স্বতন্ত্র: নিজস্ব রীতিতে তৈরি কুটিরের সামনে টোটো কিশোরী ও শিশু।
পড়ন্ত বিকেলে জংলি পোকার শব্দে আমাদের গল্পই চাপা পড়ে যাচ্ছিল। কাঠের বাড়ির দোতলায় বসে, শব্দের খোঁজে ঝোপঝাড়, সুপুরিবাগানের ফাঁকফোকরে দেখছিলাম। টোটো ভাষায় এই ‘দয়িং’-এর তীক্ষ্ণ শব্দ সন্ধেয় তো বটেই, দিনের বেলাতেও শোনা যায়। সকাল-দুপুর-সন্ধেয় শোনা শব্দের রেশ নিঝুম টোটোপাড়ায় অন্য এক জগৎ তৈরি করে। নদী-জঙ্গল পেরিয়ে সরকারি তকমার এই আদিম জনজাতির জগতে পৌঁছলে অবশ্য কেউ বাড়তি ঔৎসুক্য দেখাবে না। এটা ওঁদের গা-সওয়া। পাহাড় থেকে পাইপ বেয়ে আসা অবিরাম পড়ে যাওয়া জল, টিপটিপ বৃষ্টির শব্দ, সকালে মোরগ আর ময়ূরের ডাকও এখানে নিরন্তর মিলেমিশে যায়। একশো বছরেরও বেশি সময় টোটো আর টোটোপাড়া ধরাছোঁয়ার মধ্যে, আবার কত খোঁজ অজানাও থেকে গেছে।
যেমন টোটো ভাষার কবিতা। সত্যজিৎ টোটোর খাতা নিয়ে তাঁর বাড়িতে বসেই পড়ছিলাম। কবিতায় পাহাড় নদী উপত্যকা মেশা সুন্দর টোটোপাড়ার বর্ণনা, আবার আছে বঞ্চনার কথাও। কিন্তু এখানে বসতির কথা? শচীন টোটো ‘কাইজি’ ছিলেন আগে। ‘কাইজি’ মানে সমাজের প্রধান পূজারি। টোটো সমাজপ্রধান ‘গাপু’র মতো এটাও বংশ-পরম্পরায়। সাতপুরুষের কাইজির নাম বলতে বলতে শোনালেন, ‘‘শিকার করতে এসেছিলাম জয়গাঁ। জয়গাঁতে একটা বসতি হয়ে গেল। সেখান থেকে কালেশ্বর পাহাড় মানে ‘হিসপা’। ওখান থেকে আমরা গেলাম ভুটান— জেনচু ভুটান। সেখানে এখনও চিহ্ন রয়েছে, কাঁঠাল গাছ। সেখানে ডয়াদের সঙ্গে মারামারি, একসঙ্গে থাকতে পারলাম না। তার পর আমাদের পূর্বপুরুষেরা চলে আসেন এই সীমানা দাঁড়া— ভুটানের সীমান্তে। আস্তে আস্তে সবাই এখানে চলে আসি।’’
কিন্তু ভুটান লাগোয়া সীমানা দাঁড়া পৌঁছে দেখি, পাহাড়ি চাতাল জুড়ে নেপালি বসতি। এ পথে ভুটানে কাজের সন্ধানে টোটোদের নিত্য যাতায়াত। ফেরার পথে পূজা গাঁওয়ে ‘দেমসা’ বা পুজো-ঘরে উঁকি দিতে দেখলাম, পুরনো দুটো লম্বাটে ঢাক ঝুলছে, এদেরও দেবোপম পবিত্র মনে করা হয়। এ সব নিয়ে জানতে গিয়ে বুঝলাম, ঝুমসা টোটো বাংলা বলতে পারেন না। বাড়িতে মারুয়া ঝাড়াই-বাছাই করতে করতে পুব দিকে তোর্সা বা তাঁদের মুটি নদীর দিকে দেখালেন রাই গাঁও, যেখানে টোটোদের বসতি নেই; পুঁয়ার গাঁও, পাখা গাঁও, মঙ্গর গাঁও—সব নেপালিদের। টোটোপাড়ার জনসংখ্যার বিস্তৃতি এ ভাবেই হয়েছে। ভাষা-পরিচয়ও গেছে পাল্টে। সামনের দেব-পাহাড় হিসপা ‘কালেশ্বর’ নামেই পরিচিত হচ্ছে, পবিত্র নদী ‘গুয়াতি’ এখন কালীঝোরা। একটি গ্রামেই শুধু বসতি, এমন জনজাতি আর নেই বাংলায়। এই আকাঁড়া সংস্কৃতির আকর্ষণেই স্বাধীনতার বছর কয়েক পরে সন্ধানী হয়েছিলেন নৃবিজ্ঞানী বিক্রমকেশরী রায়বর্মন। শতাধিক দিনরাত্রি কাটিয়ে যে ভিতরের তথ্য পেয়েছিলেন, তা আজও ছাপা হয়নি। আজও টোটোরা মূলত ছ’টি পাড়াতেই ভাগ হয়ে আছে। ধুমসি গাঁও নাম ছিল না, ওটা ছিল বৌধবে গাঁও; মিত্রং টোটোর নামে মিত্রং গাঁও; পূজা গাঁওয়ের নাম ছিল বুধবে গাঁও; সুব্বা গাঁওয়ের নাম ছিল কাইজি গাঁও; মণ্ডল গাঁও ছিল গাপু গাঁও; পঞ্চায়েত গাঁও ছিল পঞ্চা গাঁও। এই পাড়াগুলোকে পাহাড় থেকে নামা লেংপাংতি, নিতিংতি, চুয়াতি, দাতিংতি, পাচো ঝোরা আলাদা করেছে। আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট থেকে টোটোপাড়ার ২১ কিমি যাত্রাপথেও আবার বাংরি, তিতি, পূর্ণিখোলা, কালীখোলা, ডয়ামারা নদীর পর হাউড়ি নদী। নুড়ি-বালির এই নদী পেরোলেই টোটো বসতি।
টোটো জনজাতিদের গ্রাম
একশো বছর আগে জলপাইগুড়ি জেলার সার্ভে রিপোর্টে জে এ মিল্লিগান এই টোটোপাড়ার মোট আয়তন জানিয়েছেন ২০০৩ একর। যার মধ্যে টোটোরা বসবাস ও চাষবাসের জন্য ব্যবহার করতেন ৩০০ একর। এই রিপোর্টে তাদের নিজস্বতা রক্ষায় জমি আদানপ্রদান, কেনাবেচা বা অন্য জনগোষ্ঠীর বসতি করা থেকে বিরত থাকার প্রস্তাব ছিল। এরও আগে উনিশ শতকের শেষ দিকে ডি সান্ডার-এর রিপোর্টে ডুয়ার্সের এই জনজাতির ৩৬টি বাড়ির কথা আছে। তখন মারুয়া বা কাওনিই ছিল প্রধান খাদ্য। খুঁটিনাটি খোঁজখবর শুরু হল অবশ্য স্বাধীনতার আগে থেকেই। চারুচন্দ্র সান্যাল সে সময়ে ও পরে এসেছেন বহু বার। সেই থেকে বহু তথ্য সংগ্রাহক, সরকারি কর্মী, পর্যটক, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা কাজ করেছেন টোটোদের নিয়ে। অবস্থান মাহাত্ম্যে, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর স্বকীয়তার আকর্ষণে ব্রিটিশ কন্যা লিসসা ডেভিস তাঁর সহযোগীদের নিয়ে টোটোপাড়ার শিশুদের নিয়ে ইংরেজি, বাংলা, টোটো ভাষা শিক্ষা প্রকল্প চালিয়েছেন কয়েক বছর যাবৎ। অন্য দিকে, নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে ধনীরাম টোটো সদা তৎপর, লিখেছেনও নিজেদের কথা। তৈরি করেছেন টোটো ভাষার বর্ণমালাও। সব বিষয়েই তাঁর নজর। ভক্ত টোটো, লক্ষ্মীকান্ত টোটোও নিজের মতো করে ভাষা, কবিতা চর্চা করছেন। এর মধ্যেই নিজভূমে পাল্টে যাচ্ছে জীবনধারণ আর রীতিনীতির নানা দিক। চল্লিশ বছর ধরে চলা সাপ্তাহিক হাটের এক পাশে এখন স্থায়ী বিউটি পার্লার। প্রকৃতি পূজারি এই জনগোষ্ঠীর কেউ খ্রিস্টধর্মে চলে গেছেন, ইংরেজি মাধ্যম মিশন স্কুলও এখানে চলছে বছর কুড়ি। বিয়ে হচ্ছে সাঁওতালি বা নেপালি মেয়ের সঙ্গে; রাজবংশী ও নেপালি ছেলেকে বিয়ে করে সমাজের বাইরেও চলে গেছেন কেউ। নেপালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া শুরু স্বাধীনতার পরের দশকেই। এখন টোটোদের প্রায় ১৬০০ জনসংখ্যার দ্বিগুণ আছেন নেপালি, বিহারি ও অন্যান্য গোষ্ঠীর মানুষ।
এই টোটোপাড়াতেই নেপালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হল কী করে? স্বাধীনতার আগেই সমাজ-প্রধান দাঙ্গে টোটো কয়েকটি নেপালি পরিবারকে বসতি করার অনুমতি দিয়েছিলেন গরু দেখাশোনার জন্য। তখন কমলালেবু চাষ ও ব্যবসারও কেন্দ্র ছিল টোটোপাড়া। নেপালি ব্যবসায়ীদের আসা-যাওয়ার মাঝে তাঁদের বসবাসে মানিয়ে নিতে বাধ্য হন টোটোরা। আত্মীয়তা সূত্রেও অনেকে চলে আসেন। তার আগে পাহাড়ের গায়ে ‘ঝুম’ চাষ করতেন টোটোরা। সে সময়ে ছিল খয়ের গাছের কাঠামোয় নিজস্ব রীতির কুটির। আজ প্রায় সাড়ে তিনশো পরিবারের মধ্যে তা দশটাও নেই।
এক বার মিত্রং গাঁওয়ের মাঝ দিয়ে ওই পাহাড়ি পাখা গাঁওয়ে ওঠার পথে এক বাড়ির সামনে থমকে গেলাম। কঞ্চি-সহ বাঁশ উঠোনে পোঁতা। তার উপরে নতুন কাপড় ঝোলানো। সেই বাড়ির বারান্দায় পুজোর সরঞ্জাম আর শুয়োরের ঝলসানো মাথা এনে রাখা হল। মন্ত্র পড়া হচ্ছে তখন। বাড়ির সন্তানসম্ভবা বৌটি বসে আছেন পাশে। অশুভ শক্তিকে দূরে রাখার এই ‘দোরোংকলা পুজো’ এখনও যে নেই তা নয়। যেমন বসন্তে গোষ্ঠীপুজো ‘সরদে’ অপুষ্ট ফল খাওয়ার নিষেধাজ্ঞার পুজো-আচার। তখন গুয়াতি নদীর ধারে শুধু পুরুষরাই যেতে পারেন। আগের দিন মোরগ, মুরগি, শুয়োরের বলি-উৎসর্গের জন্য শুদ্ধিকরণ, মন্ত্রপাঠ, ‘ইউ’ পানাহার আর নাচ দেখলাম দেমসায়। নাচগান করছিলেন গইজরো, হেমে, কালীচরণরা। আবার যখন শরৎ শেষে ‘ঙয়ূ’ পরবে নিষেধাজ্ঞা ওঠে, তখনও হয় উৎসব। মাসকয়েক আগে এ বারের এই পরবের বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় দেখা গেল, সদ্য যুবা সোনি টোটোর বাঁধা গান আর নাচে টোটো ছেলেমেয়েদের জমজমাট তালিম চলছে। পুরনো পরবের মাঝেই সবার নজর তখন নতুনের আকর্ষণে। এক টোটো বিয়েতেও দেখেছিলাম ‘ইউ’-এর মাদকতার সঙ্গে কনের বাড়িতে সাউন্ডবক্সে বাজানো নেপালি গানের সঙ্গে নাচ; আর পাশেই বরের বাড়িতে হিন্দি গানের সঙ্গে।
হিমালয়ের দুর্গম বিশালত্বের গরিমা নেই টোটোপাড়ায়। পাহাড়ের এখানে সমতলে মেশার কাহিনি। টোটোপাড়া দশকের পর দশক ধরে সংস্কৃতির পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে। আণবিক জীববিদ্যার গবেষণাতেও দেখা যাচ্ছে, টোটোরা উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রাচীন ধারা। শিক্ষায়ও তাঁরা এগিয়েছেন অনেকখানি। ১৯৭৯-তে চিত্তরঞ্জন টোটো প্রথম মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন। ২০১০-এ মেয়েদের মধ্যে প্রথম গ্র্যাজুয়েট রীতা টোটো। শোভা, সঞ্চিতারা চাকরির সন্ধানে কলকাতায় এসে ট্রেনিংও নিচ্ছেন। এই সব রূপান্তরের মধ্যেও থাকে জনগোষ্ঠীর প্রবহমান অন্তররূপ। পাল্টে যেতে যেতেও টিকে থাকে। এক বসন্তের রাতে, চাঁদের আলো টোটোপাড়ার সুপুরি, খয়ের, তেজপাতা, কাঁঠাল, কাঞ্চনের ডালপাতা ছুঁয়ে মাটিতে পড়তে মনে হচ্ছিল, একই দেখা কত ভাবে পাল্টে যায়! এক আদিম জনগোষ্ঠীর জীবন ও জগতের প্রবহমান রূপ খুঁজতেও কত রূপান্তরের কথা-কাহিনি জমা হয়!