ইরাক ২০১০

ইরাকে এখন সাংঘাতিক অশান্তি। চার বছর আগে ইরাকে ছ’মাস থাকার অভিজ্ঞতা কিছুটা আন্দাজ দেবে, যুদ্ধ মানুষকে নিয়ে কেমন ডাংগুলি খেলে।পর পর তিনটে প্লেন পালটে এসে নেমেছি। এয়ারপোর্ট থেকে আসবার সময় দেখে নিয়েছি পারদ চড়েছে ৫৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। বেশ খানিকটা অপেক্ষার পর ‘এন্ট্রি অফিস’-এ ডাক পড়ল। চার দিক থেকে ছবি তোলার পর এল আঙুলের ছাপ নেওয়ার পালা। শুধু বুড়ো আঙুলের টিপছাপ নয়, বুড়ো-বুড়ি ছেলে-মেয়ে সব আঙুলের ছাপ চাই। পাথুরে-মুখ আমেরিকান সৈন্যটির আমার হাতের জোরের ওপর বিশেষ ভরসা নেই, সে আমার হাত ধরে স্ক্যানারের ওপর চেপে চেপে সব ছাপ দেওয়াল।

Advertisement

সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৪ ০০:০৫
Share:

পর পর তিনটে প্লেন পালটে এসে নেমেছি। এয়ারপোর্ট থেকে আসবার সময় দেখে নিয়েছি পারদ চড়েছে ৫৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। বেশ খানিকটা অপেক্ষার পর ‘এন্ট্রি অফিস’-এ ডাক পড়ল। চার দিক থেকে ছবি তোলার পর এল আঙুলের ছাপ নেওয়ার পালা। শুধু বুড়ো আঙুলের টিপছাপ নয়, বুড়ো-বুড়ি ছেলে-মেয়ে সব আঙুলের ছাপ চাই। পাথুরে-মুখ আমেরিকান সৈন্যটির আমার হাতের জোরের ওপর বিশেষ ভরসা নেই, সে আমার হাত ধরে স্ক্যানারের ওপর চেপে চেপে সব ছাপ দেওয়াল। আর বিরক্তি চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেললাম, ‘তোমাদের এত আঙুলের ছাপের দরকার কেন?’ উত্তর শুনে আমিই পাথর হয়ে গেলাম। ‘যদি তুমি মাইন-এ পা দিয়ে টুকরো হয়ে যাও, তা হলে আমরা আঙুলের একটা কণা পেলেও তোমাকে শনাক্ত করতে পারব। ওয়েলকাম টু ইরাক।’

Advertisement

আমি সৈন্য নই। আমার বংশে কেউ কোনও দিন বন্দুক হাতে করেনি। কিন্তু আমাকে আসতে হয়েছে বসরা’তে, একটি তেল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। সময়টা ২০১০-এর জুন। সাদ্দামের ফাঁসি হয়ে গিয়েছে সাড়ে তিন বছর আগে। অফিসের বস যখন ডেকে বললেন, আমাকে ইরাক আসতে হবে, হয়তো আমার মুখের কিছু ভাবান্তর হয়েছিল, তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘ভাল অ্যালাওয়েন্স দেবে, আর ভয়ের কিছু নেই, আর্মি ক্যাম্পে থাকা। ওনলি সিক্স উইক্স।’ দুর্ভাগাদের যেমন হয়, ‘ওনলি সিক্স উইক্স’ দাঁড়িয়েছিল সিক্স মান্থস-এ।

মাঝখানে এক বার ইরাক থেকে ফেরার পথে প্লেনে আলাপ হল ডক্টর স্টিলের সঙ্গে। পেশায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, অনেক দিন কাজ করছেন ‘ট্রমা স্পেশালিস্ট’ হিসেবে। চোখের ওপর অপরিসীম রক্তপাত ও বীভৎসতা দেখতে দেখতে অনেকে হয়ে পড়েন মনোরোগের শিকার। ওঁর কাছেই শুনি তারিকের কথা। তারিক আলি ছিল নাজাফ কবরখানার সুপারভাইজার। দক্ষিণ ইরাকে এই সমাধিক্ষেত্র এখন প্রায় তিন মাইল জুড়ে। যুদ্ধের ফলে এর আয়তন বেড়েছে ৪০%-এর কিছু বেশি। এখন এটি বিশ্বের বৃহত্তম সমাধিক্ষেত্র। যুদ্ধ চলাকালীন, দিনে ১৫০-২০০ রক্তাক্ত দেহ এখানে সমাধিস্থ হত। হাসিখুশি তারিক এটা নিতে পারেনি। সে এখন সর্বত্র মৃতদেহ দেখে। তার পক্ষে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া এক রকম অসম্ভব। তবে সব ইরাকি নিশ্চয়ই এমন ট্রমা-র শিকার হন না। তিন দশক ধরে যুদ্ধ সয়ে অনেকেই বেশ ইনসেন্সিটিভ হয়ে গিয়েছেন। এ ছাড়া বোধ হয় বাঁচার আর কোনও রাস্তাও নেই। আমার এক ইরাকি সহকর্মী সঈদ বলল: তখন আমরা স্কুলে পড়ি, ক্লাস ফোর বা ফাইভ। দল বেঁধে ইস্কুলে চলেছি। হঠাৎ আওয়াজে বুঝলাম রকেট আসছে। এক রকম রিফ্লেক্সেই বলা যায় রাস্তার ধারে ঝোপে লুকিয়ে পড়লাম। রকেট এসে লাগল একটি চলমান বাসে। এক বাস লোক পুড়ে মরে যাচ্ছে, আর আমরা আমাদের মতো ইস্কুলে চলে গেলাম।

Advertisement

সেনাদের মধ্যে এক মহিলা ছিলেন, মিসেস হুইটসন। বয়স অন্তত পঞ্চাশ। নিঃসন্তান এই বিধবাও বন্দুক নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করেন। মুখে সব সময় একটা স্নেহ মাখানো হাসি। আলাপ করবার সুযোগ হতেই জানতে চাইলাম, কেন এই কাজে এসেছেন এই বয়সে? বললেন, মন্দার ফলে বোস্টন শহরে তাঁর বিশ বছরের সাধের চাকরিটি হারিয়েছেন। এ ছাড়া কোনও চাকরি পাননি। দুটো রুটির জন্য মহিলাকে গুলি ছুড়তে হয়, ভেবে মনটা ভারী হয়ে গিয়েছিল।

অফিসে বসে কাজ করছি। আর কয়েক দিন পরেই ফিরব। হঠাৎ চাপা আওয়াজের সঙ্গে মাটি কেঁপে উঠল। জানলা দিয়ে দেখি মিলিটারি সেন্ট্রাল স্টোরের ওপর আকাশ ঢেকে গেছে কালো ধোঁয়ায়। বিশাল একটা রকেট আক্রমণ হয়েছিল। বাস্টার ব্যবস্থা কাজ করেনি। পর দিন দেখলাম ১৩টা কফিন উঠছে ট্রাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকায় ঢাকা। সে রাতে খেতে পারিনি। মনে হল কে বিজিত আর কে বিজয়ী, তার থেকে অনেক বড় সত্য হল এই মৃত্যু।

পর দিন বিকেলে আকাশ ছেয়ে গেল লাল টুকরো টুকরো মেঘে। মনে হল জল নয়, এই মেঘ তৈরি হয়েছে রক্ত থেকে, সব রক্ত বাষ্প আকাশে মেঘ হয়ে আছে।

sumantrachat@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন