একটা ভয় কষ্ট [লজ্জা]

মা’র মুখ একেবারে চুপ। গাল লাল। মা আমার দিকে তাকিয়ে বিশ্বাস করতে পারছে না যে আমি এই কাজটা করেছি। আমি দুরন্ত, কিন্তু অবাধ্য বা বায়নাবাজ নই—মায়ের ভরসা ছিল। আমি ভেঙেছি সেটা। আমার হাতে তখনও ঝাল ঝাল আলুর দম। চার আনার। ভয়ে ভেতর থমথমে। মাসি কেবল মা’কে বলছে, ‘তাতে কী হয়েছে ছোটমা? আমার কাছে চার আনা পয়সা চেয়েছে তো কী হয়েছে? আমার কি ওকে ভালবেসে কিছু দিতে ইচ্ছে করে না?

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

মা’র মুখ একেবারে চুপ। গাল লাল। মা আমার দিকে তাকিয়ে বিশ্বাস করতে পারছে না যে আমি এই কাজটা করেছি। আমি দুরন্ত, কিন্তু অবাধ্য বা বায়নাবাজ নই—মায়ের ভরসা ছিল। আমি ভেঙেছি সেটা। আমার হাতে তখনও ঝাল ঝাল আলুর দম। চার আনার। ভয়ে ভেতর থমথমে। মাসি কেবল মা’কে বলছে, ‘তাতে কী হয়েছে ছোটমা? আমার কাছে চার আনা পয়সা চেয়েছে তো কী হয়েছে? আমার কি ওকে ভালবেসে কিছু দিতে ইচ্ছে করে না? আমি তোমাদের বাড়ির কাজের লোক বলে কি কিছু দিতে নেই?’

Advertisement

এত কিছুর পরেও মা চুপ। খুব ঠান্ডা শান্ত গলায় বলল, ‘তোমার খাওয়া হয়েছে?’ আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করল। চোখ গরম হয়ে উঠল। মা তো আমার সঙ্গে এমন শান্ত হয়ে কথা বলে না। ‘ও মা, মা, শোনো না... আমি তো তোমার কাছে আগে চেয়েছিলাম। ও মা, আমি আসলে...’ এ বার হাঁউমাউ কান্না আমার, ‘আমার কি কিছু খেতে ইচ্ছে করে না? তুমি তো আমায় কিচ্ছু খেতে দাও না।’

ছোটবেলায় আমার পেটের রোগ হয়েছিল বেশ ক’বার। ডাক্তার আমায় খুব সাবধানে রাখতে বলেছিল। মা কোনও রিস্ক নিতে চায়নি। এমন কঠোর ব্যবস্থা করেছিল, শুধু আলু, পেঁপে আর মাছ— আমার পাতে এদের ছাড়া কারও প্রবেশ নিষেধ ছিল। এমনকী নখদন্তহীন পটলভাজারও। মা এমন করে আমায় বুঝিয়েছিল যে আমি স্কুলের গেটে দশ পয়সার হজমি কিংবা চার আনার ঘুগনিও খেতে চাইনি। বন্ধুরা দরাজ হয়ে দিতে এলেও না করেছি।

Advertisement

এমনটা চলছিল প্রায় বছরখানেক। ক’দিন ধরেই ঘ্যানঘ্যান করছিলাম, ‘মা আমি একটু মাছের ঝাল খাব? ও মা, আমায় একটু আলুভাজা দাও না।’ কিন্তু মা’কে কোনও ভাবেই টলানো গেল না। অগত্যা আমার রেবেল নোলা এক দিন আমায় অন্যের কাছে পয়সা চাইতে বাধ্য করল। তিনি ছিলেন আমাদের কাজের মাসি। জ্ঞান হয়ে থেকে দেখেছি। অতএব স্বচ্ছন্দ। হায়ারার্কি জানি না তখনও। তাই চাইতে বাধেনি। তা ছাড়া, বাড়ির কারও কাছে চাইলে ধরা পড়ে যাব, ভয় ছিল।

পয়সা পেয়ে ছুট্টে বাড়ির সামনের ফুটপাথের ফুচকাওয়ালার কাছ থেকে আলুর দম কিনে আনলাম। যখন গিয়েছি, মা বাড়ি ছিল না। কিন্তু কিনে বাড়ি ফেরার মধ্যে মা চলে এসেছে। মা’কে দেখে আলুর দম লুকোতে গিয়ে আরও বিপত্তি। হাত থেকে অনেকটা চলকে গেল।

তখন আগুপিছু ভাবার মতো বয়স হয়নি। বুঝিনি, মাসির কাছে পয়সা নিয়ে খেতে চাইলে মা হয়তো অনেকের কাছে ছোট হয়ে যাবে। বা আমার পেটুকপনার জন্য সবাই মা’কেই দোষী ঠাওরাবে। বাড়িতে যারা আদর দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে মা আমায় কঠোর রেজিমে রেখেছিল কিনা।

রাতে চোখটা টিপ্পে বন্ধ করে শুয়ে আছি আর মায়ের ফোঁপানোর আওয়াজ শুনছি। বাবা, মা’কে বলছে, ‘আমি তোমায় ক’দিন আগে বলছিলাম না, ওকে একটু-আধটু দাও খেতে। ছোট্ট মেয়ে। ও কী পারে? আজ দ্যাখো বেপরোয়া হয়ে হাত পাতছে।’ মা’র কান্না-জড়ানো উত্তরটা আমার কানে এখনও বাজে, ‘আমি কি ইচ্ছে করে করি গো? তোমার মনে নেই ওর অসুখের সময় ডাক্তার আমাদের কেমন করে বলেছিলেন, এ বার আপনারা কিন্তু মন শক্ত করুন।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement