‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ ছবির একটি দৃশ্য। অবশ্য সব ট্যাক্সি ড্রাইভারের জীবনে এতটা ঝলমলে গল্প থাকে না।
বোটানিকাল গার্ডেনের গেটাঞ্চলে অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে। রাত সাড়ে ন’টা। এখানে ঘড়ি আটটার ঘর টপকালেই সভ্যতা ফিউজ। দাঁড়িয়ে রয়েছি তো রয়েছি, কোনও বাস-ফাসের দেখা নেই। তখন একটা ট্যাক্সি ঘচ করে এসে— দাঁড়াল তো দাঁড়াল, আমার বয়েই গেল। পকেটে গোনাগুনতি টাকা, এখনও স্যালারির ঢের দেরি আছে। ট্যাক্সির জানালা দিয়ে একটা হাসি-মুখ বেরল, দাদা যাবেন না কি...আমার মুখটা তখন আমসি, প্রায় পেছন ঘুরিয়ে হাতের যানকে পায়ে ঠেলতে যাচ্ছি— ‘টাকা লাগবে না দাদা, আসুন আপনাকে ক্যারি রোড পর্যন্ত এগিয়ে দিই’, আমি আর কিছু চিন্তা করলাম না, সোজা ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সি নিয়ে কত আনসান কথা প্রচলিত, কিন্তু এ তো দেখি দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ।
ট্যাক্সি হুহু চলতে থাকে। আমি ড্রাইভারের পাশেই বসেছি, সুতরাং আলাপ। ড্রাইভারের নাম নরেশ মিত্র। রাস্তার আলো-মাখা অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি নরেশের মুখ হাসি-হাসি। আমার দিকে তাকিয়ে বলেন— কী সাহেব, কোথায় এসেছিলেন? আমি তুমুল দেখানো ভদ্রতায়: আচ্ছা, টাকা ছাড়া এ ভাবে নিয়ে যাওয়াটা আপনার...
—তাতে কী হয়েছে, একটা উপকার করলে ফেরত আসে, জানেন তো? তা ছাড়া, ও-দিকে একটা কাজও রয়েছে— মুখের হাসিটা মেলাচ্ছে না লোকটার। মাঝে মাঝে গুনগুনও— এ তো দেখছি রসকদম্ব, যাত্রাপথ ছোট হলেও, মনে হচ্ছে জমবে। বেশ জমিয়ে নরেশ মিত্রের কথা শুরু— জানেন, এক বার বোসপুকুরে কী হল? আমার সপ্রশ্ন চোখ।
—বোসপুকুরে নিয়ে তো গেছি প্যাসেঞ্জার, গলিতে ঢুকতে হবে বলছে, আমি রাজি নয়, রাত হয়ে গেছে। প্যাসেঞ্জাররা চার জন, এক জন খুব বয়স্ক, প্রায় হাঁটতে পারে না, বার বার করে বলছে। কী আর করি, ঢুকলাম গলিতে। কিছুটা এগিয়ে একটা জায়গায় ওরা তো নেমে গেল, কিন্তু ফিরতি পথে পড়লাম বিপদে। গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে একটা ডোবায় নেমে গেল পেছনের চাকা, কিছুতেই ওঠে না, কী করব, বুঝতে পারছি না। সামনের রকে কতগুলো লোককে গিয়ে বললাম, তারা রাজিও হয়ে গেল, তবে একটা শর্তে, হরলিক্সের দাম দিতে হবে। ভাবলাম, যাক, রাজি তো হয়েছে, হরলিক্সের দাম আর এমন কী! অনেক চেষ্টায় চাকা তোলার পর হরলিক্সের টাকা দিতে যাচ্ছি, ওরা বলল, এত কী দিচ্ছেন?
—হরলিক্সের দাম...
—ধুস, ওই হরলিক্স না, আমাদের হরলিক্স আলাদা। এই হরলিক্স খেলে নেশা হয়, পাউচে পাওয়া যায়—
ওরা আমার টাকার কিছুটা নিয়ে বাকিটা পকেটে গুঁজে দিয়ে বলল, গুডবাই দাদা, আবার দেখা হবে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। আসলে ওই যে উপকার করেছিলাম গলিতে ঢুকে, তারই ফেরত— বুঝলেন?
—কিন্তু...
আমার আর কিছু বলা হল না, ক্যারি রোড এসে গেছে, এ বার নেমে যেতে হবে।
এক দিন সেক্টর ফাইভে কী কাজে গেছি। ট্যাক্সিতে উঠেছি। বাইপাসে, তখন সন্ধ্যা সবে নেমেছে। সিগনালে আর একটা ট্যাক্সি আমাদের সামনে। সেটার পিছনের কাচ দিয়ে স্পষ্ট— একটা ছেলে ও মেয়ে ঘেঁষাঘেঁষি। একটু বাদে ঠোঁটে ঠোঁট— আমি জেনারেলি ট্যাক্সি-ড্রাইভারের পাশেই বসি— ড্রাইভার আমার দিকে তাকিয়ে একটা দুষ্টু হাসি দিল। একটু আগে পর্যন্ত যে ছিল হিমালয়ের মতো গম্ভীর, সে এমন করে হাসবে বিশ্বাস হচ্ছিল না। এ লোকটা হিন্দিভাষী। হিন্দি-রঙে চোবানো বাংলায় কথা শুরু হল এমন ভাবে, যেন কত দিনের চেনা—
জানেন এক দিন কী হয়েছে, এক লেড়কা অউর এক লেড়কি তো হামার ট্যাক্সিতে উঠেছে। ওই যাদবপুর এইট-বি থেকে। ওরা গড়িয়া যাবে—। থোড়া বহুত এগিয়েছি কি দেখি চুমাচুমি শুরু করে দিয়েছে। হামি কিছু বলছি না, আপনাকে বলছি (আমার দিকে ঝটিতি চেয়ে, চোখ টিপে) ওরা হামাকে ২০ টাকা ভি দিয়েছে— তো বাঘা যতীনের কাছে একটা মার্কেটের সামনে জ্যামে পড়ে গাড়ি রুকেছে, চার দিকে এত লোক, লেকিন ওরা চুমাচুমি স্টপ করছে না— এ বার কী হল, লোকজন সব গন্ডগোল শুরু করে দিল। ট্যাক্সির সামনে এসে চেঁচামেচি করতে লাগল, বলছে— গন্দা কাম, এটা ভদ্দরলোকের পাড়া, এ সব এখানে চলবে না। ওরা হামাকে ভি গালি দিতে লাগল। তখন কী হল জানেন, ট্যাক্সির দরজা খুলে ছেলেটা বেরিয়ে পড়ল। আর বলছে কী, মেয়েটা নাকি ওর ওয়াইফ আছে। তো লোকগুলোও বলল, পরমান দাও, শালা! অব কী হল, মেয়েটা ব্যাগ সে এক কাগজ নিকালকে দিল ছেলেটাকে, ছেলেটা সবার সামনে সিনা টান করে কাগজ দিখাতে লাগল, কাগজ দেখে লোকজন সব ঠান্ডা— মনে হল, জাদু করে দিয়েছে! ছেলেটা আভি ফাঁট-সে ট্যাক্সিমে ঘুসে এল, হামি ভি ট্যাক্সি স্টার্ট করে দিলাম, চুমাচুমি ভি ফির স্টার্ট হয়ে গেল। উও কাগজ কী ছিল বলুন তো—? (আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে) ম্যারেজ সাট্টিফিকেট... হা! হা!
আর এক দিন হেস্টিংস থেকে ট্যাক্সিতে চড়েছি। যাব বালিগঞ্জ। রাত হয়েছে। সে দিন শহরের কোথায় যেন একটা মিস্টিরিয়াস মার্ডার হয়ে গেছে। ট্যাক্সিচালক (নাম, সুকুমার দলুই। থাকেন বেলতলা রোডে) এ-কথা সে-কথা ঘুরে সেই মার্ডার মিস্ট্রিতে ঝপাং। এবং মার্ডার স্টোরি মন্থন করতে করতে সুকুমার অতীতে গিয়ে হাজির। প্রায় ২৫ বছর ধরে ট্যাক্সি চালাচ্ছেন, কিন্তু যে সময়টায় পৌঁছেছেন, তখন সুকুমার হেল্পার, সদ্যযুবক, বাডিং ট্যাক্সি-ড্রাইভার। বললেন: এক দিন মাঝরাতে ডানলপ থেকে উঠল চারটে ছেলে। চাচা ট্যাক্সি চালাচ্ছে, আমি পাশে। ছেলেগুলো ঠেসাঠেসি করে পিছনে বসেছে। ওরা খিদিরপুর যাবে। যখন রেড রোড দিয়ে যাচ্ছি, ওদের এক জন বলল, গাড়ি থামাও, মাইনাস—।
গাড়ি থামাতেই এক জন ড্রাইভারের মাথায় পিস্তল ধরল, আর এক জন নেমে দরজা খুলল। চাচাকে নামিয়ে ধাক্কাধুক্কি দিয়ে প্রায় চ্যাংদোলা করে ডিকিতে ঢোকাল। এ বার আমাকে বন্দুক দেখিয়ে বলল, গাড়ি চালাও— আমার হাত তখনও পাকেনি, ভয়ে ভয়ে গাড়ি চালাতে লাগলাম, ওরা যে দিকে বলল, সে দিকে। মিড্লটন স্ট্রিটে লোরেটো স্কুলের পাশে ঘুরঘুট্টে অন্ধকার গলিতে ঢুকলাম। ওরা একটা সোনার দোকানে ডাকাতি করবে বলছিল। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল। কিছুটা এগিয়েছি। হঠাৎ এক জন চিৎকার— পুলিশ, পেছনে পুলিশ। আমার কোমরে বন্দুকের গুঁতো দিয়ে বলা হল, জোরে... তার পর রাস্তাটা পেরোতেই— স্টপ, স্টপ। আমি ফুটপাত ঘেঁষে গাড়ি থামাতে ছেলেগুলো দুড়দাড় নেমে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
মাথা তখন কেমন করছে, গা বমি-বমি— বুঝতে পারছি না কী করব। দেখলাম, হুস করে পুলিশের একটা জিপ পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। মানে, ওটা এই ট্যাক্সিটাকে ফলো করছিল না। ছেলেগুলো এমনিই ভয় পেয়েছে। জলদি ডিকি খুললাম। দেখি চাচা দরদর করে ঘামছে। কেমন একটা করছে। কোনও রকমে চাচাকে বার করে ট্যাক্সিতে বসিয়ে হাসপাতাল।
এক বার ভগবান দাস নামে এক ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, ল্যান্সডাউনে। কয়েক বছর আগে, সেদিন বাগুইআটি ছিল আমার গন্তব্য। পথ অনেকটা। অল্প একটু যেতে না যেতেই বুঝতে পারলাম, প্রায় আশির কোঠায় হাজির এ লোকটা গল্পের ভগবান। আড্ডার আঁধি। রকমারি কথার মধ্যে আঁধি— থুড়ি, ঝড় নিয়েই ভগবান একটা গল্প বলেছিলেন সে দিন আমায়। (যিনি বিহারি হলেও একেবারে নির্ভুল বাংলাতেই কথা বলতে পারেন অনর্গল। আর হবে না-ই বা কেন, সেই কোন ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে চলে এসেছিলেন এ রাজ্যে)।
শুরু করলেন ভগবান: বুঝলেন দাদা, সেটা ’৬৩ সাল হবে। তখনও ট্যাক্সি চালাতে শুরু করিনি। ঝাড়গ্রামের রাজপরিবারের গাড়ি চালাই। না, ঝাড়গ্রামে নয়, কলকাতায়। সাদার্ন অ্যাভিনিউতে রাজাদের বিশাল বাড়িতে আমি ছিলাম সারা দিনের ড্রাইভার। রাজাদের তিনটে গাড়ি ছিল— স্টুডিবেকার, ল্যান্ডরোভার, অ্যাম্বাসাডর। আমি চালাতাম স্টুডি, বড় গাড়ি। বুঝলেন তো, ইয়াব্বড়। অনেক কাজের মধ্যে একটা ছিল, রাজকুমারের ছেলেমেয়েকে লেক-এ হাওয়া খেতে নিয়ে যাওয়া। রানিমা ৫০ টাকা দিতেন আমায়। বলতেন, ভগবান, ওদের ভাল কিছু খাওয়াবে, তুমিও খাবে।
এক দিন বিকেলে বাচ্চাদের নিয়ে গেছি বেড়াতে লেকের ধারে। লেকে গাড়ি থামিয়ে বাচ্চা দুটোকে একটু নামিয়েছি, দেখি চার দিক অন্ধকার করে এসেছে। সে অন্ধকার দেখে ভয় লেগে যাবে। মনে হচ্ছে, যেন সব শেষ হয়ে যাবে এখুনি। আমি তো সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চা দুটোকে গাড়িতে তুলে নিয়েছি, ভাবছি, তাড়াতাড়ি ওদের রাজবাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে। ও মা, গাড়ি ঘোরাতে যাব, শুরু হয়ে গেল ঝড়। সে কি আর যে-সে ঝড়! গাড়ির তো কাচ তুলে দিয়েছি। কিন্তু অত বড় গাড়িও দেখি দুলতে শুরু করেছে। নৌকোর মতো দুলছে, আর বাচ্চা দুটো ভয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে রয়েছে। সামনেই দেখতে পাচ্ছি একের পর গাছ উপড়ে পড়ে যাচ্ছে। পড়ে যাচ্ছে লাইটপোস্টও।
এই সময় গাড়ির ডান দিকের কাচে এসে জোরে ধাক্কা দিতে শুরু করল একটা লোক। বার বার ধাক্কা দিচ্ছে। আমি কাচ একটু নামতেই লোকটা বলল, ওর বাবা আর ও বিকেলে বেড়াতে এসেছিল। বাবা গাছ চাপা পড়েছে, আমাদের গাড়িটার ঠিক পাশেই। গাছটাকে তুলে বার না করলে বাঁচানো যাবে না। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আমি একটু মুখ তুলতেই দেখি, একেবারে কাছে একটা বড় গাছের নীচে চাপা পড়েছে এক জন বয়স্ক লোক। পা দুটো দেখা যাচ্ছে, ছটফট করছে, দেখা যাচ্ছে হাতটাও, জোরে জোরে নাড়াচ্ছে। কিন্তু আমার তো কিছু করার নেই। বাচ্চা দুটোকে রেখে কোথাও যেতে পারব না। গাড়ি তো চালানোই যাবে না। তখন ঝড়টা আরও জোরে শুরু হয়ে গেল। আমি জোর করে কাচ উঠিয়ে দিলাম, লোকটা কোথায় গেল বুঝতে পারলাম না।
আরও আধ ঘণ্টা ধরে সেই ঝড় চলেছিল। আমি ভগবানকে ডাকছি, বার বার বলেছি— গাড়িটা যেন উলটে না যায়, তুমি রক্ষা কোরো! যখন ঝড় থামল, রাত হয়ে গেছে। গাড়ির ভিতরের আলো আমি জ্বালিয়ে দিয়েছি, কিন্তু গাড়ি চালানোর অবস্থা নেই। কারণ সামনে উপড়ে পড়া একের পর এক গাছ। এই সময় জানলার সামনে দেখি কতগুলি মুখ। ভাল করে তাকাতেই বুঝতে পারি, এরা আমার চেনা, রাজবাড়ির লোকজন। বাচ্চার খোঁজে এসেছে। বাচ্চা দুটোকে ওদের কাছে দিয়ে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। কিন্তু গাড়িটা রেখেই চলে আসতে হয় ওই দিন। পর দিন রাস্তা পরিষ্কারের পর গাড়িটা ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলাম।
—আর গাছ চাপা-পড়া লোকটার কী হল?
—জানি না দাদা, ভগবান দাস কোনও পাপ করল কি না, জানি না—
আর এক দিন, রবিবার, রাত প্রায় ন’টা। টবিন রোডে দাঁড়িয়ে রয়েছি, তাড়া আছে, শিয়ালদা যাব। ট্যাক্সি, শিয়ালদা? ট্যাক্সি, শিয়ালদা? প্রত্যেকেই নির্মম নেতি জানিয়ে চলে যাচ্ছে। বাসও পাচ্ছি না, অথচ এখুনি না গেলে চলবে না। হঠাৎ চোখে পড়ল একটু দূরে বন্ধ দোকানের সামনে চাপা অন্ধকারের মধ্যে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। দৌড়ে গিয়ে দেখি স্টিয়ারিংয়ের সামনে এক জন বেশ বয়স্ক মানুষ টর্চলাইট জ্বেলে কী একটা পড়ছেন। যথারীতি: শিয়ালদা যাবেন?
বৃদ্ধ চালক ছোট বইটা বন্ধ করতেই দেখতে পেলাম ভয়ংকর বানান সমৃদ্ধ মলাট: ‘যনত্র বাহন বশিকরন বিদ্দা’। বাব্বা! এমনও কোনও বই হয়! ড্রাইভার স্টিয়ারিংয়ের পাশের খোপে বশীকরণ’টা দ্রুত চালান করে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটা দেড় হাত লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন, বসুন।
যাক বাবা, প্রাণ এল, ট্যাক্সি চালু। আচ্ছা দাদা, যন্ত্র-বাহন বশীকরণ ব্যাপারটা কী? যেন বশীভূত কালসর্প নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে, চমকে চোদ্দো হয়ে ড্রাইভার: ওটা বলা যাবে না, বলা যাবে না... বলতেই নেই... মাথা নাড়াতে থাকলেন। চালকের নাম শরৎচন্দ্র ঘোষ, বয়েস আন্দাজ পঁচাত্তর-আশি। আমি কথা ঘুরিয়ে দিলাম, দেখলাম শরৎচন্দ্রও গল্পের গুহায় প্রবেশ করলেন। তখন জঙ্গলমহলে খুব মাও-হইচই চলছে, কথায় কথায় শরৎচন্দ্র সেই সূত্র ধরেই ওঁর ট্যাক্সিজীবনের এক কাহিনি শোনালেন।
—তখন আটটা-সাড়ে আটটা। ’৭০-৭২ সাল। শ্যামবাজার থেকে উঠল তিনটে ছেলে। যাবে উলটোডাঙা। ভদ্র ছেলে সব। কিন্তু তখন ভদ্ররাই... জানেন তো, উলটোডাঙা ব্রিজটা কাঠের ছিল, উঠতেই ওদের বলে দিলাম, ওই কাঠের পুলের আগে আমায় ছেড়ে দিতে হবে। ওরা সে কথা মেনে নিল। কিন্তু কাঠের পুল আসতেই ওদের চেহারা পালটে গেল। আমার ঘাড়ের নীচে বন্দুক ঠেকাল এক জন। বলল, যদি এইখানে নামিয়ে দিই, তা হলে ওদের কারা যেন মেরে ফেলবে। ওরা মরে গেলে আমারও আর বাঁচার কোনও মানে হয় না!
বললাম, ঠিক আছে, নিয়ে যাচ্ছি। ওরা বলল, বাজারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রচণ্ড জোরে গাড়ি চালাতে হবে, কারণ বিপদ নাকি ওখানেই। ছোটবেলা থেকে আমি একটু সাহসী ধরনের, অনেক কিছু দেখেছি, অনেক বার ট্যাক্সিতে ডাকাত-গুন্ডা উঠেছে, টাকাপয়সা ছিনিয়েও নিয়েছে, কিন্তু এ বার যেন একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম।
উলটোডাঙা বাজারের সামনে এসে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলাম, দেখলাম, সামনে কিছু লোক হইহই করে উঠল, ট্যাক্সি থামাতে চাইছে তারা, কিন্তু আমি প্রায় চোখ বুজেই এগিয়ে যাচ্ছি, যা হবে দেখা যাবে, তার পর পৌঁছে গেলাম রেললাইনের কাছে। ছেলেগুলো বলল, ব্যস, এখানেই। জায়গাটা প্রায় অন্ধকার। দেখলাম, ওদের দলের আরও কয়েক জন দাঁড়িয়ে, ট্যাক্সির দরজা খুলে ছেলেগুলো নামল, আমাকেও বলল নামতে— কী নাকি কথা আছে। বাধ্য ছেলের মতো নামলাম, দেখলাম, লাইনের ধারে কেরোসিনের হ্যারিকেন জ্বলছে। ওরা বসতে বলল, জানেন কোথায়, লাইনের ওপর! এক জন কী একটা বলল, তার উত্তর শুনতে পেলাম, রেডি আছে, ওকে। তার পর সে কোথায় চলে গেল।
জনা সাত-আট ছেলে, নিজেদের মধ্যে কী সব কথা বলছে, প্রায় ফিসফিস করে, বুঝতে পারছি না। একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ ‘এই যে দাদা’ শুনে ঘোর কাটতেই দেখি এক গেলাস চা, সঙ্গে আবার স্টিলের প্লেটে ডবল ডিমের মামলেট। ট্যাক্সির তিনটে ছেলের এক জন এসে আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, দাদার জন্য আজ বেঁচে গেলাম, দাদা আমাদের কাছে সাক্ষাৎ ভগবান। আর এক জন বলে উঠল, ভগবান নয়, মাও! তার পর সবাই হাসতে লাগল।
আবছা আলোয় সেই হাসি আমি আজও ভুলিনি।
nilarnab1@gmail.com