কাঁড়ি টাকা খসিয়ে পরিবারসুদ্ধু সবার গুচ্ছের অভিশাপ কুড়োনো নেই। ঘেমো ঋতুও এমন ঘ্যামা মৃত্যু নিয়ে আসে! উপরি পাওনা সরকারি ক্ষতিপূরণ, ফ্যামিলি পসথুমাস ধন্য ধন্য করবে!
আর বেঁচে থাকলেও, এই গরমই আপনার মুশকিল-আসান। পৃথিবীর যত্ত উধো-র যাবতীয় পিন্ডি চাপাতে পারেন এই বুধো-র ঘাড়ে। গার্লফ্রেন্ড অতিমাত্রায় ন্যাকামো করছে? গুছিয়ে গালাগাল দিন। পরে হোয়াট্সঅ্যাপ করলেই হল, সরি, ইট ওয়াজ টু হট দ্যাট ডে (আঠাশটা ইমোটিকন জুড়তে ভুলবেন না)। বস-এর প্রতি অনেক দিনের রাগ এরিয়ার, ক্যারিয়ার পাচ্ছে না? একটা ঝনঝনে গরম-দিনে স্যাটাস্যাট স্ট্রেট-ব্যাটে ঝেড়ে দিন। পরে মেল করুন: দ্য ননসেন্স ওয়েদার টুক আ টোল অন মাই সেন্সেস... হট ক্লাসমেটকে প্রোপোজ করে প্রত্যাখ্যাত? পরের দিন কলেজে হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে বলুন, উফ্ফ এই গরমে কাল কী বলতে কী বলে ফেলেছি, আর তুইও যেমন, ফান-ও বুঝিস না! চল অ্যাকোয়াটিকা যাবি? এই যে বিধানসভায় মন্ত্রীকে শুধোনো হল মুরগি নিয়ে প্রশ্ন আর উত্তরে এল ছাগলের তথ্য, এ তো গরমের জন্যেই! মেট্রোর ওয়েবসাইটে জলজ্যান্ত শিল্পীর নামের আগে ‘লেট’ জুড়ে গেল— যিনি লিখছিলেন তার হঠাৎ গরম লেগে মাথাটাথা আউলে গেছিল বলেই না! ট্রাফিক বিধি ফর্দাফাঁই করে উলটে পুলিশকে রদ্দা? আহাহা, ওই গরমে মাথা ঠিক থাকে? হোয়াট্স ইন আ ভাইঝি? ইট’স ব্লাডি সামার, ভাইজি! জীবনের সব হোঁচট, হেঁচকি, আছাড়, ঠোক্কর, ঢোক, ঢেকুরের সঙ্গে মিশিয়ে নিন গরমকে। বেইজ্জতি থেকে বাঁচবেন।
iwritemyright@gmail.com