ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
খরগোশ আর কচ্ছপ। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে এদের উপকথা বিবৃত হয়েছে। পঞ্চতন্ত্রে তো আছেই, গ্রিসে এক গণিতজ্ঞ অঙ্কের সূত্র বোঝাতে এই দৌড় নিয়ে সাংঘাতিক কিছু ধাঁধা বানান। আমাদের দেশে আমাদের সময়ে এই কাহিনির পুনঃপ্রচলন করেন জ্যাক ওয়েল্চ, আমেরিকার জি ই কোম্পানির ডাকসাইটে পরিচালক। তাঁর আমলে জি ই কোম্পানির শেয়ারের দাম চার হাজার শতাংশ বাড়ে। এবং দুনিয়ার ব্যবসায়ীরা ওঁকে সন্তোষী মায়ের মতো এক নমস্য দেবতার আসনে বসান।
ভারত বনাম চিন নয়, ভারত ও চিন। এই দুই দেশই জয়ী হবে অর্থনীতির চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। অর্থনীতির এক রূপকথার সৃষ্টি হবে তখনই। ভারত আপাতদৃষ্টিতে কচ্ছপ হতে পারে। শেষ পর্যন্ত জয়ও তার সম্ভব। জ্যাক ওয়েল্চরা অন্তত তাই মনে করেন।
চিনাদের ধারণা অন্য। রূপকথা শিশুদের জন্য। বাস্তবের কচ্ছপেরা কচ্ছপই থাকে। কখনওই জেতে না—দৌড়নোর সুযোগ পায় মাত্র। ‘‘আমরা তোমাদের চেয়ে প্রায় চল্লিশ বছর এগিয়ে আছি।’’ কোনও রাখঢাক না রেখে আমাকে বললেন ওঁদের এক রাজপুরুষ। তাঁর কথা, ‘‘এটা স্বীকার করতে তোমাদের এত দ্বিধা কেন?’’ আমরা যে ভাবে বাংলাদেশ ও নেপালকে দেখি, চিন প্রায় সেভাবেই ভারতবর্ষকে দেখে। যাঁরা দু’দেশের আর্থিক হাল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তাঁরাই বলবেন এই দাবি অন্যায্য নয়। কিন্তু কেন?
আরও পড়ুন: পরিত্যক্ত বুধনি
শুধু তো ওয়েল্চ সাহেব নন, আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্ক, অর্থনীতির পণ্ডিত— সবাই মনে করতেন ভারত চিনের সমকক্ষ। চিন এগিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু খুব সামান্য। ভারতে গণতন্ত্র আছে, আইনের অনুশাসন আছে। তাই শেষ অবধি কচ্ছপই জিতবে। বিষ্ণু শর্মা নাকি ঠিকই লিখেছিলেন। কিন্তু সত্যি কি তাই?
ধান ভানছি না। তাই জিৎ গাঙ্গুলির গীতের প্রয়োজন নেই। শুধু তিনটি কাহিনি বলব।
প্রথম কাহিনি
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ১৯২৪ সালে। অভীক সরকার ২০১৭। এই সময়কালের মধ্যে অনেক না হলেও কিছু বাঙালি নিশ্চয়ই থেকেছেন ১৯১৫ সালে তৈরি বেজিং হোটেলে। স্বাভাবিকভাবেই সে অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। পিপলস রিপাবলিক হিসেবে চিনের আত্মপ্রকাশের আনুষ্ঠানিক সূচনা এই হোটেলেই করেন মাও জে দং এবং ঝাও এন লাই।
দেখতে দেখতে বিপ্লবেরও ৬৮ বছর হতে চলল। ইতিমধ্যে হোটেলটির বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যেখানে ছিলেন, সেই লাল ইটের বাড়ি ভেঙে ফেলে হয়েছে একটি নতুন ভবন। পৃথিবীর অনেক হোটেলই যেমন করে থাকে। জীর্ণ পুরাতনকে বিদায় দিয়ে নতুনের আহ্বান। কিন্তু এটুকুতেই সন্তুষ্ট না হয়ে চিনারা একটা মজার জিনিস করল। মূল হোটেলের আশপাশের জমি নিয়ে তারা একই চত্বরে সংলগ্ন বিভিন্ন বাড়ি নির্মাণ করেছে। ফলে যা ছিল একটি হোটেল, হয়ে দাঁড়াল হোটেল কমপ্লেক্স। এটা সাবেকি সোভিয়েত ধারণা: ব্যবসার কলেবর অহেতুক বাড়ানো। পরিণতি, একটি নিয়ন্ত্রণ-অসাধ্য ঢাউস প্রতিষ্ঠান।
বেজিং হোটেল কমপ্লেক্সে তিনটি হোটেল। এবং কিছু ব্যবহারের জায়গা সকলের ক্ষেত্রে একই, অর্থাৎ কমন। যেমন জিম ইত্যাদি। তিনটির মধ্যে দু’টি হোটেল সরাসরি সরকার চালায়। তৃতীয়টি সিঙ্গাপুরের এক হোটেলগোষ্ঠী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত বার চিনে গিয়ে সেই হোটেলেই ছিলেন।
বেজিং হোটেল বেজিং টুরিজম গ্রুপের অংশ। যা সরকারের মালিকানায় বেসরকারি কোম্পানি (যেমন স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া)। কিন্তু হোটেলে থেকে একটা জিনিস বুঝলাম। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের চেয়ে একটু উন্নত হলেও এটা বিদেশি হোটেলের সমকক্ষ নয়। যেমন হোটেল জামাকাপড় কেচে দেয়। কিন্তু ইস্ত্রির ব্যবস্থা নেই। প্রথম শ্রেণির সরকারি অতিথি, যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই হোটেলে থাকেন না। থাকেন বেসরকারি বিদেশি হোটেলে। নিক্সন এবং কিসিঞ্জার এই হোটেলেই ছিলেন। কেননা, সেই সময়ে বেসরকারি হোটেল ছিল না।
নয়াদিল্লির অশোক হোটেল তুলনায় অনেক নবীন। মেরেকেটে ৬০ বছর। স্বয়ং জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে এই হোটেলের সূচনা। নামকরণও তাঁর। লোকে বলে, নেহরু ঘোড়ায় চড়ে এসে নিজে এর নির্মাণকাজ তদারকি করতেন। বেজিং হোটেলের মতো এই হোটেলও অনেকটা সোভিয়েত ধাঁচের। বিশাল জমির উপর ছড়ানো বাড়ি। ষাটের দশক অবধি এই হোটেলের একটা মর্যাদা ছিল। কারণ, বেসরকারি হোটেলের অভিযান তখনও সেভাবে আরম্ভ হয়নি। কিছু পুরনো হোটেল ছিল। কিন্তু সেগুলি এতই সেকেলে যে ব্যবসা ধরে রাখতেই সক্ষম হয়নি। তাই ওবেরয়, তাজের মতো হোটেল যখনই ব্যবসা শুরু করল, অশোকের ভাগ্য-পতনেরও তখনই শুরু।
বেজিং, অশোক দুই হোটেলই সরকারের অধীন। দু’টিরই গড়ন সোভিয়েত ধাঁচের। কিন্তু উতুলনাটা এখানেই শেষ। বেজিং হোটেলে এখনও সরকারি অতিথিদের রাখা হয়। রাষ্ট্রপ্রধানেরা না হলেও তার একটু নীচে অনেককেই। বিদেশি হোটেলের জমক বা পরিষেবা ততটা না থাকলেও এটি পরিচ্ছন্ন এবং বাসযোগ্য। অশোক হোটেলের এমনই হাল যে, সরকার এখন নিজেদের অতিথিদেরও সেখানে রাখেন না।
উত্তর-মাও যুগে চিনারা বুঝে গিয়েছেন, সরকারি ব্যবস্থায় ব্যবসা চালানো শক্ত। কিন্তু প্রতিযোগিতা আমদানি করলে অবস্থার উন্নতি হতে পারে। তাই বেজিং কমপ্লেক্সের বিভিন্ন হোটেল নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। বিভিন্ন খদ্দেরের বিভিন্ন চাহিদা সম্বন্ধে তারা ওয়াকিবহাল। যেটা নিজেরা পারবে না মনে করে, সেটা তারা বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়। ব্যবসার আদর্শ পরিমণ্ডল নয়। কিন্তু সোভিয়েত-মডেল থেকে বেরিয়ে সরকারি মালিকানার মধ্যে থেকেও বেসরকারি স্বাদ নিয়ে আসার প্রচেষ্টা খুব জোরালো।
অশোক হোটেল সেই সোভিয়েত জমানাতেই থেমে আছে। সরকার আসে যায়। কিন্তু ছুঁচো গেলার মতো একে ফেলতেও পারে না, উগরোতেও পারে না। আমি অরুণ জেটলিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। এটার কিছু করছেন না কেন? তাঁর উত্তর ছিল, ‘‘এত দাম দিয়ে কে কিনবে বলো!’’ বলেছিলাম, জমির মালিকানা রেখে পরিচালনার ভার দীর্ঘমেয়াদে কোনও বিদেশির হাতে দিয়ে দিন না? তিনি জবাব দেননি।
লাল ফিতের ফাঁসহীন বেজিং হোটেল
দ্বিতীয় কাহিনি
চা ভারতবর্ষে নিয়ে আসেন স্কটিশ সাহেবরা। জাত হিসেবে এরা হাড়কিপটে। পয়সা চেনেন বলে তাঁদের ব্যবসা সাধারণত সচ্ছল। চিনাদের কাছে তাঁরা চা খেতে শিখলেন তাই নিজেদের জন্য চা গাছের চারা বসিয়ে তাঁদের হাতে ভারতে চা-শিল্পের পত্তন। যেহেতু নিজেদের জন্য, তাই তাঁরা কখনও চাননি চায়ের দাম গগনচুম্বী হোক। চা বিক্রির ব্যবস্থা করেন নিলামের মাধ্যমে। মূল্য যাতে সংযত থাকে। ফলে আমাদের ভারতবর্ষে চা ব্যবসা প্রধানত যাকে বলে বি টু বি— অর্থাৎ এক ব্যবসায়ী আর এক ব্যবসায়ীর থেকে কেনেন। খদ্দের আর উৎপাদকের মধ্যে আড়াল রয়ে গিয়েছে।
চিনে চা বিক্রি করেন উৎপাদকেরা এবং তা সরাসরি খদ্দেরদের। একে বলে বি টু সি পদ্ধতি। অর্থাৎ উৎপাদক থেকে খদ্দের। মাঝে কোনও দেওয়াল নেই। নেই কোনও নিলাম-পদ্ধতি। চিনে উৎপাদকেরা তাই তাঁদের ক্রেতাদের চেনেন। ভারতীয় উৎপাদকেরা চেনেন মুষ্টিমেয় কিছু মিডলম্যানকে। এর ফলে চিনে উৎপাদকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে। উৎপাদকের সংখ্যা অনেক, ক্রেতার সংখ্যাও অনেক। কৃত্রিম ভাবে তাই মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সমাজতন্ত্রেও শক্ত। ওখানে ভাল চা শ্বাসরোধকারী মূল্যে বিক্রি হয়। যেমন উৎকৃষ্ট উলং চায়ের দাম ৫০০ মার্কিন ডলার, মাত্র ১০০ গ্রামের জন্য (ভারতীয় মূল্যে ৩০ হাজার টাকারও বেশি)। তুলনায় ভারতের শ্রেষ্ঠ চা দার্জিলিঙের ক্যাসলটন। ১০০ গ্রামের দাম ৫০০ টাকার মধ্যে।
আরও আছে। সরাসরি ব্যবসা করার জন্য চিনে চা উৎপাদকেরা সব সময় বিক্রির টাকায় খরচ তুলে নিতে পারে। ভারতবর্ষে ৭০/৮০ ভাগ চা এখন প্যাকেটবন্দি করে বিক্রি হয়। সামান্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সেই চা উৎপাদকদের থেকে কিনে প্যাকেজিংয়ের কাজ করে। ফলে চায়ের দাম কখনওই বেশি ওঠে না এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে উৎপাদনের খরচটুকুও উসুল হয় না। মজা হল, একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ প্রতিযোগিতার সুফল বুঝেছে। জেনেছে কোন খদ্দেরের কী প্রয়োজন। ভারতবর্ষে নাকি বাজার অর্থনীতি। কিন্তু চায়ের এমনই বাজার যে উৎপাদকেরা তাঁদের ক্রেতাদের চেনেন না এবং উৎপাদন-খরচটুকু তুলতে প্রায়ই বিফল হন।
ভারতীয় ভাবনায় সোভিয়েত প্রভাব এখনও অটুট। বিনা কারণে প্রতিষ্ঠান গজিয়ে তোলায় ভারত কিউবা বা উত্তর কোরিয়ার সমকক্ষ। এ রকম এক প্রতিষ্ঠান হল, টি বোর্ড। কেন টি বোর্ড আছে, কী তার প্রয়োজন— এই গুপ্ত তত্ত্বটি আমাদের কৌতূহলের পরিধির বাইরে সযত্নে ‘সুরক্ষিত’। চিনে কিন্তু কোনও টি বোর্ড নেই।
মহাপৃথিবী: অশোক হোটেল। আজও সেই তিমিরেই।
তৃতীয় কাহিনি
দরিদ্র দেশগুলি মনে করে তাদের নিজেদের বিমানসংস্থা প্রয়োজন। এটা নাকি নিরাপত্তার স্বার্থে খুব জরুরি (এর সঙ্গে অবশ্য সামরিক বিমানবাহিনীর কোনও সম্পর্ক নেই)। চিনের জাতীয় বিমানসংস্থা এয়ার চায়না। ভারতবর্ষে এয়ার ইন্ডিয়া। প্রায় শুরু থেকেই এদের লোকসানে চলা। ভারতবর্ষে এখনও, চিনে কিন্তু নয়।
লোকসান কমাতে চিন বিমানসংস্থাটিকে কয়েক ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক তিক্ত এবং প্রতিযোগিতা হিংস্র। প্রতিটি স্বাধীন ব্যবসা। টিকিটের দাম, যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য এরা নিজেরা ঠিক করে। সরকারের নাক গলানো বারণ। যদিও এখনও অবধি এরা মোটামুটি সরকারের মালিকানায়। তবে দু’একটি ছোট বেসরকারি উদ্যোগকেও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আর খুব সামান্য হলেও বিমানসংস্থাগুলি কিছু কিছু শেয়ার বাজারে বিক্রি করেছে। ভারতবর্ষে প্রধানত দু’টি বিমানসংস্থা ছিল— এয়ার ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স। আমাদের সরকার এই দুই সংস্থাকে জুড়ে দিল। তৈরি হল রাশিয়ার এরোফ্লোট-এর মতো এক সর্বভূতেষূ সংস্থা। অর্থাৎ চিনে প্রতিযোগিতা সম্প্রসারিত হচ্ছে, ভারতে হচ্ছে সংকোচন। এখানে সরকারি বিমানসংস্থা কার্যত চালায় সরকার নিজে। চিনে সরকার মালিক, কিন্তু নাক গলাতে পারে না। পেশাদার ম্যানেজাররা কোম্পানি চালান। তাঁরাই ঠিক করেন কোথায় চালাবেন, টিকিটের দাম কী হবে, কী ধরনের বিমান কিনবেন। চিনের বিমানসংস্থা নিশ্চয়ই এমিরেটস বা ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ-এর সমকক্ষ নয়। তবে তারা বেজিং হোটেলের মতোই সুষ্ঠু, ব্যবহারযোগ্য এবং সর্বোপরি সচ্ছল।
তিনটি কাহিনি। শিক্ষা এক। কচ্ছপ কোনও দিনই খরগোশকে ধরতে পারবে না। চিনের খরগোশ ঘুমোয় না। প্রতিযোগিতার এমনই আবহ যে ওদের সজাগ থাকতে হয়। সরকারের ভূমিকা সেই প্রতিযোগিতার বাতাবরণ তৈরি করা এবং দেখা, প্রতিযোগিতা সত্যিই আছে। কে জিতবে বা হারবে সেটা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। চিনারা চতুর বানিয়া। তারাও বুঝেছে, মালিকানা নয়, প্রতিযোগিতাই প্রথম এবং প্রতিযোগিতাই শেষ কথা।
লং মার্চে মাও জে দংয়ের সহযোগী লিউ শাও ছি লিখে গিয়েছেন, কী করে সাচ্চা কমিউনিস্ট হতে হয়। এ বার সময় এসেছে আর একটি বইয়ের— কী করে সাচ্চা ক্যাপিটালিস্ট হতে হয়!
(আগামী সপ্তাহে কচ্ছপের পথ)