জা স্ট যা চ্ছি

পাতাগুলো যেন বৃষ্টি আসার খবরের লিফলেট। সূর্য ব্যাকস্টেজে। উইংস-এর পাশ দিয়ে আলোকে নিভিয়ে কেউ পাঠিয়ে দিয়েছে দমকা হাওয়া। তাতেই ভেসে আসছে হলুদ, বাদামি টুকরোটাকরা। কেউ কেউ অন্যমনস্ক হয়ে নেমে পড়ছে মাটিতে।

Advertisement

শুভময় মিত্র

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

পাতাগুলো যেন বৃষ্টি আসার খবরের লিফলেট। সূর্য ব্যাকস্টেজে। উইংস-এর পাশ দিয়ে আলোকে নিভিয়ে কেউ পাঠিয়ে দিয়েছে দমকা হাওয়া। তাতেই ভেসে আসছে হলুদ, বাদামি টুকরোটাকরা। কেউ কেউ অন্যমনস্ক হয়ে নেমে পড়ছে মাটিতে। পরমুহূর্তে কালো হয়ে আসা ভারী আকাশের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারছে যে আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। নিঃশব্দ কলরবে অন্যরা চলে গেছে অন্য কোনখানে। মাটিতে মিশে যাবার আগের মুহূর্তে মন বদলে এমন একটা পাতা ঢুকে পড়ল আমার পশ্চিমের জানলা দিয়ে, সোজা চশমার কাচে, অল্প সময়ের জন্য মনে হল গ্রহণ লেগেছে। তার পরেই পড়ল আমার কোলে পড়ে থাকা খবরের কাগজের হেডলাইনের ওপর। দেখলাম এক বার। এটাই এই মুহূর্তের ব্রেকিং নিউজ।

Advertisement

ফেলে না দিয়ে তুলে নিলাম পাতাটা। আমি গাছপালা চিনি না। তাই পাতাটাও অচেনা মনে হল। হলুদ হয়ে গেছে, বাদামি ছিটে আছে, তবে মৃত নয়, একটু ভিজে ভিজে ঠেকল। যাকে এক বার ফেলে দিতে পারিনি, তাকে আর ফেলি কী করে! এই আমার এক মুশকিল। জরুরি ব্যাপার, দরকারি মানুষকে চিনতে পারি না। নানা রকম ক্ষতিও হয়ে যায়। খেসারত দিতে হয়। আতঙ্কে থাকি পরবর্তী বিপন্নতার। জমে ওঠে অকাজের জিনিস, যত সব অকারণ রাবিশ। সাবধানে পাতাটা বুকপকেটে রাখলাম। যাতে ভেঙে না যায়। রেখে লাভ নেই, তাও। রাখবার সময় স্পর্শ করলাম, দৃঢ় ধারণা হল বেঁচে আছে এখনও। থাক এখন আমার বুকের কাছে, নিশ্চিন্ত ভেন্টিলেটরে।

এই পাতা রেখে দেওয়ার ব্যাপারটা আমার পাশের বা সামনের লোকজন দেখলেও খেয়াল করেছে বলে মনে হয় না। এরা কেউই বাঙালি নয়, আমি নিশ্চিত জানি। কারণ, কাউকেই বাঙালিদের মতো দেখতে নয়। ভাল করে নজর করতে চোখে পড়ল যে সবারই জামাকাপড় বেশ পরিষ্কার, স্বাভাবিক। রুচিসম্মত। বেশ কয়েক জন পুরুষ সাদা শার্ট পরে আছেন, প্রায় ইউনিফর্মের মতো লাগছে। সকলেই মোটামুটি চুপচাপ বসে আছেন। কখনও-সখনও চাপা স্বরে কথাবার্তা বলছেন, ফোন এলে হাত চাপা দিয়ে কথা সেরে নিচ্ছেন, যাতে পাশের লোক বিরক্ত না হয়। এটা আমাদের ও-দিকে হয় না। আগেকার ট্রানজিস্টর রেডিয়োর মতো মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন অনেকে, বিকট চেরা আওয়াজ বের হয়। ইতর শ্রেণির লোকজন দেখলেই নিজেকে সংখ্যালঘু মনে হয়, গুটিয়ে নিই, চেষ্টা করি চলন্ত অসময়কে কোনও রকমে কাটিয়ে দেওয়ার। কেউই হল্লা না করায় লাইনের ফিশপ্লেটে চাকা পড়ার ছন্দোবদ্ধ ভারী শব্দ, কখনও উদাসী ইলেকট্রিক হর্ন, এমনকী মুম্বই শহর ছেড়ে আসার পরেও পেরিয়ে যাওয়া নানা স্টেশনের আলাদা শব্দের চেহারাটা ধরা পড়েছে কানে। আমরা সবাই নামছি পশ্চিম থেকে দক্ষিণে। কে কতটা নামব তা জানি না যদিও।

Advertisement

হকার উঠেছে। কলকাতা রওনা হওয়া ট্রেনে এ রকম দেখা যায় না। খাবার আছে ওর কাছে। পুরনো অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে ভরা, যে চাইবে তাকে ওইসুদ্ধু দেবে, পরে খালি বাসন ফেরত নিয়ে নেবে। বিরিয়ানি আছে শুনতে পাচ্ছি। যারা নিচ্ছে তারা ভেজ’টাই বেশি পছন্দ করছে। আমার একেবারে সামনে একটা ছেলে আর মেয়ে বসেছে পাশাপাশি। নানা কারণে বুঝতে পারছি তারা একসঙ্গেই যাচ্ছে। যদিও কোনও কথাবার্তা নেই, দুজনে দুদিকে তাকিয়ে আছে বেশির ভাগ সময়। দুজনের কাছেই ইংরিজি সিনেমার ম্যাগাজিন রয়েছে। ভেজ না নন-ভেজ সেই নিয়ে দুজন প্রথম কথা বলল, যেটুকু না বললেই নয়। মতের অমিল হয়েছে। দুজনেই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে যা খাবে খাক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই কিছু নিল না। মেয়েটা ফোন বের করে কী সব দেখতে লাগল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা সত্ত্বেও আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারছিলাম, এত কাছে থাকলে, একেবারে সামনে, বোঝাই স্বাভাবিক। সকালের পাতা ওড়ানো হাওয়াটা এখনও বইছে কি না বুঝতে পারছি না। জোরে চলছে ট্রেনটা, সঙ্গে তার নিজের হাওয়া। মেঘ ভরা মুম্বই ছেড়ে এলেও মন খারাপ করা মরা আকাশটা সমানে চলেছে জানলার বাইরে। সরে যাচ্ছে বিষণ্ণ সবুজ পাহাড়। কখনও ছাইরঙা উপত্যকা। টালির বাড়ি। ছাদে ভিজে কাপড়। ফাঁকা উঠোন। সব কিছু ফেলে আসা যাচ্ছে, সামনের সিটে জমাট বাঁধা ঠান্ডা অস্বস্তি ছাড়া। ট্রেনটাও যেন উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে দৌড়নোর, বার বার হর্ন দিচ্ছে। ড্রাইভার কি জানে এই দুজনের মন ভাল নেই?

ঝপ করে অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ, ট্রেনটা একটা টানেলে ঢুকে পড়েছে। তার দেওয়ালে লাগানো কমলা রঙের হ্যালোজেন আলো বার বার জানলা দিয়ে ভেতরটা দেখে নিচ্ছে। ওই আলোতে সামনের দুজনকে সিনেমার ফ্রেমের পরপর তোলা স্টিল ছবির মতো লাগছে, সিন একটাই, কিন্তু আমি জানি প্রত্যেকটার ভেতরে, অনেক গভীরে রয়েছে আলাদা আলাদা কষ্টের অন্ধকার।

হঠাৎ উঠে দাঁড়াল মেয়েটা, অস্বাভাবিক, মরিয়া চোখের দৃষ্টি, হাতের ম্যাগাজিনটা ছুড়ে ফেলে দিল সিটে। তার পর ঘুরে প্যাসেজ ধরে হাঁটতে শুরু করল। দেখল ছেলেটা, মুখে উদ্বেগ, কী যেন বলল অচেনা ভাষায়, মেয়েটা তত ক্ষণে দরজার কাছে চলে গেছে, ভিড় রয়েছে ভালই, ওকে দেখা যাচ্ছে না আর। ছেলেটা এক মুহূর্তের জন্য তাকাল আমার দিকে, বিহ্বল দৃষ্টি। তার পর উঠে এগিয়ে গেল একই দিকে। বাকিরা একটু সরে রাস্তা করে দিল। আমি, কেন জানি না, পকেটের মধ্যে পাতাটাকে এক বার ছুঁয়ে দেখলাম, ঠিকই আছে। একটু গরম যেন। উঠে দাঁড়ালাম আমিও। এগোলাম দরজার দিকে, ভিড় ঠেলে। প্রথম দরজায় ওদের খুঁজে পেলাম না। আরও এগোলাম। বাইরেটা দেখা যাচ্ছে না, খুব আস্তে আস্তে চলছে ট্রেনটা। অনেক দূরে ড্রাইভারও কি আন্দাজ করেছে কিছু, যা আমিও ভাবছি? কামরার শেষ দুটো দরজায় পৌঁছে গেলাম। পরের কম্পার্টমেন্টে যাওয়ার দরজা বন্ধ, এর পরে হয়তো এসি কোচ, তাই। দরজার বাইরে বিশাল সবুজ উপত্যকা, ট্রেন থেকে অনেক নীচে, দূরে আরও সবুজ পাহাড়। তার মানে ট্রেন আস্তে আস্তে পেরোচ্ছে ভায়াডাক্ট; এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ের গায়ে পৌঁছনোর বিশাল উঁচু খোলা ব্রিজ। লোহার তৈরি, তাই চাকার আওয়াজটাও ভারী শোনাচ্ছে।

বাঁ দিকের দরজার বাইরে বিষণ্ণ পৃথিবী। ডান দিকে রোদ উঠে গেছে, ঝলমল করছে সব কিছু। দোটানায় পড়ে গেলাম, অকারণে একটা ব্যাপারে মাথা দিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তা করাটা প্রায় মানসিক বিকারের পর্যায়ে চলে যায় আমার, আগেও হয়েছে। কিন্তু ওরা গেল কোথায়? কামরা ভর্তি লোকের সামনে ভ্যানিশ? বাঁ দিকের টয়লেটের দরজা খোলা, কেউ নেই, ট্রেন স্পিড বাড়াচ্ছে। দরজাটা ঝাপটা মারছে। ডান দিকের টয়লেটের দরজায় হাত দিলাম। বন্ধ ভেতর থেকে। ট্রেনের দুলুনিতে লক-এর কাছটায় এক চিলতে আলো কখনও বাড়ছে, কখনও কমছে। একটু পরেই পশ্চিমের হলুদ রোদ্দুরটা নিশ্চয়ই ট্রেন টপকে উড়িয়ে দেবে পুবের যত দুঃখী ছায়া।

suvolama@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন