এক ছিলিম ফিলিম

৫ জুলাই সাতসকালে বাড়ি ফিরে নিক দেখল, তার বাড়ির ফার্নিচারগুলো সব এ দিক-ও দিক— ইস্ত্রি করার টেবিলে ইস্ত্রিটা তখনও অন করা, গ্লাস-টপ টেবিলটা চারটে ঠ্যাং তুলে উলটে আছে, কাচটা ভেঙে চুরমার! আর তার লক্ষ্মী, সোনা, মিষ্টি বউটা, মানে অ্যামি, কোত্থাও নেই! নিকের ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটবার আগেই প্যাঁ-পোঁ করে হুটার বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি এসে হাজির। বনি নামে মেয়ে ডিটেকটিভটি বেশ স্মার্ট, বুদ্ধিমতী। কিছু ক্ষণের মধ্যেই সে এমন দু’একটা ক্লু আবিষ্কার করে ফেলে, তাতে অ্যামি কিডন্যাপ্ড হয়েছে না খুন, সেটা নিয়ে দর্শক ধন্দে পড়ে যান।

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৪ ০১:১৮
Share:

৫ জুলাই সাতসকালে বাড়ি ফিরে নিক দেখল, তার বাড়ির ফার্নিচারগুলো সব এ দিক-ও দিক— ইস্ত্রি করার টেবিলে ইস্ত্রিটা তখনও অন করা, গ্লাস-টপ টেবিলটা চারটে ঠ্যাং তুলে উলটে আছে, কাচটা ভেঙে চুরমার! আর তার লক্ষ্মী, সোনা, মিষ্টি বউটা, মানে অ্যামি, কোত্থাও নেই! নিকের ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটবার আগেই প্যাঁ-পোঁ করে হুটার বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি এসে হাজির। বনি নামে মেয়ে ডিটেকটিভটি বেশ স্মার্ট, বুদ্ধিমতী। কিছু ক্ষণের মধ্যেই সে এমন দু’একটা ক্লু আবিষ্কার করে ফেলে, তাতে অ্যামি কিডন্যাপ্ড হয়েছে না খুন, সেটা নিয়ে দর্শক ধন্দে পড়ে যান।

Advertisement

তবে অ্যামির কী হল? সেটা খুঁজতে পরিচালক কখনও ‘কে করিল’ গোছের থ্রিলার বানাতে বসেন না। বরং ‘অ্যামি এখন নেই’ এই ঘটনাটাকে মাঝখানে রেখে নিক আর অ্যামির সম্পর্কের একটা ময়নাতদন্তে নামেন। এখানে এক দিকে আমরা যেমন ৫ জুলাই সকালের পর থেকে পুলিশ, তদন্ত, জেরা, উকিল সবসুদ্ধ নিকের রোজনামচা দেখি, অন্য দিকে তেমনই অ্যামির ডায়েরির পাতা উলটে, তারই ভয়েসওভারে উঠে আসে তাদের সম্পর্কের ফ্ল্যাশব্যাক। তাদের প্রথম দেখা, সাংবাদিক নিকের রিপোর্টার্স নোটবুকের ভাঁজে তার বাগ্দানের আংটি, এবং দাম্পত্য-বিছানায় অ্যামির অনুগত লাস্য, তৃপ্তির শীৎকার— টুকরো টুকরো দৃশ্যে একটা রঙিন রোম্যান্সময় কোর্টশিপ আর ঘন মাখোমাখো একটা সুখী খুশি জীবনের নিখুঁত স্বপ্নিল ছবিই ভাসিয়ে রাখে।

কিন্তু ছবি যত এগোতে থাকে, অ্যামির ডায়েরির এন্ট্রিতে তাদের দাম্পত্যের আহ্লাদি-আদুরে ধরনটাও ততই বদলাতে থাকে। অ্যামির ফ্ল্যাশব্যাকে নিক আর আগেকার ‘প্রেমিক’ স্বামীটি নয়। সে অন্য মেয়ের সঙ্গে নষ্টামি করে। ঝগড়াঝাঁটির সময় অ্যামির গায়ে হাত তোলে। তাকে বিচ্ছিরি ভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।

Advertisement

অন্য দিকে অ্যামি অন্তর্ধান রহস্যের তদন্তেও নিকের ওপর চাপ বাড়ে। অ্যামির মা-বাবার প্রকাশনা-ট্রাস্টের নাম দেশজোড়া। সেই প্রভাব খাটিয়ে তাঁরা ‘নিখোঁজ’ অ্যামির জন্য বেশ ভাল রকম একটা ক্যাম্পেন গড়ে তুললেন। রাস্তায় রাস্তায় অ্যামির ছবি নিয়ে মোমবাতি মিছিল, মোড়ে মোড়ে মঞ্চ বানিয়ে সিভিল সোসাইটির পথসভা! টেলিভিশনের চ্যানেলে চ্যানেলে প্যানেল-বিতর্ক! নিকই তার বউকে খুন করেছে, এই প্রচারটা ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। এরই মধ্যে ডিটেকটিভ বনি কোত্থেকে একটা মেডিকাল রিপোর্ট জোগাড় করে এনে বলছে, অ্যামি নাকি অন্তঃসত্ত্বা ছিল! সবটা মিলিয়ে নিকের জেল-এ যাওয়ার বন্দোবস্ত প্রায় পাকা। অথচ কোথায় যেন একটা খটকা থেকে যাচ্ছে! মনে হচ্ছে এই পুরো চিত্রনাট্যটা যেন অ্যামিরই সাজানো— নিককে ফাঁসানোর জন্য।

এখান থেকেই ন্যারেটিভে আর একটা মোচড়! ফ্ল্যাশব্যাকের বদলে অ্যামিকে এ বার আমরা দেখি ৫ জুলাইয়ের ঘটনার ঠিক দুই ঘণ্টা পর থেকে! তার ‘নিখোঁজ’ হওয়া নিয়ে গোটা শহর যখন তোলপাড়, তখন অ্যামি কি করছিল, এ বার সেই সূত্রগুলো জোড়া হয়। এই অ্যামি মোটেই তার বানানো-সাজানো ডায়েরির পাতার ওই নরম-ভিতু-বিপন্ন-অসহায় বধূটি নয়। সে খুব ঠান্ডা মাথার এক সাইকোপ্যাথ। নিজের মতলব হাসিল করার জন্য যে যে কোনও ‘প্রমাণ’ সাজাতে পারে। এমনকী সিসিটিভির ক্যামেরার সামনে নিজেকে ‘ধর্ষিতা’ও বানাতে পারে। আর তার সেই ‘কাল্পনিক’ কিডন্যাপার তথা ধর্ষণকারী, যে তাকে বিপদের দিনে আশ্রয় দিয়েছিল, তার গলার নলি কেটে, তার রক্তে শরীর ভিজিয়ে, আবার তার পুরনো বরের বুকে এসে ঝাঁপাতেও পারে!

পরিচালক আসলে এখানে সাইকো-থ্রিলার বা ধ্রুপদী ‘নয়্যার’ ছবির গড়নে একটা কুচকুচে ঘন কালো কমেডিই বানিয়েছেন। বিয়ে নামের আধুনিক ভড়ংটার গা থেকে চুন-পলেস্তারা সব খসিয়ে ফুটোফাটা ড্যাম্প-ধরা দেওয়ালটা সব্বাইকে দেখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ওই দেওয়ালটা খাড়া রাখতেই হয়, নইলে ঘরটাই তো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে! তাই একটু আগেই ভয়ানক রাগে যে অ্যামির মাথাটা সে ঠুকে দিয়েছিল, তারই হাত ধরে হাসিমুখে নিককে নীচে বসার ঘরে আসতেই হয়! সেখানে তার আর অ্যামির পুনর্মিলনের পার্টি চলছে! এর পর তারা যুগলে টিভিতে ইন্টারভিউও দেবে। সুখী দাম্পত্যের হাসি হাসি ছবি পৌঁছে যাবে আরও কত ‘সুখী’ ড্রয়িংরুমে! বিয়ে জিন্দাবাদ!

sanajkol@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন