আবিষ্কার করে নারী, কৃতিত্ব নিয়ে যায় পুরুষ

এরই নাম মাটিল্ডা এফেক্ট! উনিশ শতকে আমেরিকার নারী আন্দোলনের কর্মী মাটিল্ডা জোসলিন এই বঞ্চনার কথা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছিলেন। ঊর্মি নাথএরই নাম মাটিল্ডা এফেক্ট! উনিশ শতকে আমেরিকার নারী আন্দোলনের কর্মী মাটিল্ডা জোসলিন এই বঞ্চনার কথা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছিলেন। ঊর্মি নাথ

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৭ ০০:৪৫
Share:

পথপ্রদর্শক: মাটিল্ডা জোসলিন

নিউ ইয়র্ক, ১৮৫২। ‘ন্যাশনাল উইমেনস রাইট্‌স কনভেনশন’-এ ২৬ বছরের মেয়ে মাটিল্ডা জোসলিন গেগে প্রথম বার জনসমক্ষে কিছু বলবেন। জীবনের এই প্রথম বক্তৃতায় এমন কিছু তথ্য তুলে ধরেছিলেন মাটিল্ডা, যা তখন পর্যন্ত ইতিহাসের কাছে ছিল অজানা। তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শ্রোতারা পরিচিত হন ইতালীয় মহিলা দার্শনিক ও সঙ্গীতজ্ঞ ইলিনা পিসকোপিয়া-র সঙ্গে। ইলিনা বিশ্বের প্রথম মহিলা যিনি পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছিলেন। অন্যরা তাঁর কথা খেয়াল রাখেনি।

Advertisement

সেই বক্তৃতাতেই জানা গেল, ডাচ চিত্রশিল্পী অ্যানা মারিয়া ভ্যান স্কারম্যান-এর কাজের কথা। শুধু চিত্রকলা নয়, সাহিত্য ও সঙ্গীতেও তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল। সপ্তদশ শতকে মারিয়া নারী শিক্ষার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন। ওই একই সময়ের জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী মারিয়া কুনিজ, যিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে কেপলার সমস্যা নিয়ে সাড়া জাগানো কাজ করেছিলেন।

মাটিল্ডা সে দিন সাফ জানিয়েছিলেন, এঁরা প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার পরও স্রেফ নারী বলে সে সময় তাঁদের প্রাপ্য সম্মান পাননি।

Advertisement

১৮৫২-র এই বক্তৃতার প্রায় ১৮ বছর পর, ১৮৭০ সালে ‘উইম্যান অ্যাজ অ্যান ইনভেন্টর’ নামে এক প্রবন্ধও লিখেছিলেন মাটিল্ডা। সেই প্রবন্ধেও এল এমন অনেক আবিষ্কারের কথা, যা প্রধানত মহিলার মস্তিষ্কপ্রসূত অথচ কৃতিত্বের ক্ষীর খেয়ে গিয়েছে কোনও পুরুষ।

কেন এই বিষয়গুলি জনসমক্ষে এনেছিলেন তিনি? আসলে, একটা জেদ ক্রমশ অনুসন্ধিৎসু করে তুলছিল তাঁকে। চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন মাটিল্ডা। কিন্তু উনিশ শতকে আমেরিকায় মেডিকেল কলেজের দরজা খোলা ছিল শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য। এই প্রত্যাখানই ঘুরিয়ে দিয়েছিল মাটিল্ডার জীবন।

