জিম করবেট

ইনি on উনি

জিম করবেট কাজ করেছিলেন মানুষখেকো বাঘ নিয়ে। আর আমি কাজ করেছি মানুষ মারা হাতি নিয়ে। কাজেই সূক্ষ্ম একটা যোগাযোগ তো থাকবেই। কিন্তু শিকারের এই দেবপ্রতিম ব্যক্তিটিকে, চাক্ষুষ করিনি কখনও। করবই বা কী ভাবে? ওঁর শিকারজীবন ১৯০৭ থেকে ১৯৩৮ সালের মাঝামাঝি। বেঙ্গল অ্যান্ড নর্থ ওয়েস্টার্ন রেলওয়েতে চাকরি করতেন তিনি। করবেট দেশ ছেড়ে যান স্বাধীনতার পরেপরেই। সেই সময়ে আমি ছাত্র। করবেটের সঙ্গে আমার পরিচয় তাঁর লেখা বইয়ের সূত্রে।

Advertisement

ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

জিম করবেট কাজ করেছিলেন মানুষখেকো বাঘ নিয়ে। আর আমি কাজ করেছি মানুষ মারা হাতি নিয়ে। কাজেই সূক্ষ্ম একটা যোগাযোগ তো থাকবেই। কিন্তু শিকারের এই দেবপ্রতিম ব্যক্তিটিকে, চাক্ষুষ করিনি কখনও। করবই বা কী ভাবে? ওঁর শিকারজীবন ১৯০৭ থেকে ১৯৩৮ সালের মাঝামাঝি। বেঙ্গল অ্যান্ড নর্থ ওয়েস্টার্ন রেলওয়েতে চাকরি করতেন তিনি। করবেট দেশ ছেড়ে যান স্বাধীনতার পরেপরেই। সেই সময়ে আমি ছাত্র। করবেটের সঙ্গে আমার পরিচয় তাঁর লেখা বইয়ের সূত্রে। ‘ম্যান-ইটার্স অব কুমায়ুন’ বইটা প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯৪৪ সালে। তার বছর দুই বাদে আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হই। চল্লিশের শেষাশেষি বা পঞ্চাশের প্রথম দিকে আমি করবেটের বই পড়ি। ইংরেজিতেই। বইটা আমাকে উপহার দিয়েছিলেন আমার মামা, অজয় শঙ্কর ভাদুড়ি। এখন আর ইহজগতে নেই। তাঁর এমন সব বইয়ের খুব শখ ছিল। তবে, প্রকাশের পর খুব জনপ্রিয় হয়েছিল করবেটের বইগুলো। তখন মানুষ পড়তও তো খুব। প্রেসিডেন্সি কলেজের রেলিঙে পুরনো দুষ্প্রাপ্য বইও প্রচুর বিক্রি হত। তাই, বই বা লেখক নিয়ে উন্মাদনাও ছিল অন্য রকমের।

Advertisement

অনেকটা করবেটের মতোই, জঙ্গল, পশুপাখির প্রতি টান আমার অনেক ছোটবেলা থেকে। হাতির সঙ্গে চেনাজানার শুরু তো সেই তিন বছর বয়স থেকে। পশ্চিমবঙ্গ বনবিভাগের যাত্রাপ্রসাদ ছিল আমার বিশেষ বন্ধু। আর ছিল ময়মনসিংহ দেশের শেরবাহাদুর, শক্তিপ্রসাদ। আমাদের সেই ময়মনসিংহের বাড়িটা ছিল শিকারেরই বাড়ি। আমাদের চার পুরুষ শিকারি। করবেট তো পায়ে হেঁটে শিকারে যেতেন, আমাদের কিন্তু শিকার করতে হত হাতির পিঠে চেপে। আমাদের ২৭টা শিকারি হাতি ছিল। শিকারের বিরাট বিরাট পার্টি হত। হাতি ‘খেদা’ হত। হাতি ধরা হলে হাতি কেনাও হত। সেই আগুনের তেজ রক্তে তো বইতই, তার উপরে জুটল জিম করবেটের গপ্পের প্রভাব। ফলে বছর আট নাগাদ আমি একটা পাগলা কুকুর শিকার করে ফেললাম। আমাদের বাড়ির পুকুরের পাশেই। পয়েন্ট টু টু বোর রাইফেল দিয়ে। একদম গুড়ুম! সেই ছিল শুরু।

ময়মনসিংহের সেই ছেলেবয়সে, আমি বাচ্চা করবেটই ছিলাম বলা চলে। প্রথম ‘বিগ গেম’ও ওই আট-দশ বছর বয়স নাগাদ। করবেট মারতেন লেপার্ড, আমি মেরেছিলাম লেপার্ড ক্যাট। মেছো বেড়াল। তার চামড়া নিয়ে আসি কলকাতায়। ধর্মতলায় সেটা ট্যান করিয়ে দেন আমার দাদামশাই।

Advertisement

তার পর কর্মজীবন। জিম করবেট যে ভাবে আশ্চর্য শান্ত, নিশ্চুপ ভাবে, ঠান্ডা মাথায় বাঘের পিছনে পায়ে হেঁটে যেতেন, তেমনি আমিও ঘুরতাম হাতির পিছনে। যে কোনও বন্য শ্বাপদ যে ভাবে চলে জানেন তো? চুপিচুপি, নিঃসাড়ে। এতটুকুও শব্দ হবে না। হাতির ক্ষেত্রে এই চলাটা আরও আশ্চর্যের বিষয়। অত বড় একটা চেহারা, এমনিতে ডালপালা ভেঙে চলার আওয়াজ পাওয়া যায় সারা ক্ষণ, কিন্তু ইচ্ছে করলে একটা মেঘের মতো জঙ্গলের মধ্যে নিঃশব্দে ভেসে চলে যায়। এটা আমার অভিজ্ঞতা, জলদাপাড়ার উত্তরে মাদারিহাট জঙ্গলের টুরিস্ট লজের পাশে। গজেন্দ্রগমনে চলেছে খাল-বিল-জঙ্গল পেরিয়ে, অথচ নিজের অস্তিত্ব জানতেই দেবে না কাউকে। শিকার করতে গেলে, শিকারিকেও ঠিক ওরকমই শব্দহীন হতে হয়। একই রকম ধূর্ত হতে হয়। করবেট সেই কৌশল জানতেন। আমার অভিজ্ঞতাও তাই। একটা হাতি শুয়ে ঘুমোচ্ছিল এক বার। গুন্ডা হাতি, মানুষ মেরেছে। আস্তে আস্তে, শুকনো পাতা বাঁচিয়ে, শব্দ না করে, পিছন থেকে গিয়ে গুলি চালিয়ে দিই আমি। খতম।

বন্য প্রাণীদের এমন আচরণই করবেটের শিকার করা রুদ্রপ্রয়াগের লেপার্ডটার বিখ্যাত কিংবদন্তিটির জন্ম দিয়েছিল। লেপার্ডটা তো বছরের পর বছর ঘুরিয়ে মেরেছিল জিম সাহেবকে। গ্রামবাসীরা মনে করত, সে সত্যিকারের কোনও পশু না, আত্মা। আসল কারণ অন্য। লেপার্ডদের ক্ষিপ্রতা, গতিবেগ বিদ্যুৎ ঝলকের মতো। ওরা গাছে পর্যন্ত উঠে পড়ে। এই মুহূর্তে এখানে ছিল, পলকে অদৃশ্য। তেমনি চতুর। ফলে সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের বুদ্ধিতে তাকে অশরীরী বলে মনে হতেই পারে।

তাঁর বইয়ের ভূমিকায় জিম যে কথাগুলো লিখেছেন, জীবন দিয়ে তার সত্যতা উপলব্ধি করেছি আমি। স্বাভাবিক নিয়ম মেনে চললে, পশু আসলে মানুষকে ভয়ই পায়। কোনও ভাবে মানুষ ওদের জীবন বিপন্ন করে তুললে, তবে মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা। কিংবা হয়তো আহত, বয়স হয়েছে, দাঁত পড়ে গেছে, তখন মানুষের বসতির ওপর আক্রমণ করে। করবেট তো বলেইছেন, জন্মেই মানুষখেকো হয় না বাঘ। পরিস্থিতি তাকে মানুষ মারতে বাধ্য করে। তির লেগেছে, ঘা হয়ে গেছে, পা ভেঙে গেছে, তখন নিজের জীবন বাঁচাতেই মানুষের ঘাড় মটকায়। আর লেপার্ড থাকেই তো গ্রাম, জনবসতির ধারেকাছে। গভীর জঙ্গলেও থাকে, তবে বেরিয়ে আসে অনেক সময়ই। হয়তো তখন খেত-খামারে কাজ করছে বড়রা, মাঠে গরু চরাচ্ছে বাচ্চা ছেলে। তাকেই তুলে নিয়ে চলে গেছে লেপার্ড। আমার শ্বশুরবাড়িতেও এক বার অনেক অনেক দিন আগে, ঠিক অমন করে এক বেচারা কুকুরকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এক লেপার্ড। পার্বতী বড়ুয়ার বাবা এ রকম লেপার্ড দূরে সরিয়ে রাখার জন্য হাতি ভাড়া দিতেন। এ রকম আরও অনেক শিকারের গল্প শুনেছি লালজির কাছে। লালজি এই বিদ্যায় আমার গুরু। প্রমথেশ বড়ুয়ার ভাই প্রকৃতীশচন্দ্র বড়ুয়া।

আমার কর্মজীবনে করবেটের শিকারভূমিতে বিভিন্ন সময় যেতে হয়েছে। অদ্ভুত অনুভূতি সে সব। মনে পড়ে, এক বার কুমায়ুন ফরেস্ট সার্ভে করছি। একটা বাংলোয় গিয়েছিলাম। শুনলাম, সেখানে এলে করবেট বিনা পয়সায় থাকতে পারতেন। কারণ তিনি তো অতিথি। কোনও খতরনাক বাঘ মারতে ডেকে আনা হয়েছে তাঁকে। নৈনিতাল থেকে বাঁ দিকে যেতে পড়ে কালাধুঙ্গি। প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। সেটা ওঁর দ্বিতীয় বাড়ি ছিল। সেটা দেখেছি, পাহাড়ের ওপর থেকে।

প্রথম দিকে একটা বক্স ক্যামেরা ছিল আমার। জিমের মতো আমিও ছবি তুলতাম অনেক। আর হাতি মারতাম ফোরসেভেন্টি ম্যানটন দিয়ে। তবে এক বার, করবেটের মতো, বাঘ মেরেছিলাম। তখন পালামৌর জঙ্গলে। লোকজন হাঁউমাউ করে জানাল, এক শের, বকরি খা লিয়া। তার পর আর কী? রাস্তা পেরোচ্ছিলেন তিনি। বন্দুক তাক করে শেষ করতে হল তাঁকে। থ্রিহান্ড্রেড রাইফেল ছিল সে দিন আমার হাতে। আর বাঘটা? সে এখন আমার বাড়ির দেওয়ালে!

সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন