রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩

খু দ কুঁ ড়ো

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়বাতাসী জেঠিমা প্রায়ই কাঁচুমাচু মুখে এসে জিজ্ঞেস করতেন, অরে, গোবিন্দরে দেখছস? না তো জেঠিমা, গোবিন্দরে তো সকাল থিক্যাই দেখি নাই। হারামজাদা পোলা যে কই গেল!

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share:

বাতাসী জেঠিমা প্রায়ই কাঁচুমাচু মুখে এসে জিজ্ঞেস করতেন, অরে, গোবিন্দরে দেখছস?

Advertisement

না তো জেঠিমা, গোবিন্দরে তো সকাল থিক্যাই দেখি নাই।

হারামজাদা পোলা যে কই গেল!

Advertisement

ব্যাপারটা নতুন নয়। গোবিন্দ হাড়ে হারমাদ, প্রচণ্ড বদমাশ এবং বেপরোয়া। সকাল থেকেই সে তাদের দরিদ্র কুটিরের অকিঞ্চনতা থেকে বেরিয়ে পড়ে। কখনও ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে শম্ভুগঞ্জে গিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কখনও পাটের নৌকোয় উঠে ভেসে যায় দিগন্তে, কখনও উধাও হয়ে কেওটখালিতে গিয়ে কী করে, তা সে-ই জানে! মাঝে মাঝে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফিরে আসত। গায়ে দেখা যেত কাটা-ছেঁড়া-কালশিটে। বিস্তর মার খেত এবং মারত।

কালিকাজ্যাঠা বড্ড ভালমানুষ গোছের। পুজোপাঠ করে তাঁর সংসার চলত। কিংবা চলত বলাও ঠিক হবে না। অভাবের সংসারে খিটিমিটি লেগে থাকত নিত্যি, চার ছেলেমেয়ে নিয়েই তাঁদের সংসার নয়, আরও গোটা দুয়েক পুষ্যি ছিল তাঁদের। কালিকাজ্যাঠার বিধবা বোন মাখনী, আর এক জ্ঞাতি আধপাগল পরাণ। শুধু কাঁঠালবিচি সেদ্ধ দিয়ে যে ভাত খাওয়া যায়, এটা আমি তাঁদের বাড়িতেই দেখেছি।

গোবিন্দকে নিয়ে তাঁদের ছিল লাগাতার সংকট। পাড়াপড়শিরা প্রতি দিন ঝুড়ি ঝুড়ি নালিশ জানিয়ে যেত। কিন্তু গোবিন্দর নাকে দড়ি পরানোর মতো জোরালো মানুষ সেই পরিবারে ছিল না। কালিকাজ্যাঠা মাঝে মাঝে তর্জনগর্জন করতেন বটে, কিন্তু সেটা সিংহনাদের মতো শোনাত না, বরং গরুর হাম্বার সঙ্গে খানিকটা মিল ছিল। মাঝে মাঝে বলতেন, ব্রাহ্মণের তো তিনখান কাম। কানে ফঁু, শঙ্খে ফঁু আর চুলায় ফঁু। কিন্তু ওই নিব্বইংশার পো’র তো হেই যোগ্যতাও নাই।

বলা বাহুল্য, গোবিন্দ পড়াশুনোয় নিতান্ত গাড্ডু। ইস্কুলে তার নাম লেখানো ছিল। কিন্তু কদাচিত্‌ স্কুলে যেত সে। পুজোর ক্রিয়াকর্মাদিও সে তেমন শেখেনি। ফলে, কানে ফঁু মানে লোককে মন্ত্র দিয়ে বেড়ানো, শঙ্খে ফঁু মানে পুজো-আচ্চা করে দিন গুজরান, আর চুলায় ফুঁ মানে বাড়ি বাড়ি রান্না করে অন্নের সংস্থান, কোনওটাই তার হওয়ার নয়।

তবে মাঝে মাঝে সে হঠাত্‌ এক বস্তা বেগুন মাথায় করে নিয়ে আসত। কিংবা চুবড়ি-ভর্তি মাছ। কিংবা এক পাঁজা আখ, বোঝা যেত চুরি করে এনেছে। কালিকাজ্যাঠা রাগারাগি করতেন। কিন্তু বাতাসী জেঠিমা বলতেন, চুরি কইরা আনবো ক্যান? গোবিন্দরে লোকে ভালবাইস্যা দ্যায়।

অন্য গুণ না থাক, গায়েগতরে আলিশান ছিল গোবিন্দ। বেশ লম্বা-চওড়া, ফরসা। মাথায় কোঁকড়া চুল এবং মুখে নিষ্পাপ হাসি। বদমাশ বলে তাকে বিন্দুমাত্র বোঝা যেত না।

সে বার মুক্তাগাছার জমিদার বীরভদ্রবাবুর বুড়ি পিসি চিকিত্‌সা করাতে এসে আমাদের বারবাড়ির মস্ত কাছারি ঘরটায় ছিলেন। চোখে ভাল দেখেন না, কানেরও দোষ আছে, সঙ্গে এক জন সব সময়ে দেখাশোনা করার দাসী ছিল। আর কেউ না।

এক দিন সন্ধের পর দাসীটি আমাদের ঘরে এসে গল্পটল্প করছিল। হঠাত্‌ বাইরে কাছারি ঘর থেকে চিল-চেঁচানি শোনা গেল, ‘আরে, লইয়া গেল! লইয়া গেল! অরে, তরা ধর হারামজাদারে, ধর...’

লোকজন, আলো এলে দেখা গেল, পিসির গলার দশ ভরির হারখানা নেই। চওড়া হার, চোরও ধুরন্ধর। হ্যঁাচকা টান মেরে ছিনতাই করেনি। বরং পিসির শিয়রের কাছে বসে কুশল প্রশ্নাদি করেছে এবং শেষে অতিশয় যত্নের সঙ্গে হুক খুলে হারটা নেওয়ার সময় পিসি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলেছিল, আরে করস কী? করস কী? চোর সস্নেহে বলেছে, ভারী হার গলায় রাখনের কাম কী পিসিমা? খুইলা এই বালিশের পাশে রাইখা দিলাম।

তখনকার দারোগা-পুলিশ স্বদেশি সামলাতে ব্যস্ত। চুরির ব্যাপারে তেমন তত্‌পর নয়। তবু তারা আসে। সন্দেহবশে গোবিন্দকে ধরেও নিয়ে যায়। কিন্তু কিছুই হয়নি শেষ অবধি।

সেটা বোধহয় চতুর্থীর দিন। হঠাত্‌ বিকেলের দিকে গোবিন্দ একটা ছোট্ট দুই কি আড়াই ফুট লম্বা ভারী সুন্দর দুর্গামূর্তি ঘাড়ে করে বাড়ি ফিরল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে তুমুল চেঁচামেচি। কালিকাজ্যাঠা বাড়ি মাথায় করে চেঁচাচ্ছিলেন, সর্বনাশ হইছে। এ যে মহাপাতক হইয়া পড়ল। নির্ব্বইংশার পো, এইটা করলি কী? পূজাকাটাইল্যা দিনে মায়ের মূর্তি লইয়া আইছস? পূজা না হইলে যে সর্বনাশ, বংশ থাকব না!

বাতাসী জেঠি, মাখনী পিসিও কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। অমঙ্গলের ভয় বড় ভয়।

নির্বিকার শুধু গোবিন্দ। দুর্গামূর্তি দাওয়ায় রেখে সে বুক চিতিয়ে বলল, আমি পূজা করুম।

কালিকাজ্যাঠা খড়ম তুলে তাকে মারতে গেলেন। বললেন, চাইর দিনের পূজা কি ফাইজলামি নাকি রে গর্ভস্রাব? জোগাড়যন্তর করে কে? বাপের জমিদারি পাইছস?

ঠিক এই সময় আসরে অবতীর্ণ হলেন আমার ঠাকুমা। তিনি বললেন, অশান্তির কাম নাই ক্যালকা। মূর্তিখান আমাগো বারান্দায় দিয়া যাও। আইন্যা যখন ফালাইছে, তখন পূজা করনই লাগে।

সঙ্গে সঙ্গে হুলুস্থলু পড়ে গেল। নানা দিকে লোক ছুটল এবং প্রায় রাতারাতি আমাদের বারবাড়ির মাঠে বাঁশ-বাখারি ত্রিপল দিয়ে দিব্যি পূজার মণ্ডপ তৈরি হয়ে গেল। চলে এল চাঁদমালা, রঙিন কাগজ, হ্যাজাক। বাড়ির মেয়েরা বসে গেল রঙিন কাগজের শিকলি বানাতে। ঝুড়িভর্তি ফল, ফুল, ভোগের চাল, ডাল, তরকারি এসে যেতে লাগল মুটের মাথায়।

সে কী আনন্দ আমাদের! দেবদারু পাতা, রঙিন শিকলি, চাঁদমালায় সজ্জিত মণ্ডপে যখন সেই একরত্তি, কিউট ও ভারী সুন্দর মূর্তিটি বসানো হল তখন যেন আলো হয়ে গেল চার দিক।

চোর হোক, বদমাশ হোক, গোবিন্দর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। ওর জন্যই আমাদের বাড়িতে সেই থেকে দুর্গাপুজোর প্রচলন হয়েছিল।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন