আমার প্রথম প্রকাশিত বই একটি উপন্যাস। নাম: ‘টুই টুই’। একটি পাখির ডাক। উচ্চারিত নামের ছন্দিত ধ্বনি নিশ্চয়ই প্রমাণ করে বইটি ছোটদের মনোরঞ্জনের জন্য রচিত। আমি আদ্যন্ত ছোটদের সাহিত্যের সঙ্গী। এই অনুপম সাহিত্যের রহস্য সন্ধানে জীবনের সিংহভাগটাই আমার কেটে গেল। ফলে, সুখস্পর্শী অভিজ্ঞতা যেমন সঞ্চয় করেছি, তেমনই উপলব্ধি করেছি, ছোটদের সাহিত্য সৃজন সহজসাধ্য কাজ নয়। গভীর অনুশীলন-নির্ভর। দুঃখের হলেও এ কথা মানতেই হয়, অনুশীলনের উদ্যমটা আমাদের ধাতে নেই। কলম ধরি, আর লিখি। ভাবি না, কী লিখি, কেন লিখি। ভাবি না, আমার খুদে পাঠকের সুষ্ঠু জীবন গড়ে ওঠার সহায়তায় আমার সাহিত্য পারল কি কোনও প্রভাব ফেলতে? না কি সাহিত্যের উত্তেজক ঘটনার স্রোতে ভাসতে ভাসতে সে হারিয়ে বসল নিজের পেলব মনটিকে!
আমার ‘টুই টুই’ উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার আগে ধারাবাহিক ভাবে ‘আনন্দ-মেলা’য় প্রকাশিত হয়। অবশ্যই আজকের এই ছিমছাম চেহারার ‘আনন্দমেলা’য় নয়। আনন্দবাজার পত্রিকার এই বিভাগটি, সাহিত্যের মাধ্যমে ছোটদের আনন্দ দানের জন্য পরিকল্পিত হয়েছিল, আজ থেকে ৭৪ বছর আগে। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতি সোমবার শেষ পৃষ্ঠায় এই বিভাগটি প্রকাশিত হত। বিভাগটি পরিচালনা করতেন ‘মৌমাছি’ ছদ্মনামে সে সময়ের এক প্রখ্যাত শিল্পী এবং শিশুসাহিত্যিক প্রয়াত বিমল ঘোষ। ছোটদের হৃদয়গ্রাহী সাহিত্যের নানান আকর্ষণে সমৃদ্ধ এই বিভাগটি সেই সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তখন কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকার দফতর আজকের মতো প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে ছিল না, ছিল বড়বাজার অঞ্চলের বর্মন স্ট্রিটের একটি পুরনো বাড়িতে। সে বাড়ির না ছিল ঝকঝকে দৃষ্টিনন্দন রূপ, না চার পাশের পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। কিন্তু সুনামের আভিজাত্যে আনন্দবাজার তখনও উজ্জ্বল।
যত দূর মনে পড়ে পুরনো বাড়িটি ছিল তিনতলা। বাড়ির নীচের তলায় ছিল প্রেস, দোতলায় ছিল সম্পাদকীয় বিভাগ-সহ অন্যান্য কয়েকটি বিভাগ। আর একেবারে ওপরতলায় ছিল একটি বেশ বড় ঘর। ঘরটি চটের পার্টিশান দিয়ে দু’ভাগ করা। এক দিকে ‘আনন্দ-মেলা’, অন্য দিকে ‘রবিবাসরীয়’ বিভাগ। দুটি বিভাগের জন্য ধার্য ছিল একটি টেলিফোন। তখন ‘রবিবাসরীয়’ সম্পাদনা করতেন প্রয়াত মন্মথ সান্যাল।
আমি তখন স্কুলের ছাত্র। থাকি গঙ্গার পশ্চিম পারে হাওড়ার সালকিয়ায়। সেই ছাত্রবয়সে আমার যে কী প্রচণ্ড টান ছিল ‘আনন্দ-মেলা’র প্রতি, তা আজ আর বোঝাতে পারব না। তখন স্কুল ম্যাগাজিনে দু’এক কলম লেখার সুযোগ পেয়েছি। এমনকী, সে কালের ছোটদের বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা ‘মাসপয়লা’য় একটি কবিতাও লিখে ফেলেছি। সুতরাং, এ বার আমার মন ‘আনন্দ-মেলা’য় নিজের নামটি ছাপার অক্ষরে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। কষ্টেসৃষ্টে দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে একটি গল্প লিখে ফেলি। নাম দিয়েছি ‘মা’। গল্পটা গল্প হল কি না, সেই ভাবনায় ভীষণ অস্থির হয়ে উঠি। কাউকে যে পড়ে শোনাব, সেই সাহসও হল না। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিই, ভাল-মন্দ যা-ই কপালে থাক, গল্পটি ‘আনন্দ-মেলা’য় দিয়ে আসি। ঘুণাক্ষরে কেউ না জানতে পারে।
না, কেউ জানতে পারেনি। এক দিন একা একা ছোট্ট পায়ে টুকটুক করে হেঁটে চলে এসেছি হাওড়ার সালকিয়া থেকে কলকাতার বড়বাজারে। আর কিছুটা হাঁটলেই চিৎপুরের মোড়। মোড় থেকে বাঁ-দিকে দু’পা হাঁটলেই ডান দিকে পড়বে বর্মন স্ট্রিট। দু’পাশে দোকান-বাজার। মাঝখানে গলি। গলির ভেতর একটু ঢুকতেই নাকে ঢুকল গলানো সিসের গন্ধ। তৈরি হচ্ছে লাইনো-টাইপ। ছাপা হবে সংবাদ। তখন ছাপার সম্বল ছিল লাইনো-টাইপ, আর রোটারি মেশিন।
ওই সিসের গন্ধেই খুঁজে পেয়েছি আনন্দবাজার পত্রিকার অফিস। ঢুকেও পড়েছি গেট দিয়ে। কোথায় ‘আনন্দ-মেলা’, কোথায় মৌমাছি, কিছুই জানা নেই। ত্রস্ত পায়ে এ দিকে ও দিক করছি আর ভাবছি, কাকে জিজ্ঞেস করব! ভয় করছে। যদি তাড়া খাই! অগত্যা উঠোনেই ঘুরপাক খাই। হঠাৎ এক জন বয়স্ক মানুষ আমাকে অমন ছটফট করে ঘুরপাক খেতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। বেশ ধোপদুরস্ত পোশাক তাঁর পরনে। এগিয়ে এলেন আমার কাছে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকে খুঁজছ খোকা?’ হাতের খামটা দেখিয়ে বলি, আমি ‘আনন্দ-মেলা’য় এই লেখাটা দেব বলে মৌমাছিকে খুঁজছি। তিনি উত্তর দিলেন, মৌমাছি বোধ হয় এখনও আসেননি। আনন্দ-মেলার অফিস তিনতলায়। তুমি ছেলেমানুষ। কষ্ট করে তিনতলায় ওঠার দরকার নেই। তার পর নীচের তলায় দেওয়ালে আঁটা একটা ঢাপ্পুস চিঠি ফেলার বাক্স দেখিয়ে বললেন, খামটা ওই বাক্সে ফেলে দাও! মৌমাছির হাতে পৌঁছে যাবে। খামে নামটা ঠিকঠাক লেখা আছে তো? আমি ঘাড় নাড়ি। খামটা তাঁকে দেখিয়ে বাক্সে ফেলে দিই। বাক্সে আমার খাম ফেলার দৃশ্যটা তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে দেখলেন। তার পর জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে আসছ? আমার ঠিকানা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বলো কী, অত দূর থেকে একা একা এসেছ?’ আমি কোনও উত্তর দিতে পারি না। তিনি ব্যস্ত হয়ে বলেন, যাও যাও, এখনই বাড়ি ফিরে যাও! নিশ্চয়ই ভাবছেন সবাই! পরে জানতে পারি, সে দিন যিনি আমার লেখাটি চিঠির বাক্সে ফেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তিনি অন্য আর কেউ নন, আনন্দবাজার পত্রিকার অন্যতম প্রাণপুরুষ প্রয়াত সুরেশচন্দ্র মজুমদার।
আমার তখন বছর তেরো বয়স। ক্লাস এইট-এ পড়ি। ওই বয়সে অভাবনীয় ভাবে আমার জীবনে ঘটে গেল এক বিস্ময়কর ঘটনা। দেখি, আমার ‘মা’ গল্পটি পরের সপ্তাহেই ‘আনন্দ-মেলা’য় প্রকাশিত হয়েছে। শিহরন-জাগানো আনন্দে আপ্লুত হয়ে আমি আমার ছাপা গল্পটি জনে জনে দেখাই। স্কুলে ছুটি। মাস্টারমশাইদের দেখাই। প্রণাম করি। এই শুরু হল আমার যথার্থ সাহিত্য জীবনের।
