এ রকমটা হলে তো সত্যিই মুশকিল।
বার বার হীরুর থেকে হীরুর ছায়া এগিয়ে যাবে, এ তো সহ্য করা যায় না। হ্যাঁ, একলা একলা মামার বাড়িতে তাঁর একটু খারাপই লাগে। সেই জন্যে সঙ্গী চেয়েছিল পাথরবুড়ির কাছে। তা তিনি দিয়েছেনও মন্দ নয়। নিজের ছায়ার সঙ্গে খেলতে পারা যায়! ব্যাপারটা কম নয়। আর কেউ টের পায় না, কেবল হীরু আর হীরুর ছায়া।
কিন্তু তা বলে সব ব্যাপারে ছায়া এগিয়ে যাবে!
সে দিন যেমন উত্তরপাড়ার সঙ্গে ধুন্ধুমার ফুটবল ম্যাচ। গত কয়েক বছরই তাদের কাছে হীরুদের কিশোরপুর হেরে ভূত হয়েছে। খেলার দু’তিন দিন পরেও মাথা এক প্রকার নিচু করেই যাতায়াত করতে হত। গত বারেই হারের পর কোচ বংশীবদন সরখেল দু’হপ্তা নিরুদ্দেশই হয়ে গেল। আটলান্টা না আহিরটোলা কোথায় জানি, এক আত্মীয়র ঘরে লুচি-ক্ষীর খেয়ে দিন কাটিয়েছে মনের দুঃখে।
ছবি এঁকেছেন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
এ বারেও সে রকম একটা জবরদস্ত হারের অপেক্ষাতে ছিল সবাই। হাফ টাইমের পর যখন হাবুলের মালাইচাকি প্রায় উড়ে যাওয়ার জোগাড়, তখনই কোচ হীরুকে এক রকম জোর করেই মাঠের ভিতর ঠেলে দিল। তিন গোল খাওয়া কিশোরপুর যে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না, তা মাঠের পাশে গাছপালাগুলোও বুঝে গিয়েছিল বিলক্ষণ।
হীরু মাঠে নেমেই দেখতে পেল উত্তরপাড়ার মারকুটে বিল্টু তাকে জরিপ করে নিচ্ছে ভাল করে। ফরোয়ার্ড কিরণদা হীরুকে সাহস দিয়ে গেল, ‘ভয় পাসনি, শুধু পা-টা বাঁচিয়ে।’ হীরু ব্যাকে দাঁড়াল। খেলা শুরু হতেই মারকুটে বিল্টু তিরের বেগে তিন জনকে কাটিয়ে যে ভাবে বল নিয়ে তেড়ে এল, তাতে বেশ স্পষ্ট, গোল দেওয়ার থেকে বল আটকাতে যাওয়া হীরুর পা জখম করাই তার উদ্দেশ্য। কিন্তু ঠিক হাত দুয়েক আগে বিল্টু পা হড়কে ধপাস। হতভম্ব বিল্টুর পায়ের থেকে গড়ানো বল হীরু পাঠিয়ে দিল সোজা মাঝ মাঠে।
মিনিট দশেক বল এ-পাশ-ও-পাশ হতেই আবার উত্তরপাড়া অ্যাটাকে উঠে এল দুরন্ত গতিতে। পেনাল্টি বক্সে ঢোকার আগেই আবার ওদের দু’জন ধপাস। এ বারে হীরুর বাড়ানো বল নিয়ে কিরণদা চোঁ-চোঁ দৌড়ে সত্যি একটা গোল শোধ করে দিল!
হীরু তখনই স্পষ্ট দেখতে পেল, দিব্যি কিশোরপুরের জার্সি গায়ে ডিগবাজি খাচ্ছে তার ছায়া।
কিরণদাকে কানে কানে বলল, ‘আজ আর কোনও বাছা বল নিয়ে এ দিকে আসতে পারবে না। তুমি উঠে খেলো সব সময়।’
হলও তাই। হঠাৎ হঠাৎ বল পায়ে জড়িয়ে উত্তরপাড়ার খেলোয়াড়রা পড়ে আর বল চলে যায় কিশোরপুরের পায়ে। কিশোরপুরও মনে জোর পেয়ে গিয়েছে। খেলার শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ফলাফল— উত্তরপাড়া তিন, কিশোরপুর চার। মাঠে লোক ঢুকে পড়ল হইহই করে। সব চাইতে বড় খবর, উত্তরপাড়ার বাঘা তিন জন খেলোয়াড় খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠ ছাড়ছে। কোচ বংশীবদন সরখেল হাউমাউ করে কাঁদতেই শুরু করে দিল।
ট্রফি নিয়ে সবাই যখন আনন্দ করতে করতে এগিয়ে গেছে, হীরু তার ছায়াকে আস্তে করে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
ছায়া তখন চোঁ চোঁ করে লেমোনেডের বোতল সাবাড় করতে ব্যস্ত।