ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
মা, চক্ষুদান মানে কি গো?’
রূপালী তখন রবিবাসরীয় সন্ধেবেলায় জমিয়ে টিভির কোনও একটা চ্যানেলে দেওয়া বাংলা ছবি দেখছিলেন। হাতে ধূমায়িত চায়ের কাপ। তার শাশুড়িমা নিবেদিতাও সোফায় গ্যাঁট হয়ে বসে সিনেমায় মগ্ন। আর স্বামী রজত কাগজের শব্দছক সমাধানে হাতে কলম, কপালে ভাঁজ, চোখ বন্ধ অবস্থায় শব্দ সূত্র অন্বেষণে গভীর চিন্তারত।
ডাইনিংয়ের এক দিকে তিতাসের পড়ার টেবিল, বইয়ের র্যাক।
ছেলের প্রশ্নটা প্রথমে কানে পৌঁছয়নি মায়ের। দ্বিতীয় বার, অতএব একই প্রশ্ন করে সে। এ বার ঘরে উপস্থিত তিন জনই তার দিকে তাকাল।
‘কেন, হঠাৎ চক্ষুদান নিয়ে পড়লে? যাতায়াতের পথে কি কোথাও চক্ষুদান শিবিরের ফেস্টুন দেখেছ?’
মায়ের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই বাবা উঠে এসেছিলেন তার কাছে।
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে এ বার তার প্রশ্ন, ‘হঠাৎ চক্ষুদান নিয়ে পড়লি কেন? কালকের হোমটাস্ক কমপ্লিট?’
তিতাস তখন রেগে কাঁই। কেউ বুঝতে পারছে না তার প্রশ্নটাই। একটা অসম্ভব জানবার ইচ্ছে, অথচ, কেউ কি পাত্তা দিচ্ছে? টিভির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে মা তাকে প্রশ্ন করেছে। কিন্তু, মন দিয়ে কি ওর জিজ্ঞাসা শুনেছে? বাবাও তাই। শব্দরহস্য সমাধানসূত্র মাথায় ঘুরছে। ছেলের প্রশ্নের গভীরে যাওয়ার মানসিকতা নেই। অ্যাটেনশন দিতে হয়, তাই বোধ হয় দিয়েছে।
ইতিমধ্যে নিবেদিতা উঠে এসেছিলেন নাতির কাছে। টিভির চ্যানেলে তখন বিজ্ঞাপনের ব্রেক। রজত মাথার জট ছাড়াতে ব্যালকনিতে যান। রূপালী কিচেন অভিমুখে। বিজ্ঞাপনের সময় টিভির সাউন্ডটা মিউট থাকাতে শব্দদূষণ নেই ঘরের মধ্যে।
তিতাসের পাশে বসে নিবেদিতা প্রশ্ন করেন, ‘কী হয়েছে রে দাদুভাই?
হঠাৎ চক্ষুদান...’
ঠাম্মা তার চুলে বিলি কাটছিল। তিতাস বিড়বিড় করে বলে, ‘উজ্জ্বলদা বলছিল, চতুর্থীর দিন মায়ের চক্ষুদান করা হবে। সে দিন কেও কমিউনিটি হলে ঢুকতে পারবে না। তাই...।’
নিবেদিতা তখন নাতির গোমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললেন। তার পর ক্লাস সিক্সে পড়া তিতাসের গালে একটা চুমু খেয়ে বলেন, ‘ধুর পাগল, এই কথা! আরে চক্ষুদান মানে মায়ের মূর্তির চোখ আঁকা হবে। কারিগররা এই সংস্কারটা মানে। ধরে নে, চোখ আঁকতে গিয়ে যে কনসেনট্রেশন প্রয়োজন, যে একাগ্রতা দরকার, তোরা থাকলে বকর-বকর করবি। কথাবার্তায় হাত নড়ে যেতে পারে। আর এ তো তোর খাতায় অঙ্ক নয় যে, ভুল হলে ইরেজার বা হোয়াইটনার দিয়ে মুছে ঠিক করে নেবে। তাই। পুরোহিতমশাই মায়ের চক্ষুদান, প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন সপ্তমীর দিন। পরে বুঝবি সে সব।’
ঠাম্মার ব্যাখ্যা শুনে বাবা মায়ের পর সমস্ত রাগ একেবারে জল হয়ে গেল তিতাসের।
‘এক মিনিট...।’ ছুটে ল্যান্ডলাইন ফোনটার কাছে গিয়ে রিসিভার হাতে কারও নম্বর ডায়াল করে। ভেসে আসে ওর কণ্ঠস্বর, ‘শোন অর্ক, চক্ষুদান মানে...’
ঘরের ভেতর তখন হো হো হাসিতে ফেটে পড়ছেন রজত। রূপালীও বাটি করে মুড়ি-চানাচুর মাখা টেবিলে রাখতে রাখতে হাসছিলেন। অপ্রস্তুত তিতাস নিজের জায়গায় ফিরে আসছিল মাথা নিচু করে। নিবেদিতা ওকে জড়িয়ে ধরে ছেলে বউমাকে একচোট বকুনি দিয়ে বলেন, ‘তোমরা আর হাসাহাসি কোরো না তো! ছেলেটা জানতে চাইছে একটা জিনিস, তোমরা ভাল করে না শুনেই নিজেদের মনগড়া উত্তর দিচ্ছ...’।
রজত মুড়ির বাটি হাতে নিয়ে বলেন, ‘ঘাট হয়েছে মা জননী। সত্যি বলছি, এই ব্যাপারটাই মাথায় আসেনি। তবে, দুর্গা ঠাকুরের চক্ষুদান-প্রাণপ্রতিষ্ঠার মতো খটমটে ব্যাপারগুলো ওকে এখন না বুঝিয়ে ভালই করেছ।’
মুড়ির বাটি হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে আসেন রজত। আর এক প্রস্থ হবে এর পর। মুড়ি খেতে খেতে তখন তাঁর মনে পড়ে গেল। কী গণ্ডগোলটাই না হয়েছিল এ বার, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা সিদ্ধান্তকে মিটিংয়ে অনুমোদন করাতে গিয়ে...।
আবাসনের পুজোটা বরাবর পাড়ার ছেলেরাই করে। তাঁরা, বড়রা থাকেন পাশে। তো, এ বারকার সেক্রেটারি অরিত্র সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কমিউনিটি হলেই মূর্তি গড়া হবে। শুধু কাঠামোটা তৈরি হবে কুমোরবাড়িতে। পুজো কমিটির সদস্যরা একমত হওয়াতে ওরা প্রস্তাবটা রেখেছিল সোসাইটির কর্মকর্তা কাকু-জেঠুদের কাছে। কেননা, কমিউনিটি হলটা খোলা থাকবে দিনভর। সিকিয়োরিটি যদিও আছে, তবুও...।
সে দিন সান্ধ্য তাসের আসরে একচোট তর্কাতর্কি হয়ে গেল অরিত্রদের সামনেই। রীতিমতো জেরায় জেরবার হতে হল অরিত্রদের।
‘এত কাল তো ঠাকুর কুমোরবাড়িতেই তৈরি হয়েছে। পঞ্চমীর দিন তোমরা নিয়ে এসেছ। এ বার হঠাৎ...’
‘এ বার ঠাকুর তৈরি করবে উজ্জ্বল। আমাদের কুমোর নির্মলকাকুর ছেলে। আর্ট কলেজের ছাত্র। ওর বাবার খুব ইচ্ছে, হাউজিংয়ের ঠাকুর ছেলে বানাবে। আর উজ্জ্বলও খুব উৎসাহী। ও শুধু প্রস্তাব দিয়েছিল, ঠাকুর যদি কমিউনিটি হলে তৈরি হয়, তা হলে বাচ্চারা দেখতে পাবে, খড়-মাটি থেকে কী ভাবে মৃন্ময়ী প্রতিমা তৈরি হয়। আমাদেরও ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হল।’
সুজিতকাকুর প্রশ্নের জবাব বেশ গুছিয়ে দিল অরিত্র। তখন সোসাইটির সেক্রেটারি বিশ্বনাথজেঠু নিরাপত্তার ব্যাপারটা আনলেন। সারাটা দুপুর তো আবাসন থাকে শুনশান। সিকিয়োরিটি রুম আবাসনের প্রবেশের মুখে। প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত থাকবে উজ্জ্বল।
ওর সাহায্যকারী হিসেবেও দু’চার জন নিশ্চয়ই থাকবে। নিরাপত্তার ব্যাপারটা অতএব ভাবাচ্ছে।
অনেক ‘কিন্তু’ ‘যদি’র মাঝে হাল ধরেন রজতকাকু। চিরকালই যিনি যুবশক্তিকে প্রশ্রয় দেন। যুক্তিযুক্ত ভাবে নিজের ভাবনাগুলো তুলে ধরলেন। ‘বিশ্বনাথদা, ভাবুন তো এক বার, এই জেনারেশনের প্রতিনিধিদের মস্তিষ্কপ্রসূত এই অভিনব আইডিয়া। আমার তো শুনেই দারুণ লাগছে। মনে পড়ে যাচ্ছে, বাবার রেলের চাকরির বদলির জন্য খুব ছোটবেলায় অসমের মরিয়নি নামে একটা ছোট্ট জায়গায় ছিলাম আমরা। তখন ওখানে দুটো পুজো হত। একটা কালীবাড়িতে, অন্যটা রেলওয়ে ইনস্টিটিউটে। কালীবাড়ির পুজো ছিল জাঁকজমক পরিপূর্ণ। চার দিন যাত্রা হত। কলকাতা থেকে যাত্রাদল যেত। তো, কালীবাড়ির মূর্তি তৈরি হত মণ্ডপে। স্কুলে যাতায়াতের পথে আমাদের নিত্য হাজিরা ছিল সেখানে। সনৎ সিংহের সেই বিখ্যাত গানটা মনে করুন তো...! কোথায় হারিয়ে গেল সেই সব দিন। অরিত্ররা যে এই ভাবনাটা ভেবেছে, তাকে বাস্তবায়িত করতে দিন। কিচ্ছু হবে না। দেখবেন, বাচ্চাগুলো কী রকম এনজয় করে...।’
ব্যস, সোল্লাসে ‘থ্রি চিয়ার্স ফর রজতকাকু’ ধ্বনিতে কমিউনিটি হলের ছাদটা যেন ভেঙে পড়বার উপক্রম হল।
তার পর...
বিগত দু’মাসে খড়ের কাঠামো থেকে ধীরে ধীরে মৃন্ময়ী হয়ে উঠেছেন আবাসনের মা দুগ্গা। একচালার সাবেকি প্রতিমা। বড় যত্নে উজ্জ্বল তার প্রথম কাজটায় প্রায় সাফল্যের পথে। তিতাসরা স্কুলে যাওয়ার সময় অবধারিত ভাবেই মিনিট দশেক দাঁড়াবে কমিউনিটি হলে। স্কুল-গাড়ির হর্ন বাজতে থাকে। মায়েদের বকুনি খেয়ে তবে স্কুল গাড়িতে ওঠে। বিকেলে খেলাধুলো তো কবেই লাটে উঠেছে প্রতিমা তৈরির সময় থেকে। স্কুল থেকে ফিরে কে কত আগে এসে চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসবে, তার প্রতিযোগিতা চলে। আর প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দেয় উজ্জ্বলকে।
‘উজ্জ্বলদা, সাবেকি প্রতিমার কী মানে?’
‘মানে পুরনো ধাঁচের। কোনও থিম-টিম নেই যাতে।’
‘শিব ঠাকুর ওপরে কেন বসে থাকে গো?’
‘কৈলাসে বসে বসে সব ওয়াচ করেন— বউ ছেলেমেয়েরা কী রকম খাওয়াদাওয়া করছে...।’
হেসে গড়িয়ে পড়ে ছেলের দল।
‘জানিস তো, মা দুগ্গাকে এই জন্যই দশমীতে কচুর শাক, শাপলা ফুলের অম্বল খেতে দেওয়া হয়, যাতে মুখে ভাল-মন্দ খাওয়ার গন্ধ না থাকে।’
আবার হাসির ছররা ওঠে।
আবাসনের শিউলি গাছটা ফুলে ফুলে সাদা হয়ে থাকে। ভোরবেলায় ফুল কুড়োবার ধুম পড়ে যায়। ঘাসের ডগায়, শিশিরের কণায় সূর্যের আলো এসে পড়ে। চিকমিক করে ওঠে স্বর্গীয় সকাল।
এখন আবাসনের সবাই খুশি। ছোটদের সঙ্গে বড়রাও যখন তখন ঠাকুর বানানো দেখতে বসে যাচ্ছে।
অরিত্রদের দম ফেলার সময় নেই। কমিউনিটি হলে রঙিন কাপড়ের শোভায় প্রায় তৈরি হওয়া প্রতিমা শোভা পাচ্ছে।
চক্ষুদান পর্ব সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার পর প্রতিমার রূপটা কল্পনা করছিল তিতাস শুতে যাওয়ার আগে।