মাটিল্ডার লেখা থেকে জানা যায়, ২৭ খ্রিস্টপূর্বে চিনা সম্রাজ্ঞী লেইজুর কথা। যিনি আবিষ্কার করেছিলেন সিল্ক লুম। আঠারোশো খ্রিস্টাব্দে ইতালির জ্যোতির্বিজ্ঞানী মারিয়া অ্যাগনেস, গণিতে বিশ্বের প্রথম মহিলা অধ্যাপক। বেশ কিছু গণিতের বই লিখেছিলেন তিনি। প্রায় একই সময়ে প্রথম মহিলা ভাস্কর হ্যারিয়েট হসমার। যিনি ভাস্কর্য তৈরির ক্ষেত্রে বেশ কিছু নতুন পদ্ধতির সন্ধান দিয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন-এর টেনেসিতে ইউনিয়ন ক্যাম্পেনের সাফল্যের পিছনে ছিল লিঙ্কনের উপদেষ্টা অ্যানা ক্যারল-এর ছক। অথচ, সে ভাবে মনে রাখা হয়নি অ্যানার নাম। উনিশ শতকে আমেরিকার মার্গারেট ই নাইট-এর তৈরি ব্রাউন পেপার ব্যাগ আজও প্লাস্টিকের পরিবেশ দূষণ থেকে দুনিয়াকে বাঁচতে সাহায্য করে। অথচ, মার্গারেটের এই ডিজাইন চুরি করেন চার্লস আনান। তাঁর কারখানাতেই তৈরি হত মার্গারেটের কাগুজে ব্যাগ। জর্জিয়ার মেয়ে ক্যাথরিন লিটলফিল্ড ‘গ্রিন কটনজিন’ বা তুলো তৈরির মেশিন আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তার কৃতিত্ব নিয়ে যান এলি হুইটনি নামে এক ভদ্রলোক।

আরও পড়ুন:মারকুটে মানিক

মহিলাদের নামে পেটেন্ট! উনিশ শতকের আমেরিকা ইউরোপের কাছে এই ভাবনা ছিল আকাশকুসুম। এই সব তথ্য আবিষ্কারের পাশাপাশি মহিলাদের প্রথম ভোট দেওয়ার অধিকার নিয়ে মুখ খুলেছিলেন মাটিল্ডা। বিবাহ বিচ্ছেদ, গর্ভপাত নিয়েও সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু তাঁর বিপ্লবও হারিয়ে যায় সময়ের অতলে।

১৯৯৩ সালে সায়েন্স হিস্টোরিয়ান মার্গারেট ডাবলিউ রোসিটার মাটিল্ডার এই প্রয়াসকে সর্বসমক্ষে আনেন। যা ইতিহাসে ‘মাটিল্ডা এফেক্ট’ নামে পরিচিত। বলা বাহুল্য, মার্গারেট প্রভাবিত হয়েছিলেন মাটিল্ডার লেখা পড়েই। মার্গারেটের প্রয়াসে পাওয়া যায় আরও কিছু তথ্য। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে ইতালির সালেনো শহরের ট্রটা-র কথা ইতিহাসে প্রায় মুছেই গিয়েছিল, অথচ এই ইতালীয় মহিলা চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন। বিশেষ করে মহিলাদের প্রেগন্যান্সি ও ত্বকের চিকিৎসাক্ষেত্রে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর তাঁর তিনটি বই একসঙ্গে ‘ট্রটুলা’ নামে পরিচিত। কিন্তু তাঁর কাজ বিশ্ব সংসারে পরিচিত হয় পুরুষের নামের আড়ালে। অনেক পরে বিংশ শতাব্দীতে স্বীকৃতি পায় ট্রটা।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী মারিয়া উইঙ্কলম্যান ক্রিচ এবং তাঁর গণিতজ্ঞ স্বামী গটফ্রিড ক্রিচ একসঙ্গে কাজ করতেন। এক রাতে গটফ্রিড যখন ঘুমোছিলেন, তখন মারিয়া আবিষ্কার করেন ধূমকেতু। কিন্তু শেষমেশ ধূমকেতু আবিষ্কারের কৃতিত্ব পান গটফ্রিড।

জিন বিজ্ঞানী নেটি স্টিভেন্স প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন সেক্স ক্রোমোজোমের ‘এক্সএক্স’ এবং ‘এক্সওয়াই’ ভাগটি। এক্স সকলের মধ্যে পাওয়া যায়, ওয়াই থাকে শুধুমাত্র পুরুষের মধ্যে। কিন্তু মহিলা হওযায় নেটি বঞ্চিত হলেন তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে। আবিষ্কার প্রকাশ পেল তাঁর বস এডমন্ড বি উইলসন-এর নামে। লিজ মেটনার এবং ওটো হান যুগলে আবিষ্কার করেছিলেন নিউক্লিয়ার ফিশন। ১৯৪৪-এ এই আবিষ্কারের জন্য শুধুমাত্র ওটো হান নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। লিজ-এর কোনও উল্লেখই ছিল না!

সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে এই ছবি আজ অনেকটাই বদলে গিয়েছে। তবু মাটিল্ডার প্রয়াসকে আমরা কত জন জানি, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তাঁর নামটাও আড়ালে হারিয়ে যাবেন না তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন