তুই কাতুকুতু নিলি কেন?

আমি হোস্টেলে থাকতাম। কিছু শিক্ষক আমাদের ওয়ার্ডেন হিসেবে থাকতেন। তাঁদেরই এক জন ছিলেন ‘উপি’। পদবি ‘উপাধ্যায়’ থেকে আমরাই নিকনেম-টা বানিয়ে নিয়েছিলাম। উপি-র জীবনের মোক্ষ ছিল ছাত্রদের নানা ভাবে টর্চার করা। হোস্টেলের ছাত্রদের উনি দু’ভাগ করে নিয়েছিলেন।

Advertisement

রজত সরকার

শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৪১
Share:

আমি হোস্টেলে থাকতাম। কিছু শিক্ষক আমাদের ওয়ার্ডেন হিসেবে থাকতেন। তাঁদেরই এক জন ছিলেন ‘উপি’। পদবি ‘উপাধ্যায়’ থেকে আমরাই নিকনেম-টা বানিয়ে নিয়েছিলাম। উপি-র জীবনের মোক্ষ ছিল ছাত্রদের নানা ভাবে টর্চার করা। হোস্টেলের ছাত্রদের উনি দু’ভাগ করে নিয়েছিলেন। এক দলের ওপর ওঁর ‘গুড ইম্প্রেশন’, এক দলের ওপর ‘ব্যাড ইম্প্রেশন’। গুড-রা খুন করলেও পার পাবে, আর ব্যাডরা হাঁচলেও নিলডাউন। ব্যাডদের শায়েস্তা করার জন্য উনি নিত্যনতুন ফন্দিও আঁটতেন।

Advertisement

আমাদের নিয়ম ছিল, সব জিনিসের জন্য দুটো করে ঘণ্টা বাজবে। ফার্স্ট বেল-এ তুমি বুঝবে, সময় হয়ে এসেছে, আর সেকেন্ড বেল-এর পর যদি পৌঁছও, তা হলে ‘লেট’। একটি ছেলে পি.টি. করে ফিরল। সে ব্যাডের দলে। উপি তাকে ডেকে হাবিজাবি কারণে ধমকাতে শুরু করলেন। প্রেয়ারের ফার্স্ট বেল পড়ে গেলে, তবে তাকে ছাড়লেন। ছেলেটি পড়িমরি করে পি.টি. ড্রেস ছেড়ে, প্রেয়ারের জন্যে তৈরি হয়ে, প্রেয়ার হল-এ ঢুকতে ঢুকতে, সেকেন্ড বেল পড়ে গেল। উপি ধরলেন, ‘তুই লেট করলি কেন?’ ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, ‘স্যর, আপনিই তো...’ সঙ্গে সঙ্গে ঠাস থাপ্পড়। ‘আমার মুখে মুখে কথা? নিলডাউন হ।’ এ বার ছাড়লেন স্টাডি হল-এর ফার্স্ট বেল পড়ার পর। সে বইখাতা গুছিয়ে পড়িমরি ছুটতে ছুটতে সেকেন্ড বেল পড়ে গেল। আবার, ‘তুই লেট করলি কেন?’ এই ভাবে সারা দিন ধরে ছেলেটি থাপ্পড় ও নিল়ডাউনের ওপর থাকল।

শিক্ষকরা খেতে বসতেন আমাদের সামান্য পরে, ওঁরা ভাল ভাল খাবার খেতেন। উপি সেই সময় একটা বিচারসভা বসাতেন। খাবার চিবোতে চিবোতে তারিয়ে তারিয়ে আসামি-ছাত্রদের অপমান করতেন। কেউ হয়তো ভাত ফেলেছে। কেউ হয়তো খেতে খেতে পাশের ছেলেটির সঙ্গে কথা বলেছে। উপি বললেন, ‘এ ছেলেটা একেবারে পচে গেছে!’ সঙ্গে সঙ্গে অন্য শিক্ষকরা ‘ঠিক, ঠিক’ বলে টিকটিকির মতো সায় দিয়ে উঠলেন। এক জন আরও চিমটি কেটে বললেন, ‘দেখুন, কেমন মিচকের মতো তাকাচ্ছে। অতি ধড়িবাজ। একে রাখলে বাকি ছেলেগুলোও পচে যাবে।’ আর এক জন পোঁ ধরলেন, ‘অঙ্কেও তো সাতাশ পেয়েছিল।’ পুরো সময়টা ছাত্রেরা কাঁপতে কাঁপতে ভাবছে, ক’টা চড় বা বেতের ঘা আজ অপেক্ষা করছে। খাওয়া শেষ হলে, হাতটাত ধুয়ে, মুছে, উপি জম্পেশ করে পেটাতে শুরু করতেন। পেটানোর আগের ওই আধ ঘণ্টা ধীরেসুস্থে ছেলেগুলোকে ভয়ে আধমরা করাটা ছিল ওঁর ইনোভেশন। অন্য শিক্ষকরাও অসহায়দের মজাসে অত্যাচার করাটা প্রবল উপভোগ করতেন।

Advertisement

এক বার প্রেয়ার হল-এ এক জন ছাত্র ফিকফিক করে হেসে ফেলেছে। সাংঘাতিক অপরাধ। উপি ছেলেটিকে ডাকলেন। ‘হাসছিলি কেন?’ সে বলল, ‘স্যর, শুভেন্দু আমায় কাতুকুতু দিয়েছিল।’ উপির ভুরু কুঁচকে গেল। শুভেন্দুর ওপর ওঁর গুড ইম্প্রেশন। ‘ডাক শুভেন্দুকে।’ শুভেন্দু এসে কাঁচুমাচু হয়ে তক্ষুনি স্বীকার করে নিল, ‘হ্যাঁ স্যর, আমিই ওকে কাতুকুতু দিয়েছিলাম।’ সবাই শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। এ বার তো উপি গুড-কে শাস্তি দিতে বাধ্য! এ দিকে হেসে-ফেলা ছেলেটি ব্যাডের দলে। তা হলে ওকে ছেড়ে দিতেও তো উপির অসম্ভব আপশোস হবে। উপি দু’সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে, ব্যাড ইম্প্রেশনের ছেলেটিকে চুল ধরে প্রচণ্ড পেটাতে শুরু করলেন। চেঁচাতে লাগলেন, ‘শুভেন্দু নাহয় কাতুকুতু দিয়েছিল। তুই নিয়েছিলি কেন!’

স্কুলের শিক্ষক/শিক্ষিকা কি নিষ্ঠুর বা উদ্ভট ছিলেন? বিবরণ লিখে পাঠান ৪০০ শব্দে এই ঠিকানায়:
গাঁট্টা, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement