জ্যোতি বসু, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে, শ্রদ্ধায় ও রোমাঞ্চে কেঁপে যাওয়ায়, ছবিটা নড়ে গেছে।
প্রতিবেদক: সবাই জানে, আপনার চেতনা এখনও জাগ্রত। চারপাশে যা হচ্ছে সে সব বিষয়েও সচেতন। এই যে নির্বাচন হচ্ছে, আপনার সঙ্গে কেউ কোনও বিষয়ে আলোচনা করেননি? বুদ্ধবাবু, বিমানবাবুরা?
জ্যোতি বসু: ক্যান্ডিডেট লিস্ট নিয়ে কারা যেন দুজন এসেছিল। বিমান নাকি ওদের পাঠিয়েছিল লিস্টটা আমাকে দেখাতে। তো, আমি অনেককেই চিনি না। যাদের চিনি, তাদের অনেকেই তো নেই।
প্রতি: সিপিএমে লক্ষ্মণ শেঠ নেই। বহিষ্কৃত। তার আগে রেজ্জাক মোল্লাকেও দল বের করে দিয়েছে। সিদ্ধান্তের আগে জানতে পারেননি?
বসু: না, না। ও সব নেতৃত্বের ব্যাপার। রাজ্য কমিটির সিদ্ধান্ত।
প্রতি: সিদ্ধান্ত সঠিক?
বসু: আমার বলা না-বলায় কী হবে! তবে লক্ষ্মণের নামে বহু দিন ধরেই কমপ্লেন হচ্ছিল। আর রেজ্জাক যা বলেছে, তা সবই ভুল, বলব না। কিন্তু ও ভাবে বলা, বাইরে এসে প্রকাশ্যে নেতাদের নাম করে গালাগালি করা, এ সব তো কমিউনিস্ট পার্টিতে চলে না।
প্রতি: আপনিও তো পার্টির বাধায় প্রধানমন্ত্রী হতে না পেরে প্রকাশ্যে দলের ‘হিস্টোরিক ব্লান্ডার’ ধরিয়ে দিয়েছিলেন। সেটাও কি সমালোচনা ছিল না?
বসু: আপনাদের মুশকিল হল, আপনারা কোনও পারস্পেকটিভ বোঝেন না। আমি কোনও ব্যক্তির নাম করে সমালোচনা করিনি। দলের সিদ্ধান্ত মানছি না, সে কথাও বলিনি। নীতির প্রশ্নে একটা বিকল্প ভাবনার কথা বলার সময় ওই মন্তব্য করেছিলাম। জানেন না, আরও দু’বার তো রাজীব গাঁধী আমাকে প্রধানমন্ত্রী হতে বলেছিলেন? এক বার চন্দ্রশেখরকে প্রধানমন্ত্রী করার সময়। তখন আমি ছিলাম রাজীবের ফার্স্ট চয়েস। দেবীলাল সেকেন্ড। চন্দ্রশেখর লাস্ট। আমার পার্টি রাজি হয়নি। তার পরে আবার চন্দ্রশেখরের সরকার পতনের সময় রাজীব আমাকে প্রস্তাব পাঠায়। আমার দল বলে দেয়, না। আমিও তো পুরো একমত ছিলাম তখন। কিন্তু ১৯৯৬-তে অবস্থাটা ছিল আলাদা। বিজেপি-কে আটকাতে আমরা যেতে পারতাম।
প্রতি: সেই বিজেপি তো এ বারেও আসতে চলেছে। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে কেমন হবে?
বসু: খুব খারাপ হবে। ভয়ংকর হবে। কিন্তু উপায় কী! বিকল্প সরকার করব বললেই তো আর করা যায় না। বাস্তবটা বুঝতে হবে। কোনও বিকল্প ফ্রন্ট তো তৈরিই হল না। কংগ্রেস-জোট গেলে বিজেপি-জোট এটাই দেখছি বার বার। ওসব তৃতীয় ফ্রন্ট-ট্রন্ট কিস্যু হবে না। আমরাও জানি। সবাই জানে।
প্রতি: রাজ্যে? এখানে কী দেখছেন?
বসু: যা আপনি দেখছেন, তা-ই দেখছি। পরিবর্তনের সরকার।
প্রতি: পরিবর্তন দেখছেন তা হলে?
বসু: অবশ্যই! আইনের শাসন কিছু আছে না কি! অপরাধীদের পাশে সরকার দাঁড়িয়ে পড়ছে! আদালত রোজ বকাবকি করছে।
প্রতি: তেমন তো আপনাদের আমলেও অজস্র ঘটেছে।
বসু: হ্যা।ঁ অজস্র না হলেও হয়েছে। আমরাও ভুল করেছি। কিন্তু যারা এল, তারা সেই ভুল করলে আর পরিবর্তনের শিক্ষাটা হল কোথায়!
প্রতি: তার মানে, মমতা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সফল নন?
বসু: না, না। ও ভাবে আমি বলব কেন? তিনি বিপুল সমর্থনে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। নিশ্চয় মানুষ তাঁকে চায়। তবে সমস্ত পদের একটা দায়িত্ববোধ থাকে। সেটা মেনে চলতেই হবে।
প্রতি: একটু বুঝিয়ে বলবেন?
বসু: বোঝানোর কিছু নেই। যিনি মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে অনেক কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে কথা বলতে হয়। ছোটখাটো বিষয়ে তিনি মাথা গলাবেন কেন? তুচ্ছ তুচ্ছ ঘটনায় মন্তব্য করে সেগুলিকে বাড়িয়ে তুলবেন কেন? সব বিষয়ে কথা বলতে দেখেছেন আমাকে? সেই সঙ্গে আছে আপনাদের অত্যাচার! একটা কোনও কথা মুখ থেকে বলিয়ে নিতে পারলেই হল!
প্রতি: মানে, সেই বানতলার ঘটনার পরে ‘এ রকম তো কতই হয়’ বলে আপনি যেমন করেছিলেন?
বসু: হরিব্ল। কিন্তু মমতার মধ্যে কোথাও হয়তো একটা সিনসিয়ারিটি আছে। আমাদের পার্টিকে সরিয়ে দিতে পেরেছে, এটা তো ঘটনা।
প্রতি: কী ভাবে পারলেন মমতা?
বসু: সে সব তো এক কথায় বলা যাবে না। পার্টিতে বিস্তর আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম তো আছেই। বুদ্ধ সিঙ্গুরটা ঠিকমতো ট্যাক্ল করতে পারল না। ওর আরও স্ট্রং হওয়া উচিত ছিল। আর নন্দীগ্রাম তো অ্যাবসলিউট ম্যাসাকার অন দ্য পার্ট অব পুলিশ-অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। মমতা সেগুলি কাজে লাগালেন। এ সব ছাড়াও আমাদের দলের লোকেদের ঔদ্ধত্য একটা বড় কারণ। সেটা অবশ্য এখন মমতার দলেও দেখছি বাড়ছে। এটাই খারাপ লক্ষণ।
প্রতি: আর দুর্নীতি? স্বজনপোষণ?
বসু: সেটা কমবেশি হয়েই থাকে। দেখুন, দল ক্ষমতায় থাকলে এক দল করে খাবেই। কত আটকাবেন আপনি? এটা তো বৃদ্ধির সমস্যা। আর স্বজনপোষণ? সেটাও অনেক ক্ষেত্রে রিলেটিভ ব্যাপার। যেমন, আমার ছেলের বাবার নাম যদি জ্যোতি বসু হয়, তাহলে তার অ্যাডভান্টেজ কিছু থাকলে সেটা স্বাভাবিক ভাবেই তার কাছে এসে যায়।
প্রতি: মমতা কিন্তু ভাবমূর্তিতে স্বচ্ছ।
বসু: হ্যা।ঁ শি ইজ ভেরি সিম্পল। আমার কাছে কয়েকবার এসেছে। খুব রেসপেক্টফুল। আন্তরিক।
প্রতি: আপনি কিন্তু অনেক বার ওঁকে ‘বাজে মেয়ে’ বলেছেন। এখন কি মনে হয়, সেটা ভুল ছিল?
বসু: ওর রাজনীতিটা তো সত্যি বাজে ছিল। ও বিজেপি-র হাত ধরেছিল, কংগ্রেসের হাত ধরেছিল। কী করবে, কোনটা পথ, সেটা নিয়েই কনফিউজ্ড!
প্রতি: এখন তো উনি একা লড়ছেন। এই লোকসভার নির্বাচনে কোনও জোটে উনি নেই।
বসু: নাউ ইউ মে সি হার ওন স্ট্রেংথ।
প্রতি: সেটা কি আপনাদের চেয়ে কম?
বসু: আমাদের কথা বলছি না। আমাদের পার্টি তো এখন পিছিয়ে পড়েছে।
প্রতি: ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই?
বসু: সে সব ওরা বলুক। আমি কে? আমি কি পার্টি চালাচ্ছি!
প্রতি: কে বলবেন? বুদ্ধবাবু? বিমানবাবু?
বসু: জানি না, কোন বাবু! তবে বাবুদের বুঝতে হবে, পার্টিকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়াই একমাত্র পথ। মানুষ বিশ্বাস না করলে উপায় নেই। আর মানুষকেও বিশ্বাস করতে হবে। নইলে সেটা পাপ।
প্রতি: তা হলে পার্টির সুদিন ফিরবে বলছেন?
বসু: দুর্দিন কারও চিরদিন থাকে না। সুদিনও না।
প্রতি: এই ভোটে কি তার প্রতিফলন দেখা যাবে?
বসু: আমি গণৎকার নই। তবে মানুষের আস্থা হারালে তা ফিরে পেতে সময় লাগে। মমতার উপর মানুষের বিশ্বাস ভেঙে গেছে, এখনই আমি তা বলব না। পলিটিক্স ইজ আ লং লাস্টিং গেম। ও কে! অনেক ক্ষণ হল। এ সব আবার লিখে দেবেন না যেন! আমি আর এখন কিছুতে নেই। আমার কথা নিয়ে কোনও কন্ট্রোভার্সি চাই না।
পুনশ্চ: মাপ করবেন জ্যোতিবাবু, আপনার অনুরোধ রাখতে পারলাম না। আশা করি সব বুঝবেন।