চেনা গল্প অচেনা মোচড়

আজ কপাল পুড়ল: লালকমল নীলকমল-এর

কেলোটা করেছিল লালকমলই। ঘুমোতে যাওয়ার আগে নীলকমল পইপই করে বলে দিয়েছিল, চামারপাড়ার খোক্কস ওর দলবল নিয়ে ঝামেলা করতে এলে লাল যেন বেশি কথা না বলে। ‘দাদা বাড়ি আছে কিন্তু’ বললেই ওরা পালাবার পথ পাবে না। এলাকার দলিত নেতারা কেউই গায়ে পড়ে দাদাকে ঘাঁটায় না।

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৪ ০৪:০০
Share:

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী

কেলোটা করেছিল লালকমলই। ঘুমোতে যাওয়ার আগে নীলকমল পইপই করে বলে দিয়েছিল, চামারপাড়ার খোক্কস ওর দলবল নিয়ে ঝামেলা করতে এলে লাল যেন বেশি কথা না বলে। ‘দাদা বাড়ি আছে কিন্তু’ বললেই ওরা পালাবার পথ পাবে না। এলাকার দলিত নেতারা কেউই গায়ে পড়ে দাদাকে ঘাঁটায় না। সেই যে বার ভোটের মাস দেড়েক আগে রাক্ষস-মহল্লাটায় আগুন লাগল ৩২ জন পুড়ে মরল ডি এম, এস পি, ডি জি সব্বাই সব কিছু জানল কত বক্তৃতা, তড়পানি, দলিতদের জন্য চোখের জল কিন্তু দাদার গায়ে একটুও আঁচ লাগল? বরং বিধানসভার ভোটে ওই সোনারিগাঁও থেকেই বিরাট মার্জিনে জিতে বেরিয়ে গেলেন তাদের বাবা রাজা ব্রিজকমল সিং, দশ গাঁয়ের লোক যাঁকে রাজাঠাকুর বলে কপালে হাত ছোঁয়ায়। সিএম-সাব নিজে ফোন করে শাবাশি দিয়েছিলেন। কী বিরাট পার্টি হয়েছিল তাদের প্রাসাদে! কত রকমের মদ, কত সুন্দর-সুন্দর মেয়েমানুষ! ওখানেই তো ভাওয়ানপুরের রাজার মেয়ে লীলাবতী রাজকন্যেকে প্রথম দেখেছিল লালকমল।

Advertisement

এখন সেই ভাওয়ানপুরেই রাজার গেস্ট হাউসে থানা গেড়ে বসে আছে তারা দু’ভাই। লীলাবতীর বাবা রাজা ভানুপ্রতাপ এ বার লোকসভায় দাঁড়িয়েছেন, রাজাঠাকুরের পার্টির টিকিটেই! কিন্তু ওখানে খোক্কস পাসওয়ান আর তার দলবলের ভারী উৎপাত। সিটটা রিজার্ভড না হলেও, দলিত ভোট বড় ফ্যাক্টর। খোক্কস সেই দলিতদের মসিহা হওয়ার চেষ্টায় নেমেছে। তাকে হয় দলে টানতে হবে, নইলে খতম করে দিতে হবে। সেই অ্যাসাইনমেন্ট নিয়েই নীল-লাল এখানে এসেছে। তা ছাড়া ভাওয়ানপুরের রাজা এমপি হওয়ার পরেই লীলাবতীর সঙ্গে এক জন রাজপুত্রের বিয়ে হবে, সেটাও ঠিক হয়েই আছে। এলাকার এমপি আর এমএলএ বেয়াই হবেন। কিন্তু লীলাবতীর ওপর তো নীল-দাদার চেয়ে লালের হক বেশি। পার্টিতে লীলাবতী লালকমলের দিকে তাকিয়েই মিষ্টি হেসেছিল। ওই কেলো-গুঁফো-গোঁয়ারগোবিন্দ নীলকমলের দিকে তাকিয়ে নয়। লাল তাই একলাই খোক্কসদের মোকাবিলা করতে চেয়েছিল। নীলের শেখানো বুলি না বলে নিজের বুদ্ধিতেই ডিলটা করে ফেলতে চেয়েছিল। আর তাতেই ঝামেলা।

খোক্কস গেস্ট হাউসের বারান্দায় উঠে চেয়ারে বসতে গিয়েছিল। লাল একটা খিস্তি দিয়ে বলেছিল চামারের বাচ্চা, বাপের চেয়ার পেয়েছিস? খোক্কসও পাল্টা বাপ তুলেছিল। বলেছিল, ‘তুই তোর কোন বাপের বাচ্চা আগে তার প্রমাণ দেখা। তোদের রাজবাড়ির কেচ্ছা জানতে আমাদের কিছু বাকি আছে নাকি?’ ব্যস, লালকমলের মাথায় আগুন জ্বলে গেল। ঠাটিয়ে খোক্কসকে একটা থাপ্পড় কষাল। সঙ্গে সঙ্গে খোক্কসের লোকজন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভাগ্যিস গোলমাল শুনে দাদার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল! দাদা এসেই বন্দুকের কুঁদো দিয়ে সব ক’টাকে পেটাতে শুরু করে। লোকগুলো ঘাবড়ে গিয়ে সরে যায়। খোক্কসের বুকে রাইফেলের নল ঠেকিয়ে দাদা ওকে ঠেলতে ঠেলতে বারান্দা পার করিয়ে দিয়েছিল। দাদাকে তখন শত্রুঘ্ন সিনহার মতো লাগছিল লালকমলের।

Advertisement

কিন্তু এই যে দাদা তাকে সব সময় আগলে আগলে রাখে এটা করিস না, ওটা আমি দেখে নিচ্ছি এ সব বলে বলে আসলে তাকে কিছুই করতে দেয় না, এটাই সহ্য হয় না লালের। ও কি সত্যিই লালকে ভালবাসে, না সবটাই ভান? আমি কিন্তু তোকে ঘেন্না করি নীলকমল। হিংসা করি তোকে। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে তোর এই হিরোপনা আমি আর নিতে পারছি না। আমি তোকে বিশ্বাস করি না। তোকেও না, তোর ওই রাক্ষুসি মা’কেও না। লাল একা-একা নিঃশ্বাস ফেলে। ও জানে না, কী করে এক মুন্ডা-নারী এক বাচ্চাকে কোলে নিয়ে রাজা ব্রিজকমল সিংহের প্রাসাদে এসে উঠেছিল। ও জানে না, কবে কোন শিকার খেলতে গিয়ে রাজাঠাকুর ওই মেয়েকে বিয়ে করে তার গর্ভে ক্ষত্রিয় রাজবংশের বীজ বুনে এসেছিলেন। বড়মা যখন আড়াই বছরের নীলকমলকে নিয়ে সোনারিগাঁওয়ে আসে, লাল তখন মায়ের পেটে। মায়ের খাস দাসী কমলা মাসি বলেছে, বড়মা জাদু-টোনা জানত। ওরা সব মুন্ডা রাক্ষস-রাক্ষসী, কত মন্ত্র-টন্ত্র জানে! মা’কে তো এমন ওষুধ খাওয়াল যে লালকমলের জন্ম দিয়ে মা মরে গেল। আর বড়মা শুধু বাবাকে নয়, গোটা রাজবাড়িটাকেই বশ করে ফেলল। এই যে এমএলএ হওয়ার পর রাজাঠাকুরের সেরিব্রাল স্ট্রোক হল, তার পর থেকে তো বাবার বিধানসভা এলাকাটাও বড়মা আর নীল দেখাশোনা করছে।

হ্যাঁ, বড়মা লালকে ভীষণ যত্ন করে সেই ছোটবেলা থেকেই। নীলের চেয়ে বেশিই করে। তবু মাঝরাত্তিরে অনেক সময় লালের ঘুম ভেঙে যায়। মনে হয় এই বুঝি বাবার রাক্ষসী রানি তাকে খেতে এল। বড়মার দেওয়া দুধের গেলাসে, ক্ষীরের বাটিতে চুমুক দিতে ভয় করে। মনে হয় বিষ মেশানো আছে, খেলেই মুখে ফেনা তুলে মরে যাবে। এমনি করে কি বাঁচা যায়? লীলাবতীর মনও কি শেষে নীলকমলই দখল করে নেবে? কক্ষনও না। লালকমলের শরীরে বনেদি ক্ষত্রিয় রাজরক্ত বইছে, নীলের মতো তাতে ভেজাল নেই। লাল জানত ‘অপারেশন খোক্কস’-এর অ্যাকশনে নীল তাকে নিতে চাইবে না, তাই সে খানিকটা জেদ করেই এসেছে। কোত্থেকে কোত্থেকে যুদ্ধবীর সেনাদের দলগুলো জোগাড় করেছে দাদা। দলিত চামারগুলো ঠেকাতেই পারল না। ঘরে ঘরে আগুন, দলিত মেয়েগুলোকে চুলের মুঠি ধরে ধরে ঝোপের ও-পাশে নিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধবীর সেনারা। খোক্কসকে নিজের হাতে গুলি করে মেরেছে নীলকমল। এখন জিপে বসে গোঁফে তা দিচ্ছে। জংলি ভূতটা নিজের আনন্দে মশগুল থাক। বন্দুক তাক করে লাল। এই বার, এই বার ট্রিগারটা টিপলেই...

ধড়াম করে গুলির আওয়াজ। ঘোড়ার ওপর থেকে ঘুরে পড়ল লালকমল। বুলেটটা তার মগজ ফুঁড়ে চলে গেল। নীল ফিরেও তাকায় না। যুদ্ধবীর সেনার লোকটা পাঁচিলের ওপর থেকে নেমে নীলকমলের জিপটার দিকে এগিয়ে যায়। বকশিশ নিতে হবে তো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন