নতুন গল্প

তুতানের দাদুর লেখার জায়গাটি বেশ। তিন তলার ছাদে যাওয়ার দরজার বাঁ দিকে চারকোনা এক চিলতে জায়গায় টেবিল চেয়ার পাতা। বাঁ দিকের জানলা আর ডান দিকে ছাদে যাওয়ার দরজা— দু’দিক দিয়ে তাকালেই খোলা আকাশ চোখে পড়ে। ছাদে বেশ কয়েকটি ফুল গাছের টব আছে। দাদু লেখার ফাঁকে ফাঁকে গাছগুলিরও পরিচর্যা করে থাকেন। বেশ নিরিবিলি।

Advertisement

শৈবাল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৭
Share:

তুতানের দাদুর লেখার জায়গাটি বেশ। তিন তলার ছাদে যাওয়ার দরজার বাঁ দিকে চারকোনা এক চিলতে জায়গায় টেবিল চেয়ার পাতা। বাঁ দিকের জানলা আর ডান দিকে ছাদে যাওয়ার দরজা— দু’দিক দিয়ে তাকালেই খোলা আকাশ চোখে পড়ে। ছাদে বেশ কয়েকটি ফুল গাছের টব আছে। দাদু লেখার ফাঁকে ফাঁকে গাছগুলিরও পরিচর্যা করে থাকেন। বেশ নিরিবিলি।

Advertisement

নীচের কোনও আওয়াজ বা গোলমাল ওপরে আসার উপায় নেই।

এই টেবিলে খাতা খুলে, চেয়ারে বসে গল্প লেখেন তুতানের দাদু গগনচন্দ্র বসু। তাঁর বয়স ছিয়াত্তর, মাথাভর্তি পাকা চুল, গায়ের রং টকটকে ফরসা। বেশ কিছু কাল সরকারি চাকরি করে বছর ষোলো হল অবসর নিয়েছেন। আগে সকালে উঠে যোধপুর পার্কে অনেকটা হেঁটে আসতেন, এখন পারেন না। এখন কেবল পার্কের পিছনের হরিণঘাটার বুথ থেকে দুধটা এনে দেন। তার পর সারা দিন বাড়িতে।

Advertisement

কিছু দিন হল শরীরটা ভাল যাচ্ছে না দাদুর। মাঝে এক দিন স্নানঘরে পড়েও গিয়েছিলেন, তখন ডাক্তার তাঁকে কম পরিশ্রম ও বেশি বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তুতানের ঠাকুমা আর তার বাবা তাই এখন কড়া নজর রাখেন, যাতে বুড়ো মানুষটি ডাক্তারের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন।

খুব ফুর্তিবাজ আর আমুদে টাইপের মানুষ কিন্তু তুতানের এই দাদু। তাই বুঝি উনি ছোটদের জন্যে মজার মজার গল্প লিখতে পারেন এত ভাল। সে সব গল্প ছাপা হয় ‘ছুটির মজা’, ‘রবিবার’ এই সব পত্রিকায়। মাঝে মাঝে পত্রিকা-অফিস থেকে মানি-অর্ডারে কিছু টাকাও আসে দাদুর নামে। দাদু অমনি সে টাকা নিয়ে তুতানের যা প্রিয়, সুরেশের দোকানের রাসমালাই আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কাকাবাবু’ সিরিজের কোনও বই কিনে নাতির হাতে দিয়ে বলেন, ‘পেট ভরে খাও আর আশ মিটিয়ে পড়ো।

তোমাকে একটা ভাল খবর দিই, খুব শিগ্গিরই আমার এই গল্পগুলো নিয়ে একটা বই বেরুতে চলেছে।’

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

দাদুর শরীর খারাপ হওয়ার পর থেকে তুতান লক্ষ করছিল, দাদু তিন তলায় ওঠা কমিয়ে দিয়েছে। আগে দাদু গুনে গুনে তিন বার ওপরে উঠত— সকাল, দুপুর আর রাত। ওপরে উঠত আর বিশেষ করে সকালে থাকত অনেকটা সময়। লেখার ফাঁকে ফাঁকে ছাদে ঘুরে নিত একচক্কর, দেখাশুনো করত টবের গাছগুলোর। এক দিন দুপুরে খাওয়ার সময় তুতানের মাকে দাদু বললেন, ‘জানো মীরা, তোমার গোলাপগাছে কুঁড়ি দেখা দিয়েছে।’ শুনে তুতানের মা বললেন, ‘তাই নাকি। এ তো খুব ভাল খবর বাবা। আপনি আর একটা পারশে মাছ নিন।’

তুতান কিন্তু লক্ষ করছিল দাদু আজকাল তিন তলায় উঠলেও থাকে না বেশি ক্ষণ। তা-ও সকালেই যা এক বার যায়। দুপুরে বা সন্ধ্যায় ওপরে ওঠা তো কবেই ছেড়ে দিয়েছে। তার মানে লেখার কাজ অনেক কমিয়ে দিয়েছে। দাদু যখন তিন তলায় ওঠে তুতান সব সময় সঙ্গে যেতে পারে না। তার প্রথম কারণ, পড়ার চাপ, দ্বিতীয় বড় কারণ হল, তুতানের ডান পা-টা অন্য পায়ের চেয়ে ছোট এবং দুর্বল। জন্ম থেকে তার শরীরে এই খুঁত। তাকে কেউ দু’হাতে তুলে না ধরলে তার পক্ষে সিঁড়িভাঙা সম্ভব হয় না।

ক্লাস ফাইভের পড়ুয়া তুতান আরও লক্ষ করেছে যে, আগে দাদু মাসে অন্তত দু’বার পাণ্ডুলিপি খামে ভরে পার্কের পিছনে ‘দ্রুতগতি’ নামে যে ক্যুরিয়ারের অফিস আছে সেখানে জমা দিতে যেত। বিকেলবেলা সেখানে যাওয়ার সময় দাদু তুতানকে বলত, ‘চল তুতান, লেখা ‘দ্রুতগতি’তে দিয়ে আসি।’ দাদুর পরনে হালকা হলুদ কী সবুজ রঙের টি-শার্ট, সাদা ফুলপ্যান্ট। তুতানের হাত ধরে সাইকেল-রিকশায় উঠতে উঠতে দাদু বলে, ‘তোমাকে সঙ্গে নিয়ে ক্যুরিয়ার অফিসে লেখা দিতে যাওয়ার একটা ভাল দিক। কী বলো তো?’ তুতান দাদুর মুখের দিকে তাকায়। দাদু বলে, ‘সে লেখা তাড়াতাড়ি ছাপা হয়ে যায়।’

দাদু হেসে উঠত হো হো করে, তুতান হাসত শব্দ না করে।

ফেরার পথে এ-পাড়ার নামী আইসক্রিম পার্লার ‘মিষ্টিমুখ’-এ ঢুকে আইসক্রিম খাওয়া হত দু’জনের। খেতে খেতে দাদু বলত, ‘জানো তো তুতান, এই যে গল্পটা পাঠালাম এটা একদম সত্যিকারের গল্প।’ দুই কি তিন পাতার সে গল্প সংক্ষেপে শোনাত দাদু তুতানকে। এক মাস কি দু’মাস পরে সে লেখা যখন বের হত ‘শতদল’-এ, তখন সেটা পড়ে যে কী আনন্দ তুতানের, তা বলার নয়।

সে সব দিন এখন নেই। এখনও দাদু ওপরে ওঠে বটে, কিন্তু নেমে আসে একটু পরেই। দাদুর মুখের সেই হাসিখুশি ভাব, সেই মজা করে কথা বলা সে সবও যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। দাদু এখন বেশির ভাগ সময় শুয়ে থাকে বিছানায় কি ডিভানে, গুন গুন করে সুর ভাঁজে একটা— তুতান লক্ষ করেছে সেটা আনন্দের সুর নয়, দুঃখের।

এক দিন সকালে দাদু ওই রকম শুয়ে আছে, রবিবার বলে তুতানও বাড়িতে। দিদা আর বাবা-মা গল্ফ গ্রিনে অসুস্থ হরিমোহনদাদুকে দেখতে গিয়েছে। আগের দিন দাদুর জ্বর হয়েছিল, তুতান তার স্কুলের কাজ একটি রচনা ‘আমার স্কুল’ ও ছ’টি অঙ্ক করে দাদুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছো, দাদু?’

‘ভাল আছি দাদু’, তুতানের হাতের ওপর নিজের হাত রেখে দাদু বলে, ‘জ্বরটা ছেড়ে গেছে, মাথাটাও অনেক হালকা লাগছে। ডাক্তারের ওষুধে কাজ হয়েছে বলতে হবে।’

তুতান দাদুর আরও কাছে আসে। একটা প্রশ্ন তার মনে অনেক দিন ধরেই ঘুরছিল। এখন সেটা মুখফুটে বলেই ফেলে। ‘তুমি যে সকালে তিন তলায় ওঠো এক বার করে, গল্প তো লেখো না বলো, তা হলে করোটা কী?’

‘না দাদু, গল্প লিখি না।’ গগনবাবু শুকনো মুখে জবাব দেন। ‘মানে শরীরটা ঠিক নেই তো। শরীর ঠিক না থাকলে কী জানো তো, মনটাও অসাড় হয়ে থাকে, মাথায় গল্প খেলতে চায় না। আগে একটু ভাবলেই মাথায় প্লট এসে যেত আর ঝটপট সেটা লিখে ফেলতাম। এখন এটা একেবারেই হয় না।’

‘তা হলে করোটা কী?’ তুতান দু’হাতে দাদুকে আলতো করে ধাক্কা দেয়। ‘ওপরে যে ওঠো, নামো তো কিছু ক্ষণ পরে— এত ক্ষণ করোটা কী? গল্প তো লেখো না, তা হলে কী করো...?’

‘কী করি?’ গগনবাবু হঠাৎ বিছানার ওপর উঠে বসেন। তাঁর চোখেমুখে সেই পুরনো ফুর্তি যেন জ্বলজ্বল করে ওঠে। ‘করি একটা কাজ, গল্প লেখার মতোই আনন্দের কাজ সেটা। দেখবে তুমি?’ নাতিকে দু’হাতে নাড়া দেন গগন বসু। ‘দেখতে চাও? চলো তবে আমার সঙ্গে।’

দু’হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে ধরেন দাদু। তাঁর নাতিকে নিয়ে আসেন তিন তলায়। ছাদে যাওয়ার পথে তুতান দেখে, দাদুর টেবিলের ওপর সাদা খাতা, তাতে একটি অক্ষরও লেখা নেই, কলম খাপে বন্ধ। কিন্তু ছাদে পা দিয়েই চোখে পলক পড়ে না তার। দেখে তিন তিনটে গোলাপ গাছ ফুলে ভরা। বোগেনভেলিয়ার ফুলে ভরা ডাল লতিয়ে উঠেছে চিলের ছাদে, ও-দিকে অর্কিড আর পাতাবাহারের মেলা, তার পেছনে থোকা থোকা টগর আর জুঁইয়েরা যেন বলছে, ‘এ দিক এসো তুতান। দেখে যাও আমরা কত আনন্দে আছি!’

অনেক, অনেক দিন পরে ছাদে উঠেছে তুতান। তাই লাল, নীল, সবুজের মেলার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলার আনন্দে অবাক হয়ে সে বলে, ‘এ কী দাদু!’

দাদু তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন গল্প?’

তুতান বলে, ‘দারুণ!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন