এক ছিলিম ফিলিম

সময় ব্যাপারটা সিনেমাওয়ালাদের কাছে একটা ধাঁধা বা চ্যালেঞ্জের মতো, যেটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনও শর্টকাট নেই। একটা গোটা রাত বা একটা পুরো দিনের ঘটনা নিয়ে আস্ত একটা ছবি হতে পারে। আবার একশো বছরের ইতিহাসও পরদায় উঠে আসতে পারে। আসলে পরিচালক দেড় ঘণ্টার গল্প বলবেন না দেড়শো বছরের, সেটা একেবারেই তাঁর ব্যাপার। এই ছবিতে যেমন একটা পরিবার, বা আরও স্পষ্ট করে বললে, মেসন নামে একটা ছেলের জীবনের বারোটা বছর ধরা আছে!

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

সময় ব্যাপারটা সিনেমাওয়ালাদের কাছে একটা ধাঁধা বা চ্যালেঞ্জের মতো, যেটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনও শর্টকাট নেই। একটা গোটা রাত বা একটা পুরো দিনের ঘটনা নিয়ে আস্ত একটা ছবি হতে পারে। আবার একশো বছরের ইতিহাসও পরদায় উঠে আসতে পারে। আসলে পরিচালক দেড় ঘণ্টার গল্প বলবেন না দেড়শো বছরের, সেটা একেবারেই তাঁর ব্যাপার। এই ছবিতে যেমন একটা পরিবার, বা আরও স্পষ্ট করে বললে, মেসন নামে একটা ছেলের জীবনের বারোটা বছর ধরা আছে! বাজেট-টাজেট, অভিনেতাদের ডেট-ফেট নিয়ে সমস্যা না থাকলে, এ রকম একটা ছবি বানাতে এখন পাঁচ-ছয় মাস বা বড়জোর বছরখানেক লাগবে। কিন্তু পরিচালক ছবিটা বানিয়েছেন বারো বছর ধরে! পাখির বাসা তৈরির মতো, একটু একটু করে। এই সময়টার মধ্যে পরিচালক ও তাঁর ইউনিট আরও পাঁচটা কাজ করেছেন। কিন্তু এই ছবিটাকে কক্ষনও মাথা থেকে বের হতে দেননি। বছরে নিয়ম করে তিন-চার দিনের ছোট্ট শিডিউল, বারো বছরে মোট শুটিং হয়েছে ৩৯ দিন।

Advertisement

এই বারো বছরে মেসনের বাবা-মা মধ্যযৌবন থেকে মাঝবয়সে এসেছেন। মেসন আর তার ভূমিকাভিনেতা এললার কোলট্রেনও ছয় বছরের শিশু থেকে হয়ে উঠেছে আঠেরো বছরের তরতাজা তরুণ। এই সময়ের মধ্যে মেসনের মা অলিভিয়ার তিন বার ডিভোর্স হয়েছে। মেসন আর তার দিদি সামান্থাকে নিয়ে তাঁকে তিন বার বাড়ি পালটাতে হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে অলিভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থেকে ইস্কুলের দিদিমনি হয়েছেন। মেসনের বাবাও আর এক বার বিয়ে করেছেন, মেসনের একটা ভাইও হয়েছে। এক বার মেসনের পনেরো বছরের জন্মদিনে সে আর সামান্থা, তাদের বাবা আর নতুন মায়ের সঙ্গে তাদের দাদু-ঠাকুমার কাছে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতেও গিয়েছিল। মেসনের দাদু তাকে একটা বন্দুক উপহার দিয়েছিলেন। চালাতেও শিখিয়েছিলেন। ষোলো বছর বয়সে মেসনের একটা বান্ধবীও জুটে গিয়েছিল। ছাদের আলসের ধারে সেই মেয়েটিকে মেসনের প্রথম চুমু, তার পর চিলতে একটা বিছানায় প্রথম জেনে নেওয়া নারীশরীরের স্বাদ।

এমনি করেই মেসনের জীবনটা বয়ে যেতে দিয়েছেন পরিচালক। বিবাহবিচ্ছিন্ন আমেরিকান বাপ-মায়ের সন্তানদের গড়পড়তা জীবনটা যে ভাবে কাটে আর কী! মেসনও একটা আলগা উদাসীন কৌতূহল নিয়ে তার চার পাশের পৃথিবীটাকে দেখেছে। তার প্রথম বার প্রেমে পড়ায় যেমন থইথই রোমান্স কিছু ছিল না, ‘প্রথম প্রেম ঘুচে যাওয়ার যন্ত্রণাকে নিয়ে’ সে তেমন হেদিয়েও মরেনি। আসলে এই ছবিটার গড়নে কোথাও আবেগ বা নাটকের উপচানো আতিশয্য নেই। অলিভিয়ার দুই আর তিন নম্বর মোদোমাতাল স্বামীর নেশাগ্রস্ত চিৎকার-চেঁচামেচি-অশান্তির খুচরো দৃশ্য ছাড়া ছবির চলনটা কোথাও চড়ায় ওঠেই না। কারণ পরিচালক এখানে ছবির ছড়ানো-গড়ানো এপিক-ধাঁচাটার সঙ্গে ছবি তৈরির প্রক্রিয়াটাকে মিলিয়ে দিয়েছেন। এখানে তো আর ক্লাইম্যাক্সের শুটিং আগে, গোড়ার দৃশ্য পরে, এ ভাবে ছবিটা তৈরি হয়নি। মেসন পরিবারের গল্প যে ভাবে এগিয়েছে, ছবির মেকিংও একদম সেই ক্রমেই চলেছে। অভিনেতা এললারের গালে স্বাভাবিক ব্রণ, মেসনের বয়ঃসন্ধির চিহ্ন হয়ে ওঠে। এললারের সত্যি সত্যি ফোটোগ্রাফির শখ পরদায় মেসনের হাতেও ক্যামেরা তুলে দেয়! সময় এখানে নদীর মতো বইতেই থাকে। পরিচালক, কুশীলব সবাই মিলে তাতে ছোট ছোট মুহূর্তের নৌকো ভাসান!

Advertisement

ছবির শেষে মেসন হাইস্কুল পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়। আর প্রথম দিনেই তিনটি ছেলেমেয়ে তার বন্ধু হয়ে যায়। ওদের সঙ্গে দক্ষিণের মরু-অঞ্চলে হিচ-হাইকিংয়ে আসে মেসন। শেষ দৃশ্যে সূর্যাস্তের আলো গায়ে মেখে দুই টিন-এজ তরুণ-তরুণী দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। একটু আগেই মেয়েটি বলেছিল, ঠিক এক্ষুনি যে মুহূর্তটা তাদের মুঠোর ভেতর আছে, সেটাই জীবনের সবচেয়ে দামি সময়। মেসনও তাতে সায় দিয়েছিল। বালকবেলা পেরিয়ে মেসন কি আবার নতুন একটা জীবনের তাপ ছুঁচ্ছে?

sanajkol@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন