পা ন্তা ভা তে...

আমি ছিলাম পঞ্চমের সুরের ডাস্টবিন। ‘ইয়ে সুর তু লে গুল্লু, কোই নহি লেগা, কোই সমঝেগা নহি।’ অর্থাৎ কিনা ওর যত আশ্চর্য এক্সপেরিমেন্ট ও আমায় দিয়ে দিত। এক দিন ঘরে বসে আছি। ও একটা রেকর্ড শোনাচ্ছে। মাথার ওপর পাখা ঘুরছে। দুটো সুরই ভীষণ ঘ্যানঘেনে। কিন্তু এ দুটো থেকে ও একটা আশ্চর্য সুর তৈরি করল। বলল, ‘প্লিজ, একটা লাইন বল, না হলে সুরটা হারিয়ে যাবে।’ আমার মাথায় যা এল বললাম। তার পর গানটা তৈরি হয়ে গেল। এ বার পঞ্চম নাছোড়। এটা আমার সিনেমায় লাগাতেই হবে।

Advertisement

গুলজার

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৫
Share:

আমি ছিলাম পঞ্চমের সুরের ডাস্টবিন। ‘ইয়ে সুর তু লে গুল্লু, কোই নহি লেগা, কোই সমঝেগা নহি।’ অর্থাৎ কিনা ওর যত আশ্চর্য এক্সপেরিমেন্ট ও আমায় দিয়ে দিত। এক দিন ঘরে বসে আছি। ও একটা রেকর্ড শোনাচ্ছে। মাথার ওপর পাখা ঘুরছে। দুটো সুরই ভীষণ ঘ্যানঘেনে। কিন্তু এ দুটো থেকে ও একটা আশ্চর্য সুর তৈরি করল। বলল, ‘প্লিজ, একটা লাইন বল, না হলে সুরটা হারিয়ে যাবে।’ আমার মাথায় যা এল বললাম। তার পর গানটা তৈরি হয়ে গেল। এ বার পঞ্চম নাছোড়। এটা আমার সিনেমায় লাগাতেই হবে। কিন্তু আমি যে সিনেমাটা তখন করছিলাম, সেটা প্রায় শেষ। আমি বললাম, ‘পঞ্চম, গানটার তো কোনও জায়গা নেই রে!’ খুব আহত হয়ে হলল, ‘গুল্লু, তুই এই সুরটা না নিলে কেউ নেবে না, কেউ বুঝবে না। এই গানটায় অনেক রকম বাজনার এক্সপেরিমেন্ট আছে। দ্যাখ না।’ আমি পঞ্চমের করুণ মুখ কিছুতেই সহ্য করতে পারি না। অগত্যা সিনেমার টাইট্ল কার্ডে গান রাখা হল। সেই প্রথম টাইট্ল কার্ডের সঙ্গে গান রাখার রেওয়াজ চালু হল। গানটা ছিল, ‘ছোটিসি কহানি সে, বারিষোঁ কে পানি সে...’, ইজাজত সিনেমায়।

Advertisement

আর একটা দারুণ মজার গল্প, খানিকটা মনোমালিন্যেরও বলা যেতে পারে। আমি ইজাজত-এর একটা গান লিখে নিয়ে গেলাম পঞ্চমের কাছে সুর করতে। দেখেটেখে রেগে গেল। বলল, ‘গুল্লু, তুই তো কাল আমায় খবরের কাগজের হেডলাইনগুলো নিয়ে এসে বলবি, এটার সুর করে দে।’ আমি চুপ। ও তাতে আরও রেগে গেল। বুঝতে পারল যে এ বার আমি গানের কথা কিছুতেই বদলাব না। রাগে গজগজ করতে করতে সুর করল, ‘মেরা কুছ সামান’ গানটার। আর তার পর যেমন সবাই বলে, ‘বাকিটা ইতিহাস।’

আমি, আশাজি আর পঞ্চম, তিন জন মিলে একটা ক্যাসেট করেছিলাম। ‘দিল পড়োশি হ্যায়’। সেই ক্যাসেটটায় পঞ্চমের কত যে আশ্চর্য এক্সপেরিমেন্ট ছিল বলে শেষ করার নয়। পঞ্চমের বহু আধখানা সুর, কিছু আশ্চর্য বাজনার এক্সপেরিমেন্ট, কিছু নতুনত্ব— সব অনেক দিন ধরে জমানো ছিল। সেই সব নিয়ে ওই ক্যাসেটটা। কিন্তু সেই ক্যাসেটটা আর কিছুতেই হয়ে উঠছিল না। এক দিন আশাজি বেশ রাগ রাগ করেই বললেন, ‘তোমরা যদি ক্যাসেট না করো, তা হলে আর আমিও এ নিয়ে কিচ্ছু ভাবব না।’ পঞ্চম আমায় বলল, ‘চল গুল্লু, তোর বাড়ি যাই। বব যখন বলছে, তখন করে ফেলি। এ সব ফালতু কাজ আমার বাড়িতে না করাই ভাল।’ পঞ্চম আশাজিকে বব বলে ডাকত।

Advertisement

পঞ্চম কাজ শুরু করল। এক দিন একটা গানে পঞ্চম ‘বম বম বম’ বলে একটা সাউন্ড তৈরি করল নিজে। সেটা বম বম বম বলেই গাওয়া হল!!! হিউম্যান সাউন্ড ব্যবহার করল বাজনার মতো করে। আশাজি এসে আমায় বলল, ‘আপনি বলুন না, এটা শুনতে ভাল লাগছে না। আমি বললে শুনবে তো না-ই, বরং রেগে যাবে। আপনার কথা তো শোনে।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি বলব, আশাজির এটা ভাল লাগছে না। কারণ আমার তো ভালই লাগছে।’ আশাজি বলল, ‘না না। সেটা করলে আরও বিগড়ে যাবে।’

পঞ্চম যে কখন বিগড়ে যাবে বোঝা খুব মুশকিল ছিল। এমনিতে বেশ ভোলাভালা কিন্তু এমন ঠোঁটকাটা যে, মাঝে মাঝে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে যেত। ডিরেক্টর বা প্রোডিউসাররা মাঝে মাঝে বিদেশি রেকর্ড আনিয়ে মিউজিক ডিরেক্টরদের দিয়ে বলতেন, এই রকম একটা, ওই রকম সুরে একটা গান বানিয়ে দিন। এই রকম মুডে একটা গান বানিয়ে দিন। এক দিন নাসির হুসেন এলেন। পঞ্চম ওঁর পরের ছবির মিউজিক ডিরেক্টর। হাতে একটা রেকর্ড। পঞ্চমকে দিয়ে বললেন, অমুক নম্বর গানটার মতো বেশ একটা জম্পেশ গান বানাও তো দেখি।

পঞ্চম নিজের স্টাইলে হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে বলল, ‘নাসির সাহাব, হম ভি মিউজিক ডিরেক্টর হ্যায়, কভি হমে ভি মওকা দিজিয়ে।’ গোটা ঘর হঠাৎ চুপ। নাসির হুসেন তখন একেবারে খ্যাতির মধ্যগগনে। পঞ্চম যে কখন কী বলে দেবে, সেটা আগে থেকে বোঝা কঠিন ছিল। একই পরিস্থিতিতে ও অনেক রকম ব্যবহার করতেই পারে।

এই যে ওর সব সময় বদলে যাওয়ার একটা ক্ষমতা ছিল, সেটাই ওর মিউজিকে প্রতিফলিত হত। কোনও একটা ধরন দিয়ে পঞ্চমকে বোঝানো যাবে না। ওর কোনও ট্রেডমার্ক সুর ছিল না সম্ভবত। যা কিছু অন্য রকম, তা-ই পঞ্চমকে টানত। আর তাই পঞ্চমের ঘরানা বলতে হলে একমাত্র এক্সপেরিমেন্টাল কাজকেই সেই তকমাটা দেওয়া যেতে পারে।

এখনকার দিনে যাদের সঙ্গে কাজ করেছি তাদের মধ্যে এ আর রহমান আর বিশাল ভরদ্বাজ, এই দুজনের সঙ্গে কাজ করতে বেশ ভাল লাগে। কিছুটা আগের ফ্লেভার হয়তো পাই। কিংবা হয়তো ভুল করে ভাবি আগের মতো।

আসলে না বলতেই বুঝে যাওয়ার একটা ব্যাপার ছিল পঞ্চমের সঙ্গে আমার। কেমিস্ট্রি বলে কি তাকে? না কি, অধিকার থেকে জন্মায় এমন অ্যাবসলিউট বোঝাপড়া? কিংবা হয়তো আমার আর ওর কিছুটা করে অংশ আমরা এ ওর কাছে গচ্ছিত রেখেছিলাম। তাই দুজনের মনে একই রকম ভাবে রং ধরত। সেটাই হবে। এটাই আমার কাছে একমাত্র ব্যাখ্যা মনে হয়।

পঞ্চম বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেল, না? অবশ্য ওর তো সবেতেই তাড়া ছিল। চা করতে বলেছে হয়তো। চা এল। বড্ড গরম। কিন্তু পঞ্চমের তো সময় নেই। কেন নেই অবশ্য কেউ জানে না। কোথাও যাওয়ারও নেই। কিন্তু তাড়া আছে। সুর ভাঁজতে ভাঁজতে গরম চায়ের কাপে বোতল থেকে কিছুটা জল ঢেলে ঠান্ডা করে নিয়ে চা খেয়ে নিত। সে যে আগে আগে জীবনের পাট চুকিয়ে দেবে, সেটা বোধ হয় আশ্চর্যের নয়। কেবল একটাই আফশোস হয়। আমি রয়ে গেলুম বটে, কিন্তু অর্ধেকটা মতো। আমার অনেকটা পঞ্চমের সঙ্গে চলে গিয়েছে তো। তাই এখনকার গুলজার বোধ হয় আধা-অধুরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন