ইহুদি স্বামীদের প্রাণ বাঁচালেন স্ত্রীরা

ওঁরা খাঁটি জার্মান গৃহবধূ। নাৎসিদের হাত থেকে স্বামীদের বাঁচালেন প্রতিবাদ করে। রত্নাঙ্ক ভট্টাচার্যওঁরা খাঁটি জার্মান গৃহবধূ। নাৎসিদের হাত থেকে স্বামীদের বাঁচালেন প্রতিবাদ করে। রত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৭ ১৩:০০
Share:

স্মারক: রোজ স্ট্রিটের প্রতিবাদ আন্দোলনের স্মরণে ভাস্কর্য

প্রবল ঠান্ডা। সঙ্গে তুষারপাত। মার্চের বার্লিনে এমন আবহাওয়া স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক শুধু রোজ স্ট্রিট। সেখানে ইহুদিদের একটি কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ভি়ড় করে আছেন মহিলারা, ‘খাঁটি’ জার্মান গৃহবধূরা। ভিড় বাড়তে বাড়তে দেড়শো, দুশো, এক সময়ে হাজার ছাড়িয়ে গেল।

Advertisement

১৯৪৩। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মধ্যগগনে। বার্লিনের রোজ স্ট্রিটে জার্মান গৃহবধূদের এই জমায়েতের খবর ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব জুড়ে। কী এমন ঘটল যে সাধারণ গৃহবধূরা জমায়েত করছেন? আঙুল তুলছেন সরাসরি ‘থার্ড রাইখ’-এর দিকে?

উত্তর লুকিয়ে ওই কমিউনিটি সেন্টারে। সেখানে ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় কাতর দু’হাজার পুরুষ। শৌচাগারের সুবিধাটুকুও মিলছে না। কারণ, তাঁরা ইহুদি। ভাগ্য ভাল যে ‘আর্য’ জার্মান মহিলাকে বিয়ে করেছেন। কারও মা ‘আর্য’ জার্মান। এমনিতে তাঁদের মানুষ বলেই মানতে নারাজ হিটলারের ‘থার্ড রাইখ’। কিন্তু ওই যে ‘আর্য’ মহিলাদের সঙ্গে সম্পর্ক, তা-ই এত দিন বাঁচিয়ে রেখেছিল এঁদের। গেস্টাপোদের কিন্তু হাত নিশপিশ করছিল। শেষে ১৯৪৩-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি এনে রাখা হল রোজ স্ট্রিটের ইহুদি কমিউনিটি সেন্টারে। কিন্তু এদের কী করা হবে? কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, না কি, কোনও লেবার ক্যাম্পে পাঠানো হবে কঠিন, প্রাণঘাতী পরিশ্রমের জন্য!

Advertisement

দ্বিধায় ভুগছিল জার্মান প্রশাসন। আর এই ফাঁকে খবর রটে যায়। প্রিয়জনদের সংবাদ না-পেয়ে আশঙ্কায় ভুগছিলেন পরিবারগুলি। তাঁদের আরও শঙ্কিত করে তুলেছিল মার্চের প্রথম দিকে ঘটে যাওয়া ‘ফ্যাক্টরি অ্যাকশন’। যে ‘অ্যাকশনে’ ১১ হাজার ইহুদিকে অউশভিৎজ ক্যাম্পে পাঠিয়েছিল গেস্টাপোরা। তাঁদের প্রিয়জনদের জন্যও কি একই ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে? তাই জানতেই এক জন, দু’জন করে ভিড় জমাতে থাকলেন সেন্টারের সামনে।

এই জমায়েতের প্রথমে কোনও প্রতিবাদের ভাবনাই ছিল না। শুধু প্রিয়জনদের কুশল সংবাদ নেওয়া, আর পারলে মুক্ত করে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে। দিনরাত হত্যে দিয়ে রইলেন জার্মান মহিলারা। বেশির ভাগ সময়ে নীরবে। মাঝে মাঝে স্বামী, পুত্রকে ফিরিয়ে দেওয়ার স্লোগান। কিন্তু কোনও খবরই দিচ্ছিল না জার্মান প্রশাসন। ফলে ধীরে ধীরে ক্ষোভ বাড়তে থাকে।

বাড়তে থাকে সেনার টহল। কাঁটাতারের বেড়া বসল। বন্দুক নিয়ে সেনার হাঁটাহাঁটি শুরু হল। কিন্তু প্রতিবাদীর সংখ্যা কমল না। এ বার ভয় দেখানোর পুরনো কৌশল। জার্মান সেনা সরাসরি মেশিনগান তাক করল নিরস্ত্র জার্মান মহিলাদের দিকে। ঘোষণা হল, বাড়ি ফিরে যান, নইলে গুলি চলবে। কিন্তু ফল হল উলটো। সহস্র কণ্ঠ একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, ‘খুনি, খুনি...’

প্রমাদ গুনলেন জার্মান প্রোপাগান্ডা-মন্ত্রী গোয়েব্‌লস। বার্লিনের রাস্তায় জার্মান সেনার হাতে খাঁটি জার্মানদের রক্ত ঝরার ফল তিনি জানেন। সদ্য, ৩ ফেব্রুয়ারি স্ট্যালিনগ্রাদে জার্মান সেনা আত্মসমর্পণ করেছে। ১০ লক্ষ সেনা সেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন। এই অবস্থায় এতটা ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। বন্দিদের আপাতত মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিলেন তিনি। ‘পরে এদের বুঝে নেওয়া যাবে,’ খাতায় লিখে রাখলেন। ঠিক হল, ‘থার্ড রাইখ’-এর জয়ের পরে বিষয়টি দেখা যাবে। ১২ মার্চের মধ্যে ২৫ জনকে বাদ দিয়ে সব বন্দিকেই মুক্তি দেওয়া হল। ইহুদি স্বামীদের নিয়ে বাড়ি ফিরলেন জার্মান মহিলারা। তৈরি হল প্রতিবাদের অনন্য নজির।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন