হট করে মনে পড়ল

তখন আমি বি.কম ফার্স্ট ইয়ার, সালটা ১৯৮১। আমরা ক’জন ক্রিকেটপাগল বন্ধু হাওড়া রেলওয়ে ক্লাবের পিচের রাস্তার ওপর নেট প্র্যাকটিস করতাম। প্রতি দিনই প্র্যাকটিসের পরে বাইরে কালুর চায়ের দোকানে পাউরুটি-ঘুগনি আর চায়ের অর্ডার দিয়ে ফাঁকা বাসে (মেরামতির জন্য আসা) বসে, গার্লস কলেজগামী তরুণীদের দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে একে অন্যকে সান্ত্বনা দিতাম।

Advertisement

ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৬ ০০:০৩
Share:

তখন আমি বি.কম ফার্স্ট ইয়ার, সালটা ১৯৮১। আমরা ক’জন ক্রিকেটপাগল বন্ধু হাওড়া রেলওয়ে ক্লাবের পিচের রাস্তার ওপর নেট প্র্যাকটিস করতাম। প্রতি দিনই প্র্যাকটিসের পরে বাইরে কালুর চায়ের দোকানে পাউরুটি-ঘুগনি আর চায়ের অর্ডার দিয়ে ফাঁকা বাসে (মেরামতির জন্য আসা) বসে, গার্লস কলেজগামী তরুণীদের দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে একে অন্যকে সান্ত্বনা দিতাম।

Advertisement

একটা ঝকঝকে সকাল। আমরা প্র্যাকটিসে ক্লান্ত। বাসের ভেতর সদ্য কালুর পাঠানো গরম ঘুগনির প্রথম চামচটা তুলেছি। হঠাৎ চোখে পড়ল, উলটো দিকে একটা গাছে একটা ছেলে উঠে গাছের ডালে দড়ি বাঁধছে। ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল— ‘ইন্দ্র, কুইক, দ্বিতীয় স্লিপের দিকেই ব্যাটসম্যানের স্নিক্‌টা আসছে।’

কাউকে কিছু না বলেই এক লাফে বাস থেকে রাস্তায়, মাঝপথে কালুর দোকান থেকে পাউরুটি কাটার ছুরি তুলে নিয়েই এক দৌড়ে রাস্তার ও-পারে এক লাফে গাছে। আমি ডাল ধরে উঠছি, ওর কাছে পৌঁছে গেছি প্রায়, আর ছেলেটিও হাত ছাড়ছে গলায় দড়ি দিয়ে। পুরো হিন্দি সিনেমা। আমিও দড়ির মাঝে ছুরির ছড় টেনে দিয়েছি। ফলে দুজনে স্ট্রেট গাছতলার দুঃখশয্যায়। ঘাড়ের ওপর ছেলেটির সব ভার নিয়ে হাত-পা কেটে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছি।

Advertisement

ইতিমধ্যে বন্ধুরা সব হাজির। ওরা তো কিছু বুঝে উঠতেই পারছে না! ছেলেটিকে এনে বাসে বসানো হল। দৃষ্টি ঘোলাটে, থরথর করে সারা শরীর কাঁপছে, কথা বলার অবস্থাতেই নেই। কালুর দোকান থেকে গরম দুধ, ডিম আর পাউরুটি আনিয়ে খাওয়ানো হল। কিছুটা ধাতস্থ হলে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন গলায় দড়ি দিচ্ছিল।

গল্পটা এ রকম: লালগোলা নেতাজি কলোনির ছেলে সুভাষ অল্প বয়সেই মাতৃহারা, বাপ চাষি, একটা ছোট বোন, বয়স চোদ্দো-পনেরো— এই সংসার। খুব গরিব। তাই অল্প বয়সেই সুভাষ কলকাতায়। শিয়ালদার পাইস হোটেলে ‘বয়’-এর কাজ। মাসে দু’শো-আড়াইশো আর দু’বেলার খাওয়ার চুক্তিতে চাকরি।

দিন দুয়েক আগে ‘তোর বাবার শরীর খুবই খারাপ, পারলে এক্ষুনি বাড়ি রওনা হ’— জানিয়ে গেছে পাড়াতুতো এক কাকা। এ কথা শুনেই মালিকের কাছে ছুটি আর মাইনের টাকাটার আর্জি। নিট ফল ঘাড়ধাক্কা, চাকরি খতম। অগত্যা টিকিটহীন অবস্থায় ট্রেনে চড়ে পড়া আর যথারীতি রেল-পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দু’দিনের হাজতবাস। কপাল মন্দ হলে যা হয় আর কী!

এখানেই শেষ নয়। হাজত থেকে বাইরে বেরিয়ে একটাই চিন্তা— বাড়ি যেতে হবে। বাবা বেঁচে আছে তো? বোন কার কাছে? টাকা চাই, কিন্তু কী ভাবে? কাকতালীয় ভাবে উপকারী বন্ধুও জুটে যায় রাস্তায়। টাকার আশা দেখিয়ে নিয়ে যায় মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে। দু’বোতল রক্ত দেওয়ার পর বন্ধুর খোঁজে গিয়ে দেখা যায় সে নেই! রক্ত বেচার টাকা নিয়ে দালাল-বন্ধু হাওয়া। অগত্যা সিদ্ধান্ত আত্মহত্যার।

একটানা কথা বলে ক্লান্ত সুভাষ দেখাল তার হাতের স্টিকিং প্লাস্টার— রক্ত নেওয়ার পর যা লাগানো হয়েছে।

অতঃপর সুভাষকে নিয়ে আমাদের পাড়া পরিক্রমা। দোকান, কারখানা, পাড়ার সাধারণ মানুষ— সকলের কাছে সাহায্য সংগ্রহ। তার পরে ওকে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে ট্রেনে তুলে দিলাম আমরা। যাওয়ার আগে সুভাষের চোখের জল বাধা মানেনি।

আমরা সুভাষকে বার বার বলে দিয়েছিলাম— কী হল না হল তার একটা খবর যেন অন্তত দেয়। কিন্তু সুভাষের কোনও খবর আমরা পাইনি। কে জানে, ওর কী হল?

বোনকে অক্ষত পেল কি? বাবার শেষ কাজটা কি করতে পেরেছিল? কোনও কাজকর্ম কি করছে ও? না কি অন্ধকারে হারিয়ে গেল, কিংবা মুছেই গেল একেবারে, আত্মহত্যার হাতছানি এড়াতে না পেরে?

neelbolchi@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন