ক্যান্টিন

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৪ ০১:৩০
Share:

মার্ৎজে ওয়র্টেল

Advertisement

নেদারল্যান্ডস

সরি। এটাই ছিল আমার বলা প্রথম কথা। ‘মা’ নয়, ‘বাবা’ নয়, ‘সরি’। এখনও এই কথাটা আমি খুব বলি। সারা ক্ষণ খিস্তি করি। তার পরেই বলি, ‘সরি’। সব কিছুর জন্যেই আমি সরি, যা হয়েছে তার জন্যে, যা হবে তার জন্যেও।

Advertisement

খিস্তি দেওয়ার মতোই ব্যায়াম করি আমি, মানে প্রায়ই এবং অনেক ক্ষণ ধরে। মানে সোজা কথায়, বগলের ব্যথাটাকে আমি প্রথমটা সিরিয়াসলি নিইনি। ব্যায়াম করলে লোকে ব্যথায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। শেষে দেখা গেল আমার ‘লিম্ফ গ্ল্যান্ড’গুলোয় ক্যানসার হয়েছে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে শরীরের সব জায়গায়। পালানোর পথ নেই। সর্বত্র ক্যানসার। শুধু আমার মাথা ছাড়া।

ডাক্তার বললেন, মাথায় যে ব্যথাটা, সেটা নিয়ে না ভাবতে। ওটা বোধহয় স্ট্রেস। বা এত কফি খাওয়ার জন্যে। আমি গ্যালন গ্যালন কফি খাই, যাতে সব সময় টানটান থাকি। এতে অবশ্য খুব ঘাম হয় আর গা দিয়েও বিচ্ছিরি গন্ধ বেরোয়, কিন্তু তাতে আর কিছু এসে যায় না। এক এক সময় আমার প্রচণ্ড রাগ হয়, ক্যানসার সব জায়গায় আছে, মাথায় নেই কেন। এত রাগ হয়, মনে হয় মাথাটাকে ছিঁড়ে ফেলি ধড় থেকে। খুব বেশি কফি খেলেই এ রকম হয় অবশ্য। তখন আমি নিজেকে বলি, ওরে শুয়োরের বাচ্চা, শান্ত হ। ওই যাঃ, খিস্তি বেরিয়ে গেল। সরি।

খিস্তি আর ক্যানসারটার মধ্যে কিন্তু সরাসরি কোনও যোগ নেই। যদ্দুর জানি, খিস্তিটাই প্রথমে এসেছিল। প্রথম কথা আমি বলেছিলাম ‘সরি’। তার পরেই ‘শালা’। ‘আমার শৈশব’ বইতে মা তাঁর মেয়েলি ছাঁদের হাতের লেখায় সে কথা লিখে রেখেছেন। তাঁর সে কথা শুনে কী মনে হয়েছিল, তা অবশ্য ওই হাতের লেখা দেখে ধরা যায় না।

এখন আমার ভাণ্ডারে একটা নতুন ও মোক্ষম খিস্তি যোগ হয়েছে। ‘ক্যানসার’। সারা দিন আমি ‘ক্যানসার’ বলে চেঁচাই। জোরসে চিল্লিয়ে ‘ক্যানসার’ বললে আমার খুব আরাম হয়। যখন সাইকেল চালাই, তখনও চেঁচাই। আর্তনাদের মতো। ‘যাঃ ক্যানসার, আবার সিগনালটা লাল হয়ে গেল!’ ‘ওরে, গাড়ি চালাতে শেখ, ক্যানসার-গাধা!’ ‘শালা একেবারে ক্যানসার গরম পড়েছে আজ!’ কালকে, পাঁচমাথা মোড়ের ওখানটা দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছি, একটা মহিলা আমায় দাঁড় করাল। দেখতে একেবারে বেতো ঘোড়ার মতো, দাঁতগুলো সব উঁচু উঁচু, গায়ে গন্ধ কী রকম বলতে পারব না কারণ ওর সাইকেলটা ছিল একটু তফাতে। বলল, ‘আপনি কি এক্ষুনি ‘ক’ দিয়ে অসভ্য কথাটা বললেন?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, ক্যানসার তো? ঠিকই শুনেছেন। বললাম, তোরা সক্কলে ক্যানসারে মরলে ভাল।’ ‘আপনি বুঝছেন না, এতে লোকের কত খারাপ লাগতে পারে?’ খুব ভালই বুঝছি। ক্যানসার আমার গোটা শরীরকেই খারাপ লাগিয়েছে। আমার সারা গা খারাপ লাগায় ফেটে যাচ্ছে। ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝছি’, আমি বললাম। গলাটা অবিকল ঘোড়ার মতো ঘড়ঘড়িয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে মহিলা বলল, ‘আমার বাচ্চারা যখন কোনও খারাপ কথা বলে, আমি বলি, ওটার বদলে ওই রকমই শুনতে অন্য একটা কথা বলো। আপনি ক্যানসারের বদলে ক্যান্টিন বলে দেখুন না।’ ‘ক্যান্টিন!’ ‘হ্যাঁ, এতে আপনার রাগটাও বেরিয়ে আসবে, কেউ আঘাতও পাবে না। বলে দেখুন না।’ মহিলা অস্বাভাবিক বেঁটে। বামন না কি? কোথায় যেন শুনেছিলাম বামনরা খুব তাড়াতাড়ি রেগে যায়, যেন পৃথিবীর সব অপমান তারাই বয়ে চলেছে। একটু কেশেকুশে আমি বললাম, ‘ক্যান্টিন।’ একদম যা-তা। কোনও দিনই ক্যানসারের কাছাকাছি পৌঁছতে পারবে না। ‘আরও জোরে বলুন’, মহিলা বলল, উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। হাত গিয়ে হাওয়ায় একটা ঘুসি চালিয়ে, গাঁকগাঁক চেঁচিয়ে আমি বললাম, ‘ক্যান্টিন!’ মহিলা কুঁকড়ে গেল, তার পরে বলল, ‘খুব ভাল হয়েছে। আসলে ক্যানসার তো এখন সব্বার হচ্ছে। কার কখন এটা শুনলে আঘাত লাগবে, বুঝেছেন না?’

মাথা নাড়লাম। এক বার মনে হল বলি, আমার ক্যানসার, তাতে সব্বার কী এসে গেছে, তার পর ভাবলাম থাক, আমি সেন্টিমেন্টাল টাইপ নই, তা ছাড়া এ তো আর ভাল দেখতে মেয়ে নয়।

আমার বউ আমাকে ছেড়ে গেছে বছর দুয়েক আগে। কোনও ধুন্ধুমার ঝগড়া হয়নি, কোনও দোষারোপ নয়, কোনও পরকীয়াও ছিল না কারও। সোফায় বসেছিল, জাস্ট উঠে হেঁটে বেরিয়ে গেল, আমার থেকে দূরে। সোফা থেকে দূরে, তার পর বাড়ি থেকে, তার পর পাড়া থেকে, তার পর শহর থেকে। কয়েক মুহূর্তেই চলে গেল। আমি বসে রইলাম কালো সোফায়, হাঁটুগুলোকে চেপে জোড়া লাগিয়ে।

আশ্চর্য ব্যাপার হল, বিরাট কিছু তফাত বুঝলাম না। শুধু, বাড়িটা ফাঁকা বলে বেশি চেঁচাতে পারতাম। তার পর ভাবলাম, অন্য কোথাও গিয়ে থাকি। পড়শিগুলোর ন্যাকা চাউনি আর সহ্য হচ্ছিল না। সিমপ্যাথিতে উপচে যাচ্ছে। কখনও মনে হত ওদের গলা টিপে মারি। বাড়াবাড়ি? কিন্তু আমি এটা স্রেফ ভেবেছি, করি তো নি। দুটো এক নয়।

হ্যাঁ, ঠিকই, আমার প্রায়ই ভীষণ ইচ্ছে হত, একটা বাচ্চাকে ঠেলে রাস্তায় ফেলে দিই কিংবা একটা বুড়িকে মাথায় একটা ঠাস চাঁটা লাগাই। এই চিন্তা রোজ আমার মাথায় উঠত, সূর্য যেমন আকাশে। কিন্তু আবার বলি, এগুলো আমি শুধু ভাবতাম। শুধু খিস্তি আর গাছের গায়ে হিসি ছাড়া, কোনও খারাপ কাজই আমি করিনি। গ্রুপ থেরাপি সেশনে ওরা আমায় বলল, আপনি ফ্রাস্ট্রেটেড। বউ ছেড়ে গেছে বলে আসলে আপনি সারা ক্ষণ ওকেই আঘাত করতে চাইছেন। আপনি এই গ্রুপে বলুন, যা মনে আসে, বলুন। যা মনে আসে তা বলতে অবশ্য ওদের চক্ষু চড়কগাছ। তবে আমি সব গল্পই শুরু করতাম এই বলে, ‘সরি, কিন্তু সে দিন মাথায় একটা চিন্তা এসেছিল...’ সরি শব্দটার জন্য বেঁচে গেলাম। ওটা ছিল সব দাগ মুছে দেওয়ার ন্যাকড়া।