দ্বিগুণ উৎসাহে কয়েক দিনের মধ্যে আমি আর একটি গল্প লিখে ফেলি। আগের মতোই কাউকে কিছু না বলে আবার ছুটি আনন্দবাজারে। সেই ঢাপ্পুস চিঠির বাক্সে ফেলে আসি গল্পটি। এ বার কিন্তু আগের গল্পটির মতো ঠিক পরের সপ্তাহেই লেখাটি প্রকাশিত হল না। মুষড়ে পড়ল মন। এই রক্ষে, আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে কাউকে বলে ফেলিনি যে, আর একটি গল্প পাঠিয়েছি। কিন্তু আরও দু’সপ্তাহ পরে গল্পটি যখন সত্যিই ছাপার অক্ষরে ‘আনন্দ-মেলা’য় দেখি, বিশ্বাস করতে পারি না নিজের চোখকে। বাঁধভাঙা আনন্দে আত্মহারা হয়ে এখন আমি বিশ্বাস করতে পারছি, আমি তা হলে পারি।
হ্যাঁ, বাস্তব এই, আমি পেরেছি। সোমবারের ‘আনন্দ-মেলা’র পাতায় তখন আমার গল্প প্রকাশিত হতে থাকল নিয়মিত। প্রসঙ্গত এটাও আমাদের জেনে রাখা ভাল, এখন যেমন প্রতি বছর পুজো উপলক্ষে ‘এবিপি’র তত্ত্বাবধানে প্রায় ছ-সাতটি পূজাবার্ষিক সংখ্যা প্রকাশিত হয়, তখন এমনটা ছিল না। প্রতি বছর বই আকারে আনন্দবাজার পত্রিকার দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হত। একটি ‘দোল’ উপলক্ষে, অন্যটি ‘পূজা-বার্ষিক’। মুদ্রিত হত একটিমাত্র উপন্যাস। দুটি সংখ্যাতেই ‘আনন্দ-মেলা’র জন্য কয়েকটি পৃষ্ঠা নির্দিষ্ট করা থাকত। আমি এই দুটি সংখ্যাতেই গল্প লেখার সুযোগ পেয়েছি। হঠাৎই এক দিন মৌমাছি আমাকে সোমবারের ‘আনন্দ-মেলা’র জন্য একটি ধারাবাহিক রূপকথাধর্মী উপন্যাস লেখার আহ্বান জানান। আমি ‘টুই টুই’ উপন্যাসটি লিখি। সেটি ষাটের দশকের একেবারে গোড়ার কথা।
উপন্যাসটি প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। এটি প্রকাশ করে অধুনালুপ্ত ‘প্রগতি প্রকাশনী’। প্রকাশনীটি ছিল কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ার অঞ্চলে। অনিবার্য কারণে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে প্রগতি প্রকাশনী থেকে বিদায় নিয়ে ‘টুই টুই’ পৌঁছে গেল কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে ‘ডেল্টা ফার্মা’ নামের আর একটি প্রকাশনা সংস্থায়। ছোটদের বইয়ের প্রখ্যাত অলংকরণ শিল্পী প্রয়াত বিমল দাস ‘টুই টুই’-এর প্রচ্ছদ এবং চিত্র-শোভনে বইটিকে বিশেষ আকর্ষণীয় করে তোলেন। শেষোক্ত প্রকাশনা থেকে ‘টুই টুই’ নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ার পরেও আর আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে ‘টুই টুই’ পারুল প্রকাশনীর সৌজন্যে প্রকাশিত আমার উপন্যাসসমগ্রের প্রথম খণ্ডে প্রথম উপন্যাসের মর্যাদায় আসীন।
সব শেষে বলি, এই উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে একটি পাখি, দুটি ভাই-বোন এবং নৃশংস এক রাজাকে কেন্দ্র করে। একদা যে রাজা ছিলেন আনন্দে মুখর, হাসিখুশি, সেই রাজা অকস্মাৎ কেন হলেন নৃশংস, এবং পরিশেষে কেমন করে দুটি নিষ্পাপ শিশুর অকুণ্ঠ ভালবাসায় রাজা আবার ফিরে পেলেন তাঁর আনন্দময় জীবন, এই মুখ্য বিষয়টিই গল্পের বুননে প্রতিফলিত।
ষাটের দশকে আনন্দ পাবলিশার্সের সৌজন্যে আমার আরও দুটি বই প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সালে ‘অরুণ-বরুণ-কিরণমালা’, এবং ১৯৬৮ সালে ‘মিতুল নামে পুতুলটি’। কিন্তু ‘টুই টুই’ই আমার প্রথম সাহিত্য জীবনের পরম সঙ্গী।