খু দ কুঁ ড়ো

জগুদা হেনার প্রেমে পড়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হল, হেনা পড়েনি। বস্তুত সে জগুদাকে চিনতই না। জগু বলে যে কেউ এই ধরাধামে আছে এবং সে যে হেনার জন্য পাগল, এ খবরটাও জানা ছিল না হেনার। হেনা তখন এইট বা নাইনের ছাত্রী। বেণি দুলিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বকবক করতে করতে রোজ বেলা সোয়া দশটায় বিধানপল্লীর রাস্তা দিয়ে হেঁটে ইস্কুলে যায়।

Advertisement

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

ছবি: সুমন চৌধুরী

জগুদা হেনার প্রেমে পড়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হল, হেনা পড়েনি। বস্তুত সে জগুদাকে চিনতই না। জগু বলে যে কেউ এই ধরাধামে আছে এবং সে যে হেনার জন্য পাগল, এ খবরটাও জানা ছিল না হেনার। হেনা তখন এইট বা নাইনের ছাত্রী। বেণি দুলিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বকবক করতে করতে রোজ বেলা সোয়া দশটায় বিধানপল্লীর রাস্তা দিয়ে হেঁটে ইস্কুলে যায়।

Advertisement

তখন সবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসে উদ্বাস্তুরা বসতি করেছে যাদবপুর অঞ্চলে। বিজয়গড়, বিধানপল্লীতে জবরদখল করা জমিতে কোনও ক্রমে খাড়া করা আশ্রয়। বেশির ভাগই টিনের চালওয়ালা ঘর। আমার পিসিমার বাড়িটা ছিল রাস্তার ওপর। আর জগুদারা থাকত একটু ভিতরের দিকে। সদ্য মাটি খুঁড়ে তৈরি করা একটা পুকুরের ও-পাশে। সেখান থেকে স্কুলযাত্রী হেনাকে দেখা যায় না। তাই দশটার মধ্যেই জগুদা চলে আসত আমার পিসিমার বাড়িতে। তার পর বারান্দায় বসে হাঁ করে চেয়ে থাকত। পিসিমা তরকারি কুটতে কুটতে নানা রকম কথা বলত। জগুদা উলটোপালটা জবাব দিত। কিংবা মোটেই জবাব দিত না। কথা কানেই ঢুকত না তার।

প্রথম প্রথম পিসিমা কিছু বুঝতে পারেনি ঠিকই। কিন্তু রোজ একই ঘটনা ঘটলে ধরা পড়ার ভয় থাকেই। তাই পিসিমা এক দিন বলেই ফেলল, হারামজাদা, বেয়াক্কেইল্যা, খাউজ্যানি উঠছে বুঝি তর? মাইনকা চিপি কারে কয় জানস? মাইনষে যখন ধইরা বাঁশডলা দিব তখন ট্যার পাবি।

Advertisement

জগুদা অবশ্য সে সব সতর্কবার্তা গায়ে মাখেনি। প্রেমে পড়লে কারই বা কবে ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান থাকে? তার জগৎ তখন হেনাময়। এক বার বোধ হয় জ্বরটর কিছু হয়ে হেনার তিন দিন কামাই গেল। জগুদার সে কী ছটফটানি! তার পর যখন হেনাকে তিন দিন বাদে দেখা গেল, আত্মহারা জগুদা ‘আইছে! আইছে!’ বলে এমন উল্লাস প্রকাশ করেছিল যে, পিসিমা তাকে দরজার বাটাম নিয়ে তাড়া করে।

কলোনির ঘরে ঘরে তখন টানাটানির সংসার। বড় বড় ছেলেরা বেকার বসে আছে। হা-ভাত জো-ভাত অবস্থা। নিত্যি রাজনৈতিক মিটিং হয়। মিছিল বেরোয়। ডোল নামক সরকারি সাহায্য এবং রেশন নিয়ে মারপিট। সেই আকালে ম্যাট্রিক পাশ জগুদা একটা ব্যাংকে পিওনের কাজ পেয়ে গেল। পাকা চাকরি নয়, টেম্পোরারি। যৎসামান্য বেতন। কিন্তু তখন সেটাও হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো ঘটনা। আর জগুদার মনে হল, চাকরি যখন পেয়েছি, তখন আর হেনাকে বিয়ে করতে বাধা কোথায়?

জগুদার মা, অর্থাৎ উত্তমী জেঠিমা নিতান্তই ভালমানুষ গোছের। দুনিয়ার প্যাঁচঘোঁচ তেমন বোঝেন না। জগুদা তার মাকেই জপিয়ে নিয়ে হেনাদের বাড়িতে পাঠাল বিয়ের প্রস্তাব করতে।

কিন্তু হেনাদের অবস্থা ভাল। তার বাবা কলেজের অধ্যাপক। আর হেনার বয়সও তখন মাত্র চোদ্দো-পনেরো। ব্যাংকের পিওন, তেমন কন্দর্পকান্তি নয় এবং কোনও বিশেষ গুণও তার নেই— জগুদা পত্রপাঠ নাকচ হয়ে গেল। ভদ্র ভাবেই এক রকম ঘাড়ধাক্কা খেয়ে এল উত্তমী জেঠিমা।

এই হেনস্তার কথা কলোনিতে মোটেই চাপা থাকল না। চার দিকে হাসি-ঠাট্টা, বিদ্রুপ এবং ছিছিক্কারের ঢেউ বয়ে যেতে লাগল। রাগে-অপমানে জগুদা প্রথমে আত্মহত্যা, তার পর মদ খেয়ে দেবদাস এবং আরও পরে বেশ্যাবাড়িতে গিয়ে চরিত্রহননের চেষ্টা করতে লাগল। কোনওটাই হয়ে ওঠেনি শেষ পর্যন্ত। অফিস থেকে হুমকি দেওয়া হল, বেশি কামাই হলে চাকরি যাবে। সুতরাং জগুদা সামলে গেল।

জগুদার কাকা মাখন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিল মস্তান গোছের লোক। তার ওপর কৃষ্ণা গ্লাস ফ্যাক্টরির ইউনিয়নের পান্ডা। রোখাচোখা মানুষ। সে এসে এক দিন উত্তমী জেঠিমাকে বলল, জউগ্যার একটা বিয়া দিয়া দাও বউঠাইরেণ। হাতে ভাল এউকগ্যা মাইয়া আছে।

বাঙালি বিয়ে করতে ভালবাসে। এটা ইউনিভার্সাল ট্রুথ। অন্য অনেক বিষয় 0অনাসক্তি থাকলেও বিয়ের কথায় বাঙালি খানিকটা উজ্জীবিত হয়। ‘খাব না খাব না অনিচ্ছে’ ভাবখানা বজায় রেখেও গোমড়া মুখে এক দিন জগুদা বিয়ে করতে চলেও গেল। কপালে চন্দনের ফোঁটা, মাথায় টোপর, মুখে লাজুক হাসি। আমরা বরযাত্রী।

বিস্ময়টা অপেক্ষা করছিল বিয়েবাড়িতেই। নিতান্ত দরিদ্র পরিবারের অতি সামান্য আয়োজন। প্যান্ডেল করার পয়সা নেই বলে ভাগের উঠোনে একটা চাঁদোয়া টাঙিয়ে বিয়ের আসর। আপ্যায়নের ব্যবস্থাও খুব সুবিধের নয়। কিন্তু আমরা অবাক পাত্রী দেখে। গায়ের রংটা তেমন ফরসা নয় বটে, কিন্তু কী অপূর্ব মুখশ্রী! দীঘল চোখ, ঢলঢলে লাবণ্যে ভরা মুখ, চুলের গোছও সাংঘাতিক। বেনারসি জোটেনি বলে প্লাস্টিকের জরিওলা শাড়ি পরেছে। তবু মনে হচ্ছে রাজরানি।

জগুদা বিয়ে করে এল। কিন্তু মুখে উদাস দেবদাস-দেবদাস ভাব। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমার কাছে এ তো আত্মহত্যাই হল।

পিসিমা বউ দেখে এক দিন জগুদাকে ডেকে বলল, নিজের বউখানরে ভাল কইরা দ্যাখছস নি হারামজাদা? কোন পেতনিরে পছন্দ করছিলি রে ভূত!

কিন্তু জগুদা পাক্কা সাত দিন উদাস ভাবখানা বজায় রাখল। তার পর এক রবিবার নতুন বউদি যখন স্নান করতে পুকুরে নেমেছে, তখন জগুদাকে আমরা পাকড়াও করলাম পাশের কলাঝোপের আড়ালে উঁকি-মেরে-থাকা অবস্থায়। জগুদার তখন লজ্জায় পাতাল-প্রবেশের অবস্থা। জগুদা কয়েক দিন পর ফের ধরা পড়ল অফিসের ব্যাগে করে বউয়ের জন্য কবিরাজি কাটলেট লুকিয়ে আনতে গিয়ে।

তার পর যা হল, বলবার নয়। জীবনে আমি বিস্তর স্ত্রৈণ দেখেছি। বলতে কী, বাঙালিদের মধ্যে স্ত্রৈণরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু জগুদার মতো আর দেখিনি।

পরবর্তী দু’বছরও পিসিমার বাড়ির সামনে দিয়ে হেনা স্কুলে গেছে এবং এসেছে। কিন্তু তার জন্য হাঁ করে আর জগুদাকে বসে থাকতে দেখা যায়নি। বাঙালি পুরুষগুলো এ রকমই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন