উপহার

পুপুল স্কুল থেকে ফিরে মুখ গম্ভীর করে বারান্দায় বসেছিল। পুপুলের মা বলল, ‘কী রে, কী হয়েছে!’ পুপুল কোনও উত্তর দিল না। আরও গম্ভীর হয়ে গেল। অনেক সাধ্যসাধনার পর যা জানা গেল, পুপুল আজ স্কুলে খুব ইনসালটেড হয়েছে বন্ধুদের কাছে। ‘বন্ধুরা আবার ইনসাল্ট করে নাকি?’ ‘ওরা করেনি, কিন্তু আমি হয়েছি।’ ‘সেটা আবার কী করে হয়?’

Advertisement

বিনতা রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

ছবি: সুমন চৌধুরী

পুপুল স্কুল থেকে ফিরে মুখ গম্ভীর করে বারান্দায় বসেছিল। পুপুলের মা বলল, ‘কী রে, কী হয়েছে!’

Advertisement

পুপুল কোনও উত্তর দিল না। আরও গম্ভীর হয়ে গেল।

অনেক সাধ্যসাধনার পর যা জানা গেল, পুপুল আজ স্কুলে খুব ইনসালটেড হয়েছে বন্ধুদের কাছে।

Advertisement

‘বন্ধুরা আবার ইনসাল্ট করে নাকি?’

‘ওরা করেনি, কিন্তু আমি হয়েছি।’

‘সেটা আবার কী করে হয়?’

‘হয়তো, আমি বলছি হয়। সামনেই ভাইফোঁটা। সবাই আলোচনা করছিল, কে কার বোন আর দিদিকে কী গিফ্ট দেবে। আমি বললাম, আমি আমার বোনকে গিফ্ট দেব, তবে কী দেব জানি না। মা যে গিফ্ট এনে দেবে, তা-ই দেব। ব্যস, সবার হাসি শুরু হয়ে গেল— সে কী রে, তোর গিফ্ট মা এনে দেবে, কেন নিজের গিফ্ট নিজের পয়সায় কিনতে হয় জানিস না?’

পুপুলের মা অবাক, ‘তুই এত ছোট, তুই কোথায় নিজের পয়সা পাবি?’

‘বা রে, ওরা তো আমারই বয়সি। ওরা যে জোগাড় করল। কেউ টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে, কেউ হাতখরচের টাকা জমিয়ে। কেউ আবার পুজোয় বড়দের থেকে উপহার কেনার জন্য যে টাকা পেয়েছিল, তার থেকে। নিজের গিফ্ট নিজেই কিনেছে সবাই, শুধু আমিই...।’ পুপুলের বাকি কথা শেষ হল না, চোখে জল এসে গেল।

পুপুলের মা বোঝানোর সুরে মিষ্টি করে বলল, ‘তুই এখন ছোট, আমাদের টাকাই তোর নিজের টাকা। পরে বড় হয়ে যখন রোজগার করবি, তখন সেই উপার্জনের টাকায় বোনের জন্য গিফ্ট কিনবি।’

‘না, আমি এখনই রোজগার করতে চাই।’

ছেলের এমন জেদের সামনে মা অসহায় হয়ে পড়ল। একটু অভিমানও হল বুঝি তাঁর।

ছেলে কি তাঁকে আপন ভাবছে না!

পুপুলের বাবা কিন্তু সব শুনে খুব খুশি হলেন, বললেন, ‘বাঃ পুপুল, এই তো চাই। নিজের টাকায় গিফ্ট কেনা চমৎকার আইডিয়া। আমি পুরো সমর্থন করছি। কিন্তু পুপুল, রোজগারটা কী করে করবে? মোটে তো এখন ক্লাস সিক্স, চাকরি তো কেউ দেবে না।’

পুপুল খানিক ক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘স্কুলের সামনে বসে আমসত্ত্ব, হজমি বিক্রি করলে রোজগার হতে পারে। কিন্তু সে আমার ভীষণ লজ্জা করবে। তা ছাড়া সেটা করতে গেলে আমার স্কুলের পড়া নষ্ট হবে। সুতরাং সেটা হবে না।’ পুপুলের বাবা মাথা নাড়লেন, ‘ঠিক, ঠিক, একেবারে ঠিক। ও ভাবে হবে না। পড়াশোনা নষ্ট করে তো কিছু হবেই না। অন্য কিছু ভাব, পুপুল।’

পুপুল সত্যিই গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবতে লাগল। একটু পর বলল, ‘মা, সপ্তাহে দু’দিন বাপিদা আমাদের বাড়ির জানলার কাচ মুছে দেওয়ার জন্য তুমি কত করে দাও?’

মা চমকে উঠল, ‘কেন, কেন?’

‘এই মাসটা আমি মুছব, তুমি টাকাটা আমাকে দেবে। আমার পারিশ্রমিক। এ ভাবেই আমি উপার্জন করতে চাই।’

‘বাঃ বাঃ, দারুণ আইডিয়া।’ পুপুলের বাবা খুশির গলায় বললেন। মাকে আপত্তি করার আর কোনও সুযোগই দিলেন না। তবে পুপুলকে বললেন, ‘ওই টাকায় কি ভাল একটা গিফ্ট হবে, পুপুল? তোমাকে আরও কিছু করতে হবে।’

‘আর কী করা যায়, আর কী করা যায়!’ পুপুল হাতড়াতে লাগল।

বাবা বললেন, ‘আমি একটা পথ বাতলাতে পারি। তুমি কি পারবে?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ পারব। তুমি বলো, কী করতে হবে?’

‘আমাদের গাছগুলোর পরিচর্যা করতে পারবে? রোজ জল দেবে, মাটি নিংড়ে দেবে, যত্ন করবে। আমি তা হলে এক মাস মালির কাজ বন্ধ রেখে তোমাকে সেই টাকাটা দিতে পারি।’

পুপুল আনন্দে লাফিয়ে উঠল, ‘খুব পারব বাবা, বেশ পারব আমি।’

মা একটু রাগ করে বলেই ফেলল, ‘হ্যাঁ, পড়াশোনা নষ্ট করে এ সব করবে পুপুল?’

‘পড়াশোনা নষ্ট করে কেন? আমি পড়াশোনা করেই এগুলো করব। তোমরা দেখো পারি কি না।’

ভাইফোঁটার আগের দিন পুপুল বাবার সঙ্গে মার্কেটিংয়ে গেল। নিজের টাকায় কিনল একটা মস্ত টেডি বিয়ার আর এক বাক্স চকোলেট। বেজায় খুশি সে। লাফাতে লাফাতে বাড়ি এল। কাল কত ক্ষণে এই গিফ্ট পিংকিকে দেবে, সেই অপেক্ষায় রাতটা কাটল কোনও মতে। পর দিন সকালেই পিংকি বাবা-মায়ের সঙ্গে এ বাড়ি এসে হাজির। পিংকি তার গিফ্ট দেখে আহ্লাদে আটখানা।

তার পর পিংকির বাবা-মা যখন সেই গিফ্ট কেনার কাহিনি সব শুনল, তখন তারা পুপুলকে বাহবা দিতে লাগল। পিংকির মা বলল, ‘সব সত্যি নাকি রে পুপুল?’

‘হ্যাঁ, কাকিমা। এই গিফ্ট আমার উপার্জনের টাকায় কেনা।’

পিংকির বাবা মানে পুপুলের কাকা পুপুলকে প্রায় কোলেও তুলে ফেললেন, ‘আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, এত সুন্দর ভাইফোঁটার উপহার পুপুল ছাড়া আর কেউ কিনতেই পারেনি এ বার।’

লজ্জা-লজ্জা মুখে পুপুল কাকার কোল থেকে নেমে মায়ের আঁচলে মুখ লুকালো। ও দেখেছে মায়ের মুখে রাগ নেই, বরং হাসি আছে।

উপহারের হাসি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন