ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
অধিকাংশ পড়ুয়ারই একটা একটা বিষয়ে আতঙ্ক থাকেই। মৃগাঙ্কের তেমনি বাংলায় আতঙ্ক! ক্লাস ফাইভ থেকে সেই একই জিনিস চলছে। বাংলায় কখনও সে পঁয়ত্রিশের গণ্ডি টপকাতে পারেনি। ক্লাস টেনে টেস্ট পরীক্ষার দোরগোড়ায় এসে মৃগাঙ্কের মনে হল এ বার অবস্থা যেন আরও সঙ্গিন। পঁয়ত্রিশ তো দূর, তিরিশ তুলতেই বোধ হয় দম বেরিয়ে যাবে। পুজোর ছুটির পর দু’দিন হল স্কুল খুলেছে। আর দিন তিনেক ক্লাস হওয়ার পরই টেস্ট পরীক্ষা। বিপদ ঘোরতর বুঝে অগত্যা বাংলা স্যরের শরণাপন্ন হল মৃগাঙ্ক। টিচার রুমের নিরিবিলিতে স্যরকে একলা পেয়ে মুখটাকে কাঁচুমাচু করে বলল, ‘পুজোর ছুটিতে অনেক ঘাম ঝরালাম, তবু উন্নতি কিছু হল না স্যর। বাংলার রাহু এ বার আমাকে বোধ হয় গিলেই খাবে! আপনি তো ছাত্রদরদি মানুষ, তাই মৌখিকে কম করে হলেও দশে পাঁচ না দিয়ে পারবেন না। এর পর রচনা বাদ দিয়ে বাকি প্রশ্নে পঁচাত্তরে টেনেটুনে কুড়ি হয়তো হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা হল রচনাকে নিয়ে। রচনায় পনেরোয় পাঁচ না পেলে নির্ঘাত ধ্যাড়াব স্যর!’
বাংলা স্যর অপূর্ববাবু বেশ রসিক মানুষ। অকালপক্ক ছাত্রটির কথায় মিটিমিটি হেসে বলে উঠলেন, ‘তা এ ব্যাপারে আমি কী করতে পারি?’
মৃগাঙ্ক হাতজোড় করল, ‘অন্য কিছু নিয়ে আপনাকে বিরক্ত করব না, তবে রচনা নিয়ে কিছু একটা হিন্টস আপনাকে দিতেই হবে। নইলে পুরো মারা পড়ব, স্যর। একেবারে চিৎপটাং, প্লিজ স্যর!’
ক্লাস টেনের ডাকাবুকো ছেলেটির আবদার শুনে ক্ষনিকের জন্য গম্ভীর হয়ে গেলেন অপূর্ববাবু। পরক্ষণে মুখে হাসি টেনে বললেন, ‘হিন্টস দেওয়া মানে তো প্রশ্ন লিক করে দেওয়া। ও-সব বাপু আমার দ্বারা হবে না। তবে হ্যাঁ, এ ব্যাপারে স্কুলের বাস্তুভূতটা তোকে সাহায্য করতে পারে! পারলে তার সঙ্গে মুলাকাত কর!’
— স্কুলের বাস্তুভূত... তার সঙ্গে মুলাকাত! কী বলছেন আমি তো কিছু বুঝতেই পারছি না স্যর! বিস্ময়ে মৃগাঙ্কের চোয়াল প্রায় এক হাত ঝুলে পড়ল।
— শোন মৃগাঙ্ক, তোরা ভয় পাবি তাই বলিনি। রাতবিরেতে স্কুলচত্বরে এক অশরীরী ঘুরে বেড়ায়! স্কুল কোয়ার্টারে বাসিন্দা হওয়ায় আমি তাকে বহু বার দেখেছি। বছর দুয়েক আগে এক বার ক্লাস নাইনের উত্তরপত্রের একটা বান্ডিল ভুল করে টিচার রুমে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলাম। রাত দশটা নাগাদ সেটা ফেরত নিতে এসে দেখি সে মক্কেল বসে বসে উত্তরপত্রগুলো দেখছে। মুহূর্তের দর্শন বলতে পারিস, আলো দেখেই বাতাসে মিলিয়ে গেল। এর পর গত বছর তোদের ইউনিট টেস্টের সময় আর এক কাণ্ড। সে বার প্রশ্নপত্রের ফাইনাল খসড়াটা ভুল করে টিচার রুমে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলাম। পর দিন এসে দেখি লাল কালি দিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন কাটা! পাশে স্টার দিয়ে লেখা, ভূত হলেও অশিক্ষিত আমি নই। ক্লাস নাইনে এত কঠিন প্রশ্ন দেওয়ার কোনও মানে হয় না! তাই বলছি সাহস থাকলে ওই ভূতটাকে ধর। স্কুলের সব প্রশ্নের খবর ওর নখদর্পণে। ওকে তুষ্ট করতে পারলেই এ বারকার টেস্ট পরীক্ষায় কোন রচনা আসতে পারে, তার একটা সংকেত ঠিক পেয়ে যাবি!
— ভূতকে ধরব! মৃগাঙ্ক ঢোঁক গিলল, ‘আর ধরলেই বা সে আমাকে বলবে কেন? খেপে গিয়ে ঘাড়ও তো মটক্ েদিতে পারে।
— ওর দ্বারা আজ পর্যন্ত কারও ক্ষতি হয়েছে বলে তো শুনিনি। তুষ্ট করতে পারলে বলবে না কেন, নিশ্চয় বলবে। গত বছরই তো, মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষার সময় অশোক নামে আমার এক ছাত্র এই পথে সাফল্য পেয়েছিল। বাংলায় ডাব্বা খাওয়া ওরও প্রায় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু প্রেতটার দৌলতে দিব্যি পঞ্চাশ পেয়ে গেল!
— কিন্তু ভূতকে তুষ্ট... কী ভাবে সম্ভব সেটা?
— শুনেছি সে নাকি আমসত্ত্বের ভক্ত। তা নিয়ে যাবি এক প্যাকেট আমসত্ত্ব।
স্যরের কথাটা খুব মনে ধরল মৃগাঙ্কের। তবু ভূত বলে কথা, দেখামাত্রই হাড়ে যে কাঁপন ধরবে, তা একপ্রকার নিশ্চিত। কিন্তু বাংলায় পাশ করতে হলে এটুকু ঝুঁকি তাকে নিতেই হবে। তাই দ্রুত মনোস্থির করল মৃগাঙ্ক। চোয়াল শক্ত করে অপূর্ববাবুকে বলল, ‘শুভস্য শীঘ্রম স্যর। আজ রাতেই তা হলে অভিযানে নামছি। দেখি কদ্দূর কী সুরাহা হয়!’
স্কুলের পাড়াতেই মৃগাঙ্কদের বাড়ি। রাত এগারোটার পর বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নিঃশব্দে স্কুল গেটের সামনে গিয়ে হাজির হল মৃগাঙ্ক। ইউ আকৃতির দোতলা স্কুলবাড়ি। মাঝখানে ছোট্ট মাঠ। আজ কৃষ্ণা চতুর্দশী। ছাতিম, নিম আর আমগাছেদের সঙ্গে হরেক কিসিমের ফুলগাছের ভিড়ে মাঠে অন্ধকার আরও জমজমাট যেন। আমসত্ত্বের প্যাকেটটার জন্য প্যান্টের পকেটটা ফুলে রয়েছে। তার উপর একপ্রস্থ হাত বুলিয়ে গেটের পাশের পাঁচিলের ভাঙা অংশটা দিয়ে ভেতরে সেঁধিয়ে পড়ল মৃগাঙ্ক। তার পর এক পা-দু’পা করে এগিয়ে পড়ল সামনের দিকে।
মনে মনে প্রস্তুতি একটা নিয়েই রেখেছিল, তবু পনেরো-ষোলো গজ এগিয়ে ঝুপসি আমগাছটার নীচে পৌঁছনোমাত্রই বুকের নীচে ধড়াম করে উঠল মৃগাঙ্কের। ডান দিকে ছায়া-ছায়া ওটা কী? স্কুল কোয়ার্টার সংলগ্ন পাঁচিলের উপরে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে কে বসে আছে পা ঝুলিয়ে? ছায়ামূর্তির পা দুটো এতটাই লম্বা যে ছ’ফুট উঁচু পাঁচিলের উপর থেকে পাজামার শেষ প্রান্তটুকু মাটিতে এসে লটপট করছে! মৃগাঙ্কের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল একটা স্রোত চকিতে পায়ের দিকে নেমে গেল। বুকের কাঁপন চাপা দিয়ে সে ভাবল, এই কি তবে সেই বাস্তুভূত, যার কাছে রচনার সংকেত তাকে চাইতে হবে! কিন্তু কী করে কথাটা পাড়বে মৃগাঙ্ক? ওর গলা যে শুকিয়ে কাঠ। তবু অনেক চেষ্টার পর সাহসে ভর করে মুখ খুলতে যাওয়ার মুহূর্তে ছায়ামূর্তির পৈশাচিক হাসি ওকে টলিয়ে দিল। আতঙ্কের আতিশয্যে চোখে অন্ধকার দেখল মৃগাঙ্ক। এমন অন্ধকার যে নিমেষে ভিরমি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
এ ভাবে কত ক্ষণ যে পড়ে ছিল হুঁশ নেই মৃগাঙ্কের। টনক নড়ল অপূর্ববাবুর ঝাঁকুনিতে। ওকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বাংলা স্যর বলছেন, ‘এই মৃগাঙ্ক ওঠ ওঠ। ভয় নেই, দ্যাখ আমি এসে গেছি।’
স্যরের নাড়া খেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল মৃগাঙ্ক। ওকে উঠে বসতে দেখে অপূর্ববাবুর গলায় উদ্বেগ ঝরে পড়ল, ‘তুই কি ওই বাস্তুভূতটার খোঁজে এসেছিলি?’
মৃগাঙ্ক চিঁ-চিঁ করে উঠল, ‘হ্যাঁ স্যর।’
— তা দেখা পেলি তেনার?
— হ্যাঁ স্যর।
— কী বলল সে?
— বলবার আর সময় পেল কই। তার আগেই তো ভয়ে আমি বেহুঁশ!
— যাচ্চলে। তা হলে তোর খাটনিটাই তো মাটি হয়ে গেল!
— হ্যাঁ, তা গেল। কিন্তু আপনি স্যর... হঠাৎ এখানে?
বাংলা স্যর একটু থমকালেন যেন, ‘কোয়ার্টারে নিজের ঘরে বসে পড়াশুনা করছিলাম। হঠাৎ কানে এল বিভৎস এক খিকখিকে হাসি। তার পরেই ধুপ করে কিছু একটা পড়ার শব্দ। ভাবলাম দেখি তো ব্যাপারটা কী। তা এসে দেখি তুই পড়ে আছিস!’
— পাঁচিলের উপর পা ঝুলিয়ে বসে ছিল স্যর। বাপরে, কী লম্বা পা! তার উপর হঠাৎ ওই রকম একটা পৈশাচিক হাসি! গলা ভারী হয়ে উঠল মৃগাঙ্কের, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না স্যর। পটকে গেলাম!
— অগত্যা কী আর করা। রাত অনেক হয়েছে, চল তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি।
মৃগাঙ্ককে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে অপূর্ববাবু ফিরে যাচ্ছেন। গেট বন্ধ করে স্যরের গমনপথের দিকে তাকাতে গিয়ে মৃগাঙ্ক চোখ দুটো হঠাৎ তেরছা হয়ে গেল। এতক্ষণ ঘোরের মধ্যে থাকায় ব্যাপারটা ঠিক নজরে আসেনি। কিন্তু ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় পরিষ্কার সে দেখল স্যরের ফুলপ্যান্টের নীচ থেকে সাদা মতন কিছু একটা বেরিয়ে আছে। তবে কি স্যর প্যান্টের নীচে পাজামা পরেছেন? সাদা পাজামা! কিন্তু বাস্তুভূতটাও যে...! তার মানে স্যরই কি...! অন্ধকারের আড়ালে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন বাংলা স্যর। মৃগাঙ্ক হতবাক। অপূর্ববাবু আদ্ভুত আচরণের মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে সে তাকিয়ে রইল।
নির্দিষ্ট দিনে বাংলা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতে পেয়েই চমকে উঠল মৃগাঙ্ক। তিনটে রচনার মধ্যে একটা রচনা মোটামুটি কমনই বলা চলে। সামান্য চেষ্টাতেই দু’তিন পাতা সে লিখে ফেলতে পারবে। রচনার নাম, তোমার দেখা বা শোনা একটি সত্যিকার ভৌতিক ঘটনা!