ওই পাড়া আর ওই সব চিন্তা ছেড়ে, শহরে এলাম। যেখানে কেউ কাউকে চেনে না, আর যেখানে সব সময় তুমি সেই লোকটাকে খুঁজে পাবে, যে তোমার চেয়েও খারাপ আছে। একটা লন্ড্রির ওপরতলায় একটা ঘর ভাড়া নিলাম। সেখানে নোংরা জামাকাপড়গুলো দিলে, তুরস্ক না কোথাকার দুটো লোক সেগুলোকে কেচে ইস্তিরি করে প্লাস্টিকের ব্যাগে মুড়ে দিয়ে দেবে। লোকগুলো বেশ ভাল, দেখা হলে হাসে। কখনও একটা ফল উপহার দেয়। যেন ওরা জানে আমার ক্যানসার। হয়তো জানে। অসুখের চেয়েও দ্রুত পৌঁছয় অসুখের খবর।

রোজ জিমে যাই, দু থেকে তিন ঘণ্টা ব্যায়াম করি। যখন মরব, বেশ ভাল স্বাস্থ্য নিয়ে মরতে চাই। বগলটা আর অন্যান্য শিরাটিরার জন্য আমার ব্যায়াম করা আসলে বারণ। ডাক্তারটাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘সেরে যাওয়ার কোনও চান্স আছে কি?’ কাপুরুষটা চট করে মুখ নিচু করে খাতা দেখতে দেখতে বলল, ‘সরি, আর কিচ্ছু করার নেই।’ ভালই বুঝছিলাম, ও আদৌ সরি নয়। এই পেশায় সরি না হতেই শেখানো হয়। যাকগে, মোদ্দা কথা, জিমে যাচ্ছি। ওটা ছাড়া আমার আর কিছুই নেই, আর মাথাটা আছে। সেখানে সবই ঠিকঠাক চলছে।

বউয়ের ওপর একটা সাংঘাতিক ঘেন্না জন্মেছে। লেঙ্গি খেতে কারওরই ভাল লাগে না, যতই তুমি নিজে লেঙ্গি মারার কথা রাতদিন ভাবো না কেন। সেই জন্যেই ওকে সুখবরটা দিলাম। একটা মেয়ে এক বার যদি কাউকে ভালবাসে, তাকে সারা জীবন ভালবাসবেই, মুখে যা-ই বলুক। ফোন করে ওকে বললাম, ‘আমার ক্যানসার। সারা শরীরের সব জায়গায়।’ কাঁদতে শুরু করল। দারুণ! বললাম, ‘আমাদের সব্বার ক্যানসার। সকলের। শুধু কারওটা ধরা পড়েছে, কারও এখনও পড়েনি।’ ও বলল, ‘আমি তোমার কাছে ফিরে আসছি। শেষ ক’টা দিনের জন্য।’ এই খেয়েছে, শেষে ওকে খারাপ লাগাতে গিয়ে নিজেরই পায়ে কুড়ুল মারলাম না কি? বললাম, ‘না না, সেটার দরকার নেই, সোনুমোনু।’ বাঁচোয়া, ও আর ঝামেলা বাড়াল না। বলল, ‘অন্তত তোমায় দেখে আসি?’ রাজি হলাম।

দুটোর সময় আসবে। দশটা নাগাদ আমি সোফায় বসলাম। অবিকল যে ভাবে বসেছিলাম, যখন ও ছেড়ে গেল। যেন সময় আর এগোয়নি। যদিও এখন আমি অন্য একটা শহরে অন্য একটা সোফায়। আর অবশ্যই আমার সঙ্গী এখন শালা শুয়োর ক্যান্টিন।

মারিস্কা যখন এল, খুব শুকনো, উসকো-খুসকো দেখাচ্ছিল। চামড়াটা কী রকম হলদেটে মেরে গেছে, যেন কিডনিগুলো ঝামেলা শুরু করেছে। ‘তোমায় ভাল দেখাচ্ছে’, আমি বললাম। ‘তোমাকেও’, ও বলল। ‘দেখে মনে হচ্ছে তোমার কিচ্ছু হয়নি।’ একসঙ্গে থাকো আর আলাদা থাকো, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কিছু জিনিস কক্ষনও বদলায় না।

‘একটা সিগারেট খেলে অসুবিধে নেই তো?’ জিজ্ঞেস করল। গলাটা কেমন খসখসে হয়ে গেছে। যেন একটা কুকুর অনেক দিন ধরে, খুব জোরে, বারবার বারবার ডেকে চলেছে। কিংবা সিগারেটের জন্যে এ রকম হয়েছে। ‘আমার কিছুতেই কোনও অসুবিধে নেই’, আমি বললাম। ও বলল, ‘আছো কেমন?’ ‘দিব্যি।’ বাইসেপগুলো ফুলিয়ে দেখালাম। ‘একটা উপহার এনেছি।’ এই ক্যানসারের সঙ্গে উপহারের ব্যাপারটা কী? যবে থেকে লোকে বুঝেছে আমি মরছি, একটা না একটা জিনিস দিচ্ছে। ডিভিডি, ছোট্ট টবে গাছ। বোধহয় আমি মরলেই ব্যাটারা সব ফেরত নিয়ে নেবে। তাই নিজেদের পছন্দমত একটা করে জিনিস গছিয়ে রাখছে।

বউ বলল, ‘অবশ্য বুঝতে পারছি, তোমার ওটার দরকার নেই।’ ‘কোনটার?’ ‘উপহারের।’ হয়তো বউয়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। হয়তো ক্যানসার আমার শরীরটাকে ধরেছে, আর ওর মাথাটাকে। ‘আমিই উপহার। আমি ছেড়ে গেছিলাম, এখন ফিরে এলাম। আমি ভাবলাম, এই ক’টা দিন হয়তো আমার সঙ্গে শুতে তোমার ভাল লাগবে। এখন দেখছি তোমার কোনও দরকার নেই।’

‘নাঃ’, আমি বললাম, ‘আজকাল আর ও-সব ইচ্ছে হয় না। এই শালার ক্যান্টিন।’ শুনে ওর চোখ গোলগোল হয়ে গেল। আঃ, এই চাউনিটা দেখার জন্য আমি পয়সা দিতে রাজি ছিলাম। ভগবান বিনিপয়সায় পাইয়ে দিলেন।

‘ক্যান্টিন! আজ কাগজে যে খবরটা আছে? ওই স্টোভ ফেটে পুড়ে মরে যাওয়ার খবরটা? তাতে তোমার কী? তুমি কবে থেকে অন্যের কথা ভেবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ?’ যাব্বাবা, তার মানে ও ভাবছে আমি ওর সঙ্গে শোব না বিশ্বপৃথিবীর জন্যে কষ্ট পেয়ে! এর চেয়ে মজাদার অজুহাত আমি হাজার ভেবেও বার করতে পারতাম না। গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘কী করব, চিন্তা হয়।’ কিছু ক্ষণ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘এ বার তা হলে কী হবে?’ বললাম, ‘ঠোঙা হয়ে যাবে! আজকের খবর কাল চলে যাবে ডাস্টবিনে।’ বউ আঁতকে-ওঠা চোখে বলল, ‘তোমার মাথাতেও কি ছড়িয়ে গেছে?’

নিচে লন্ড্রির আওয়াজ শুরু হল। ‘সরি’, আমি বললাম। বউ আস্তে ফোঁপাতে শুরু করল। তার পর কান্নাটা বেড়ে গেল, শেষটা হাউহাউ কাঁদতে লাগল। ‘তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম’, আমি বললাম। খুব আস্তে আমি পিছিয়ে গেলাম, তার পর পিছিয়ে যেতে থাকলাম। আরও। সব কিছু থেকে দূরে হেঁটে গেলাম।

আমার প্রথম শব্দ ছিল ‘শালা’, তার পর, জন্মের শোধ, ‘সরি’।

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন