টাইম মেশিন

অলিম্পিক কমিটির নতুন সিদ্ধান্তে গোটা দেশে খুশির বন্যা বইছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তাসা-ঢোল সহযোগে সারা রাত বাজি পোড়ানো চলেছে। ‘গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ’, অলিম্পিকের আসরে ভারতের পারফরমেন্স বরাবরই ভীষণ হতাশাজনক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

অলিম্পিক কমিটির নতুন সিদ্ধান্তে গোটা দেশে খুশির বন্যা বইছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তাসা-ঢোল সহযোগে সারা রাত বাজি পোড়ানো চলেছে। ‘গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ’, অলিম্পিকের আসরে ভারতের পারফরমেন্স বরাবরই ভীষণ হতাশাজনক। একাধিক প্রকল্প ও পরিকল্পনা তৈরির পরেও, পদকের তালিকায় জায়গা করে নিতে বারে বারে ব্যর্থ হয়েছে জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের বৃহত্তম দেশটি। এক যুগ আগে ক্রিকেট (টি-এইট) এবং যোগ (শবাসন, কপালভাতি, প্রাণায়াম) অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়, দেশবাসী আশায় বুক বেঁধেছিল— এ বার পদক নিশ্চিত। কিন্তু এই দুই বিভাগে চতুর্থ হওয়ার জন্য, পদক হাতছাড়া হয়। গত অলিম্পিকে ৩৫০ জন প্রতিযোগী ও ৫০০০ কর্তাব্যক্তি পাঠিয়ে, মাত্র তিনটে পদক (একটা রুপো, দুটো ব্রোঞ্জ) পাওয়ায় দেশবাসী ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। তাই, নয়া আইনে জনসাধারণ আনন্দে মেতে উঠেছে। এতে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে ক্রীড়া মন্ত্রকও। নতুন আইনে চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানাধিকারীদের জন্য পেতল, কাঁসা ও স্টিলের পদক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অতএব, সেকেন্ডের ভগ্নাংশ বা পয়েন্টের ভগ্নাংশের জন্য মেডেল হাতছাড়া হওয়ার আপশোস আর থাকবে না। এ দিকে, ভারতের বিভিন্ন কোচ তাঁদের প্রশিক্ষণে থাকা খেলোয়াড়দের পেতল ও কাঁসার মেডেলের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করে দিয়েছেন। এক বিখ্যাত ইস্পাত নির্মাণকারী সংস্থা স্টিল পদকাধিকারীদের জন্য পঁচিশ লাখ টাকার ইনাম ঘোষণা করেছেন। কিছু কিছু লোক অবশ্য সমালোচনা করে বলেছেন, এ তো দুধের স্বাদ পিটুলিগোলা দিয়ে মেটানো! কিন্তু অধিকাংশ মানুষই মত দিয়েছেন (বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ‘পপুলার ভয়েস’ ফর্ম্যাটের অনুষ্ঠানে রাস্তাঘাটে মানুষের যে মত শোনা গিয়েছে)— যে ভাবে হোক, আগে দেশে পদক আসুক। যারা দুধ খেতে পায় না, তাদের পিটুলিগোলা জুটলেও বাজি ফাটানোর অধিকার আছে।

Advertisement

সরিৎশেখর দাস, চন্দনপুকুর, ব্যারাকপুর

Advertisement

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

ডবলডেকারে চড়ে বিশ্বরূপ দর্শন

বালিগঞ্জ থেকে এলগিন রোড পর্যন্ত বাসভাড়া ছিল মাত্র দশ পয়সা। একডালিয়া পার্কের পাশ থেকে ছাড়ত চারটি রুটের বাস— টু, টু বি, আর আট আর দশ নম্বর বাস। টু, টু-বি আর দশ নম্বর বাসগুলো সাধারণত থাকত দোতলা, মানে ডবলডেকার। দোতলা বাস আমার খুব প্রিয় ছিল। ফাঁকা বাসে উঠলেই প্রথমের সিট দুটো ছিল আমার পছন্দের। সামনের সমস্ত কিছু দৃশ্যমান। বাস ছাড়ার আগে ঘোষণা করা হত: অমুক নম্বর বাস অমুক রুটে যাবে।

এর পরই শুরু হল বিজন সেতুর কাজ। ঘোষিত হল একডালিয়া পার্কের মৃত্যুদণ্ড। বাস টার্মিনাস একটু সরে গেল। কিন্তু দোতলা বাস টু, টু-বি আর দশ নম্বর ঠিকই থেকে গেল। খুব সম্ভবত ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে তখনকার পরিবহণমন্ত্রী জ্ঞান সিংহ সোহনপাল দোতলা বাসের আবার নতুন রূপ দিলেন। একতলা আর দোতলায় ওঠার দরজা আলাদা হয়ে গেল। অধিকাংশ বাসের দোতলায় বসবার সিটগুলো একটু ভাল করে, সামনে দুটো পাখার ব্যবস্থা হল। ওপরতলার নামকরণ হল ফার্স্ট ক্লাস। দোতলার ভাড়া বাড়ল পাঁচ পয়সা। একই সঙ্গে চালু হল বাসে ওঠার জন্য লাইন।

কেবল এক রকম দোতলা বাস নয়। তখন এল-৯ আর ৫ নম্বর বাসের আবার একটা ছোট ট্রলি-কাম- তিনতলা ছিল। সেখানটার হাইট ছিল খুবই কম। মাথা ঠেকে যেত। বসার জায়গা পেলে কোনও মতে মাথা নিচু করে গিয়ে সিটে বসে পড়তে হত। তবে সেখানে মহিলাদের আধিক্য ছিল বেশি। সেই সব বাসে ড্রাইভারের একটা আলাদা ইঞ্জিন ক্যাবিন ছিল। বাসের সঙ্গে জোড়া। সেই সব ড্রাইভারদের আমরা খুব সম্ভ্রমের চোখে দেখতাম।

তখনও কিন্তু কলকাতার রাস্তা কম চওড়া ছিল। কিন্তু দোতলা বাস চলায় কোনও অসুবিধে হত না। বরং ওপরে বসলে শহরটাকে আরও ভাল লাগত। মনটা প্রসন্ন হয়ে যেত। আবার যখন অফিস-টাইমে ভয়ংকর ভিড় হত, তখন যাঁরা ওপরে বসতেন, তাঁরা খুব আরামে বসে নীচের অফিস-ফেরতা ঝুলন্ত লোকেদের দুর্দশা একটু যেন করুণার চোখে দেখতেন। ঝুলন্ত লোকেরা দোতলায় সিট পাওয়া প্রিভিলেজড’দের প্রতি দু-চারটে টিপ্পনী ছুড়ে দেওয়ার সুযোগ ছাড়তেন না।

আমি তখন কলেজে পড়ি। কলেজে যাওয়ার সময় আট নম্বর বাসে করে মিন্টো পার্ক নামতাম। ভাড়া লাগত পনেরো পয়সা। ফিরতাম জওহরলাল নেহরু রোড ধরে। এখন যে জায়গাকে এক্সাইড মোড় বলা হয়, তখন তাকে বলা হত কংগ্রেস অফিস। পরের স্টপেজ এলগিন রোড, প্রায় হাফ ডজন ‘লক্ষ্মীবাবু কা অসলি সোনা চাঁদি কা দুকান।’ সবাই ‘অসলি’।

বালিগঞ্জ থেকে বাগবাজার, ডবলডেকার টু-বি।

সত্তরের দশকের কলকাতার রাজপথে এগিয়ে চলেছে গজেন্দ্রগমনে।

বাসের দোতলায় উঠে এক বার লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেই বসার ব্যবস্থা প্রায় পাকা। লাইন আবার ওপরের দুটো সিট পর্যন্ত যেত। বাস যখন এলগিন রোড পেরিয়ে যেত, তখন উঠত স্কুলপড়ুয়া দুটো মেয়ে। শ্যামলী আর জলি। ওরা কোনও কিছুই মানত না। গটগট করে এগিয়ে চলে যেত প্রায় সামনে। সিটে গিয়ে বসত। স্কুলের মেয়েদের সব ছুট।

তখন হিন্দি সিনেমা ‘পাকিজা’র যুগ। শ্যামলী বাসে বসেই গান ধরত ‘চলতে চলতে’। টু বা টু-বি চলত হেলতে দুলতে। বাস থেকেই দেখা যেত মেট্রো রেল (তখন বলা হত পাতাল রেল) তৈরির কারুকাজ।

পাতাল রেলের কাজের জন্য রাস্তার এক দিক এক দিন বন্ধ করে দেওয়া হল। মধ্যিখানের ট্রামলাইনের ওপর দিয়ে বাস চলাচল চালু হল। হাজরা রোডের পর অধিকাংশ বাস ঘুরিয়ে দেওয়া হল হরিশ মুখার্জি রোড দিয়ে। আশুতোষ মুখার্জি আর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের দৈর্ঘ্য হয়ে গেল অর্ধেক। তবু টু আর টু-বি রুট থেকে গেল অপরিবর্তিত।

কসবার সুইনহো লেনের যে বাড়িতে থাকতাম, সেখান থেকে হেঁটে চলে আসতাম একডালিয়া পার্কের কাছে। বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে রেলগেট ছিল এক বিভীষিকা। এক বার বন্ধ হলে খুলত কমপক্ষে দু-তিনটি ট্রেন গেলে। আবার মালগাড়ি হলে তো কথাই নেই। গেট বন্ধ হলে এক ফেরিওয়ালা ইঁদুর মারা বিষ বিক্রি করত। বাজনা সহ বলত, ‘খাবে আর মরবে, খাবে আর মরবে।’ এই অঞ্চলের সবাই ওর মুখচেনা ছিল।

রবিবার সকালের পড়ার পর অনেক সময় টু বা টু-বি বাসে চেপে চলে যেতাম পাইকপাড়া বা বাগবাজার। দু-তিন ঘণ্টা দিব্যি কেটে যেত দোতলা বাসে।

এক দিন বাস এলগিন রোড পেরোতেই দেখা গেল জলিকে। একা, চুপচাপ। লাইনেও দাঁড়াল না। আমি বললাম, বন্ধু কোথায়? ও ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল, ‘নেই। আর কোনও দিনও আসবে না।’

সেই ফুটফুটে মেয়েটির মৃত্যুসংবাদে স্তব্ধ হলাম। তারও বেশ কিছু বছর পর, দোতলা বাসগুলোও বন্ধ হয়ে গেল শহরের পথে। এই দোতলা বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া যেন কলকাতার একটা অভিজ্ঞান হারিয়ে যাওয়ার মতো। দোতলা বাসে কি বেশি আরাম হত? জানি না। দোতলা বাস কি তাড়াতাড়ি অনেক মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দিত? জানি না। দোতলা বাসের রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন হয়ে পড়ছিল নিশ্চয়, তাই বন্ধ হয়ে গেল? হতে পারে।

আমি কেবল এটুকু জানি, আমাদের বড় হয়ে ওঠার সময়, কলকাতা যখন সত্যিকারের কলকাতা ছিল, তখন দোতলা বাস কলকাতা-জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটা অঙ্গ ছিল। দোতলা বাস উঠে যাওয়ায় নিত্য জীবনে হয়তো কারও কিছু কম পড়েনি। কিন্তু কলকাতার কলকাতাত্ব অবশ্যই অনেকটা কমে গিয়েছে।

স্বপনকুমার চক্রবর্তী, বিহারী মণ্ডল রোড

napawskumar@yahoo.co.in

সৎতরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 70’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন