জা স্ট যা চ্ছি

ভুল পুজো, কুঁজো বুড়ি আর মমির আকর্ষণ

পুজোর সময় বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি হবেই, সবাই বলছিল। পরিবেশের লোক, আকাশওয়ালা, মেঘের কারবারিরা শিঙা ফুঁকে যাচ্ছিল ক্রমাগত। মায়ের গর্ভে নিশ্চিন্তে উলটে থাকা শিশুর মতো গাঙ্গেয় উপত্যকার ছবিও দেখা যাচ্ছিল টিভিতে, মনিটরে, কাগজে।

Advertisement

শুভময় মিত্র

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share:

ছবি: শুভময় মিত্র

পুজোর সময় বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি হবেই, সবাই বলছিল। পরিবেশের লোক, আকাশওয়ালা, মেঘের কারবারিরা শিঙা ফুঁকে যাচ্ছিল ক্রমাগত। মায়ের গর্ভে নিশ্চিন্তে উলটে থাকা শিশুর মতো গাঙ্গেয় উপত্যকার ছবিও দেখা যাচ্ছিল টিভিতে, মনিটরে, কাগজে। ঝাড়খণ্ডে কুণ্ডলী পাকানো মেঘগুলো বড় হচ্ছে, সরে আসছে পুবে, পুজোর সময়ে বৃষ্টি প্রসব করবে। এই বৃষ্টি, এই রোদ্দুর। মহালয়া হয়ে গেল। প্লাস্টিক চাপা ঠাকুরের ভারী মুখে চোখ ফুটল। বছর পাঁচ আগেও পঞ্চমীতে ফাঁকা প্যান্ডালে কাপড়চাপা দুর্গার পায়ের তলায় বাচ্চারা গুলি খেলত। এখন ঠাকুর আর নানান আর্ট আগেই দেখে ফেলা দরকার। তাই রাস্তায় বাস, গাড়ি নড়তেই চায় না। কারণ, আসল পুজোয় ভয়ংকর ভিড়। স্ট্যাম্পেডের ভয়। ঘ্যাম পুজোর কর্ণধারেরা খুঁটিপুজো থেকেই হুংকার ছাড়ছেন। পকেট, বুদ্ধি ও কনুইয়ের জোর না থাকলে প্যান্ডাল হপিং অসম্ভব। তাই, ভয়ে আর হতাশায় তৃতীয়াতেই আমার সব উৎসাহ ভাসান দিয়ে ফেললাম।

Advertisement

পার্ক স্ট্রিটের ফাঁকা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে নারকোল দিয়ে মুড়ি খাচ্ছিলাম। এখানে পুজোর প নেই। সিগনাল পেলেই ঠাসা লোক ভর্তি গাড়ি ছিটকে যাচ্ছে উত্তরে আর দক্ষিণে। মেট্রো স্টেশনের দরজায় শয়ে শয়ে বেরিয়ে আসা যুদ্ধক্লান্ত অথবা ঢোকার ভয়ে পাংশু চেহারাগুলোও নেই। কারণ, এই সময় এখানে কেউ নামছে না। উঠছেও না। রাস্তার খাবার দোকানগুলোও ফাঁকা। এর মধ্যে একটা ব্যাপার ঘটছে দেখে দাঁড়ালাম। ইন্ডিয়ান মিউজিয়মের পাশের সিঁড়িতে একটা লোক পুরনো কয়েন বিক্রি করে। সে চেঁচাচ্ছে। কারণ এক বুড়ি তার কাছে বার বার ভিক্ষে চাইছে। হাতের উল্কি দেখেই বুঝতে পারলাম সে বাঙালি নয়। দিলাম দু’টাকার কয়েন। দিতেই সে লোকটাকে ছেড়ে আমার হাত ধরল। কুঁজো, সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারে না। কোমরের তলাটা সচল। হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার কোনও চেষ্টাই করলাম না। আমার কোনও বান্ধবী নেই যার নরম হাতটা এই সময় আমাকে জড়িয়ে রাখবে। ডজন খানেক বেখাপ্পা কাচের চুড়ি মোড়া একটা ঠান্ডা খরখরে হাত জুটেছে। মন্দ কী! বুড়ি কিছু বলছে, এতই দুর্বোধ্য, এতটাই নীচ থেকে শব্দগুলো আসছে যে শুনতেও পাচ্ছি না। গান ফুরনোর পর সেভেন্টি এইট আরপিএম-এর রেকর্ডের ওপর পিন ঘষে চলার মতোই অাওয়াজ। টান পড়ল একটু। এগোলাম।

হাত তো ছাড়ছে না, যাব কোথায়? রোদটা দুম করে চলে গেল। মাথার ওপর গুড়ুম করে বুদ্ধি খেলে গেল। চৌরঙ্গিতে একা ঘুরে বেড়ানো লোক নয় এ। নির্ঘাত দলের সঙ্গে এসেছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রবল সম্ভাবনা মিউজিয়মে যাওয়ার। ওর দলটাকে খুঁজে পেলে হ্যান্ড ওভার করা যাবে। মিউজিয়মটাও দেখে নেওয়া যাবে, বহুকাল যাই না। দুটো টিকিট কেটে বুড়িকে বগলে নিয়ে জাদুঘরে ঢুকলাম। ইউপি-বিহার থেকে আসা দল খুঁজতে লাগলাম। চোখে পড়ল না। আজ যারা এখানে ঢুকেছে তারা প্রত্নতত্ত্বের লোক নয়। আমাদের মতোই কোথাও যেতে না পারা দুর্বল ভবঘুরে। মাথা তুলে এ-দিক ও-দিক সাইনবোর্ড দেখে কোন ঘরে ঢুকবে সেটা বিবেচনা করার মতো মানসিকতা আমার সদ্য পাওয়া গার্লফ্রেন্ডের নেই। কিন্তু বাঁ দিকের সিঁড়ির চওড়া ধাপটা সে দেখেছে। এগোচ্ছে। উঠতে চায়। রইলাম সঙ্গে। অনেক সময় নিয়ে দোতলায় পৌঁছলাম। ভাবলাম ক্লান্ত হয়ে বসে পড়বে মাটিতে। বসল না। গুটগুট করে এগোল সদ্য খোলা বেঙ্গল আর্টের গ্যালারির দিকে। ঢুকেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বুড়ির হাতটা ছেড়ে দিলাম। দেওয়াল থেকে ঝোলা পরপর ছবিগুলোর তলা দিয়ে সে হাঁটতে লাগল খুব আস্তে আস্তে। মাথা তুলে ছবিগুলো যে দেখবে সে উপায় নেই। অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, যামিনী রায় বা অতুল সুরের সুভাষ বোস দেখে করবেই বা কী? যদিও প্রায় প্রত্যেকটা ছবির নীচেই সে এক বার দাঁড়াচ্ছিল। তার পর এগোচ্ছিল। ঘরের মধ্যে ফিকে চেহারার একটা ফরেনার মেয়ে ঘুরছিল। হাতে ছোট্ট ক্যামেরা। বুড়ি যেই বোধিসত্ত্বের ছবির তলায় পৌঁছেছে অমনি তার একটা ছবি তুলল ভার্টিকাল ফ্রেমে। কলকাতার দুর্গাপুজোয় সে নিশ্চয়ই একটা ভারতমাতা খুঁজে পেয়েছে। চোখাচোখি হল। আমি বললাম, ‘ইটারনাল ইন্ডিয়া’। হাসল। বলল, ‘আমি ছবিটা পাঠিয়ে দিতে পারি।’ বললাম, ‘ওর ই-মেল আইডি নেই।’ বাড়ি কোথায় তাই তো জানি না।

Advertisement

বুড়ি এক জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে। স্ট্যাচুর মতো। পাথরের এমন বহু মূর্তি রয়েছে মিউজিয়মে। অনেক দিন আগে দারুণ সেক্সি একটা পাথরের নর্তকী দেখেছিলাম। সেটা কোথায় আছে কে জানে। বলা যায় না। হয়তো বুড়ির গ্রামের থেকে কিছু দূরের জঙ্গলের মাটি খুঁড়ে তাকে পাওয়া গেছে। বুড়ি দাঁড়িয়েই আছে। তার মাথার ঠিক ওপরেই বিখ্যাত ছবি ‘গণেশ জননী’। ওকে দেখানো দরকার। এসেই যখন পড়েছে। দলকে খুঁজে না পেলে নাহয় থানায় জমা করে দেওয়া যাবে। আশেপাশে কেউ নেই।

ঝপ করে ওকে তুলে নিলাম পাঁজাকোলা করে। বুড়ির মাথা এখন ছবির সামনে। খোলা চোখে সে দেখছে কালোত্তীর্ণ শিল্প। হাত দুটো নড়াচড়া করে উঠল। জড়ো হল ফাটাফুটো দুখানা তালু। কী লেখা কেউ জানে না, সেই কপালে ছুঁইয়ে প্রণাম করল। আমি ওকে নামিয়ে দিলাম। ওজনই নেই। মিনিট খানেক থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। কাঁপছিল থরথর করে। যেন, আবার চলতে চাইছে। ধরলাম হাতটা।

ডান দিকে ঘুরে ইজিপ্সিয়ান রুম। ভেতরটা একটু অন্ধকার। লোকজনের ভিড় মনে হল। হল্লা চলছে। বুড়ি ঢুকতে চাইছে। ঢুকতেই এক দল দেহাতি। একটা বুড়ো, অনেক মহিলা, বাচ্চাকাচ্চা। বুড়িকে দেখেই হাহা করে হাসতে লাগল, ‘এসে গেছে এসে গেছে।’ বাঁচা গেল। ওরই দলের লোক। কিন্তু দায়িত্বজ্ঞান নেই। বুড়ি ছিটকে গেছে বুঝেও খোঁজাখুঁজি করেছে বলে মনে হল না। এখন দেখতে পেয়ে হ্যা হ্যা করে হাসছে। অন্ধকারে বুড়িও খুশি কি না বুঝলাম না। হলুদ আলোর বাক্সয় পোরা নেফারতিতি, রামেসিসের পুতুল-মূর্তির তলা দিয়ে দর্শকদের কোমর আর পায়ের ফাঁক দিয়ে নিজস্ব গলিপথ খুঁজে নিয়ে সে এগিয়েই চলেছে। ঘরের ঠিক মাঝখানে কাচের বাক্সর মধ্যে শোয়ানো মমি। বীভৎস খুলিটা বেরিয়ে। বুকের ওপর তারই মডেল মুখাবয়ব। এটাই মুখ্য আকর্ষণ। মৃত্যু খুব আকর্ষণীয় ব্যাপার। পুড়িয়ে ফেলা হয়। কবর দেওয়া হয়, পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায় মরা মানুষ। ছবি আর স্মৃতি ছাড়া কিছুই থাকে না। এদের ব্যাপারই আলাদা। মমিটা যেন আরও জ্যান্ত হয়ে ওঠে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে দর্শনার্থীদের আগ্রহভরা চোখের দিকে।

‘অ্যাইসা বনানা হ্যায় ক্যা?’ শুনতে পেলাম। হাসিঠাট্টা চলছেই। বুড়ি থেমে গেছে। তার মাথা থেকে মমির খুলিটা কয়েক ইঞ্চি দূরে। মাঝখানে কাচ। সেখানেই কপালটা ঠেকিয়ে রেখেছে। বিড়বিড় করে কী সব বলছে। প্রণাম করছে না যদিও। দলটা ক্যালরব্যালর করেই চলেছে। রাগ হচ্ছিল, কিছু বললাম না। আমার দায়িত্ব শেষ, অন্য কোথাও কেটে পড়ব। বুড়োকে একটু তাচ্ছিল্যভরেই বললাম, ‘ইয়ে ক্যা হ্যায়? মালুম হ্যায় আপকো?’ অত্যন্ত কনফিডেন্টলি সে বলল, ‘জরুর, ই তো কলকাত্তাকা মণিকর্ণিকা ঘাট হ্যায়।’

suvolama@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement