একটা ভয় কষ্ট লজ্জা

আচ্ছা, পাহাড়গুলো ঠায় এক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, নড়া নেই চড়া নেই, ওদের বোর লাগে না? ছোটবেলায় এ রকমটাই ভাবতাম। তার পর, ওই ছোটবেলাতেই, অমরনাথ বেড়াতে গেলাম। সেই যে বছর ধরমিন্দর কা লড়কা অউর এক নয়ি লড়কি চন্দনওয়ারির কাছে শুটিং করছিল। ওই অমরনাথের পথেই জানলাম, পাহাড় আসলে ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটানোর অতিকায় কারখানা।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৪ ০৮:৩০
Share:

আচ্ছা, পাহাড়গুলো ঠায় এক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, নড়া নেই চড়া নেই, ওদের বোর লাগে না? ছোটবেলায় এ রকমটাই ভাবতাম। তার পর, ওই ছোটবেলাতেই, অমরনাথ বেড়াতে গেলাম। সেই যে বছর ধরমিন্দর কা লড়কা অউর এক নয়ি লড়কি চন্দনওয়ারির কাছে শুটিং করছিল। ওই অমরনাথের পথেই জানলাম, পাহাড় আসলে ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটানোর অতিকায় কারখানা। কখনও এমন তুষারঝড় হয় মানুষ দেখা যায় না, কখনও অক্সিজেন কমে যায়, কখনও রাস্তা হারিয়ে যায়, আরও কত কী হয়! অমরনাথ যাওয়ার পথে একটা জায়গা পড়ে, পিসু টপ। সেখানে নাকি শেষ বড় গাছ। এর পর যত উঁচুতে উঠবে, তত নাকি অক্সিজেন আস্তে আস্তে কমতে থাকে। আমি ফঁসফঁস করে বেশ করে নিশ্বাস নিয়ে নিলাম, যেন ভেতরে অক্সিজেনের ট্যাঙ্ক আছে। ভয় ভয় করতে থাকল। অত ছোট বয়সেই বুঝলাম ‘অজানার আনন্দ’ সব সময় আনন্দময় না-ও হতে পারে।

Advertisement

ওয়াবজান পাসের দিকে এগোতে থাকলাম। বাবার মতো অনেকেরই দেখি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কেউ কেউ বসে ওষুধ খাচ্ছে। কেউ লাঠি নিয়ে প্রাণপণ ওঠার চেষ্টা করছে। ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে অনেক মানুষ। ঘোড়াগুলো তেমন ত্যাঁদড়। কিছুতেই পাহাড়ের ধার দিয়ে যাবে না। খাদের কিনারা দিয়ে হাঁটাটাই যেন ওদের সাহসের ইস্তাহার। ঘোড়াগুলোকে দেখে আমাদেরই পায়ের তলা শিরশির করছে। লোকজন এ ওর কাছ থেকে সাহস সঞ্চয় করছে। সব ঠিক হো যায়েগা, সব দর্শন করেঙ্গে কথাগুলো এত বার সবাই বলছিল, তাতেই যেন বোঝা যাচ্ছিল, সব ঠিক থাকবে না। কেমন একটা থম নেমে আসছিল গোটা পাহাড়ের ওপর। সবাই নিচু গলায় কথা বলছিল, যেন যখন-তখন একটা অঘটন আসবে।

সরু পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটার সময় দেখলাম এক জন অবাঙালি মধ্যবয়সি মহিলা ঘোড়ায় চড়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন আর তাঁর ঘোড়াওয়ালাকে চেঁচিয়ে কী সব বলছেন। বোঝা যাচ্ছিল, ঘোড়াটা একটু বেগড়বাঁই করছে। হঠাৎ একটা হইহই। মুখ বাড়িয়ে দেখি ওই মহিলার ঘোড়াটা অনেকটা দূর থেকে ছুটে উলটো দিকে আসছে। মানে, সোজা আমাদের দিকে। মহিলা বোধ হয় পড়ে গিয়েছেন। আমরা সবাই কোনও মতে পাহাড়ের সঙ্গে নিজেদের শরীর সেঁটে দিয়েছি। আর হঠাৎ, ঘোড়াটা সোজা খাদের দিকে ছুটে গেল, আর পড়ে গেল। হ্যাঁ, খাদে পড়ে গেল। ১৪০০০ ফিট থেকে একটা ঘোড়া ঝাঁপ দিল অনন্তে। কেউ কেউ দেখতে পেয়েছিল অনেক নীচের পাহাড়ের গায়ে, বিশাল পাথরে ঘোড়াটা ধাক্কা খাচ্ছে। ওর মালিক কাঁদছিল। বলছিল, শরীরে অক্সিজেন কমে যাওয়ায় ঘোড়াটার খুব কষ্ট হচ্ছিল। ও বুঝতে পারেনি কী করবে।

Advertisement

আমি ঘামছিলাম, কাঁপছিলাম। আমাকে ও-রকমটা দেখতে হয়েছিল, কারণ চোখ বন্ধ করে নেওয়া, কান চেপে ধরার কোনও সময় পাওয়া যায়নি। এত পথ বাকি। অক্সিজেনও কমে যাবে। আচ্ছা কোনও মানুষও কি অক্সিজেনের অভাবে এমন করতে পারে? তারও কি কষ্টে মাথা খারাপ হতে পারে? এ রকম কি এই রাস্তায় অনেকে করে? আচ্ছা, আমারও কি এমনটা হতে পারে? আমিও কি... এই ভয়টাই সবচেয়ে বেশি। নিজের ওপর বিশ্বাস থাকে না। পাহাড় বোধহয় সেটাও নিয়ে নেয়।

আমি এর আগে বা পরে কখনও কাউকে আত্মহত্যা করতে দেখিনি। আচ্ছা, যাঁরা মেট্রো স্টেশনে কাউকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছেন, তাঁদের থরথরে ভয়টা কত দিন থাকে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন