অনুবাদ গল্প

পরিত্রাতা

ভার্জিলিয়ো পিনেরা (কিউবা)আমার মৃত্যুর দিনক্ষণ আমি আগে থেকে জানতে পারব না, এই এক মারাত্মক ভয় আমাকে পেয়ে বসেছে। বউ অবশ্য বলত এই ভয়টার জন্য দায়ী আমার বাবা। মা যখন মৃত্যুশয্যায়, বাবা আমাকে মা’র কাছে নিয়ে গিয়ে বসান, এক রকম বাধ্য করেন মাকে চুমু খেতে। তখন আমার বয়স দশ। আর মৃত্যুর ছায়া যে শৈশবের ওপর কী ভয়ংকর ছাপ ফেলে, কে না জানে! তবে আমার গল্পটা একটু আলাদা। আমার বউ জানে না, নিজের চোখে আমি একটা লোককে খুন হতে দেখেছি।

Advertisement

অনুবাদ শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী

আমার মৃত্যুর দিনক্ষণ আমি আগে থেকে জানতে পারব না, এই এক মারাত্মক ভয় আমাকে পেয়ে বসেছে। বউ অবশ্য বলত এই ভয়টার জন্য দায়ী আমার বাবা। মা যখন মৃত্যুশয্যায়, বাবা আমাকে মা’র কাছে নিয়ে গিয়ে বসান, এক রকম বাধ্য করেন মাকে চুমু খেতে। তখন আমার বয়স দশ। আর মৃত্যুর ছায়া যে শৈশবের ওপর কী ভয়ংকর ছাপ ফেলে, কে না জানে! তবে আমার গল্পটা একটু আলাদা। আমার বউ জানে না, নিজের চোখে আমি একটা লোককে খুন হতে দেখেছি। সিনেমা হলের বাথরুমে দুটো লোক আর একটা লোকের গলায় ফাঁস লাগাল, তার পর তার গলার নলিটা কেটে দিল। আমি তখন ওই বাথরুমেরই একটা পায়খানায়, হালকা হচ্ছি, ওরা আমাকে দেখেনি, ওরা ছিল পেচ্ছাপখানার ও-দিকটায়। দিব্যি পটি করছি, হঠাৎ শুনলাম, ‘আমাকে মেরে ফেলো না...’ খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে দেখলাম, একটা ছুরি গলার নলি কেটে বেরিয়ে গেল। রক্তের স্রোত। একটা চিৎকার, দু’জোড়া পা ছুটে পালাল তীব্র গতিতে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে আমাকে দেখতে পায় অজ্ঞান, আধমরা অবস্থায়, ওদের ভাষায় যাকে বলে ‘ট্রমা’। মাসখানেক আমি ও রকম ছিলাম, জীবন আর মৃত্যুর মাঝে, ঝুলন্ত।

Advertisement

লোকটার গলার নলি কাটা দেখে আসলে আমাকে চেপে ধরেছিল এই ভয়টা: কখন আসবে মৃত্যু? ধরুন বছর আশির কোনও বুড়ো, মরার জন্য যে মোটামুটি প্রস্তুত, তার মনে স্রেফ এই চিন্তাই ঘুরবে, আজ রাতেই কি...? কাল...? না কি পরশু ভোর রাতে, তিনটেয়? না কি এক্ষুনি, যখন আমি পরশু রাত তিনটের কথা ভাবছি? আবার, বাথরুমের ওই খুন-হওয়া লোকটা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গিয়েছিল, ওর মৃত্যুর সময়টা কখন আসছে। ঠিক যখন ও বলে উঠল, ‘আমাকে মেরে ফেলো না’, ও বুঝতে পেরেছিল, সময় হয়ে এসেছে। ওই মরিয়া আর্তনাদ আর গলার নলি কেটে যাওয়ার এক্কেবারে মধ্যিখানটায়, বুঝতে পেরেছিল, ওর মৃত্যুর মুহূর্তটা ঝুলছে।

আর এ দিকে, নব্বই বছরের থুত্থুড়ে আমি এখন বিছানায় একা শুয়ে (আমার স্ত্রী গত বছর মারা গিয়েছে, আর সে বেচারি বেঁচে থাকলেও আমার মরার দিনক্ষণ বিষয়ে আদৌ কোনও সাহায্য করতে পারত কি না সন্দেহ), আমার বুদ্ধির তলানিটুকু হাতড়াচ্ছি।

Advertisement

সিনেমা হলের বাথরুমে যে দিন সেই গলার নলি-কাটা লোকটা তড়পাচ্ছিল, তখন আমার বয়স কুড়ি। জীবন সামনে অনন্তের মতো বিছানো। তাই, ওই রক্তাক্ত দৃশ্যটা আর মৃত্যু বিষয়ক ভয়ানক প্রশ্নগুলো সহজেই মুছে ফেলা গিয়েছিল। তখন শুধু বাঁচবার, উদ্দাম বাঁচবার সময়। কী সুন্দর স্বাস্থ্য আমার! শরীরের প্রতিটা রোমকূপ থেকে যেন প্রাণশক্তি ঝরে ঝরে পড়ছে। খিদে পেলে আস্ত একটা গরু খেয়ে ফেলতে পারি, ইচ্ছে করলে দিনে পাঁচ বার সঙ্গম করতে পারি। টানা কুড়ি ঘণ্টা কাজ করতে পারি অক্লান্ত। মৃত্যু মানে কী, মরা ব্যাপারটা কেমন, ও সব মাথাতেই আসে না!

কিন্তু পঞ্চাশের পর থেকেই মনে হতে লাগল, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। মৃত্যুর মুহূর্তটা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। বেঁচে থাকলাম বটে, কিন্তু একই সঙ্গে মরছিলামও একটু একটু করে। আর একটা মরিয়া, লোভী কৌতূহল আমাকে চাপ দিচ্ছিল ওই অন্তিম মুহূর্তটার মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য। মরবই যখন, ওইটুকু যদি জানতে পারতাম যে ঠিক কখন মৃত্যুটা হবে, ঠিক যতটা নিশ্চিন্ত ভাবে আমি আমার দাঁত মাজার সময়টা জানি...

বয়স যত বাড়ল, এই চিন্তাটা আমাকে পেয়ে বসল, গিলে খেতে থাকল। যখন সত্তর, জীবনে প্রথম প্লেনে চড়লাম। অপ্রত্যাশিত ভাবেই। বউদির টেলিগ্রাম এল, দাদা মৃত্যুশয্যায়। প্লেনের টিকিটই কাটলাম। ওড়ার ঘণ্টা দুয়েক পর, বাইরে খুব বাজে আবহাওয়া। ঝড়ের মুখে প্লেনটা তখন একটা পালকের মতো: যাত্রীদের ভয়তরাসে মুখ, এয়ার হোস্টেসদের দ্রুত চলাফেরা, এটা-ওটা পড়ে যাওয়ার শব্দ, মহিলা আর বাচ্চাদের চিৎকার, তারই মধ্যে ঈশ্বর ও মেরির কাছে প্রার্থনা...

‘থ্যাঙ্ক গড!’ মনে মনে বললাম। ‘জীবনে এই প্রথম নিজের মৃত্যুর সময়টা এগিয়ে আসছে, বুঝতে পারছি। এই যে প্লেনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে— এই বিপদকালে নিজের মরণ-মুহূর্ত গোনার কাজটা শুরু করতেই পারি। আর দশ, পনেরো... আটত্রিশ মিনিট? একই ব্যাপার। মৃত্যু... তুমি আচমকা এসে আমায় চমকাতে পারবে না।’

স্বীকার করছি, দারুণ আনন্দ হয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি, মরে যাচ্ছি তাই প্রার্থনা করি, এক বার ঘুরে দেখে নিই গোটা জীবনটা, অনুতাপ করি, বা এ রকম সময় যেমনটা হয়, বমি করি। না। আমি শুধু একমনে অপেক্ষা করছিলাম প্লেনটা কখন ক্র্যাশ করবে, যাতে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে বুঝতে পারি যে সে এসেছে, আমার মরার মুহূর্তটা এসেছে।

বিপদ কেটে যাওয়ার পর এক সহযাত্রী বলল, ‘আচ্ছা, এই যে আমরা পড়ে যাচ্ছিলাম, এই গোটা সময়টা আপনি মশাই এমন মুখ করে বসেছিলেন যেন কিছুই হয়নি!’ উত্তর না দিয়ে হাসলাম একটু। মহিলাটির চোখেমুখে তখনও উদ্বেগ মাখা, কিন্তু সে তো আর আমার উদ্বেগের কথা জানে না— জীবনে প্রথম বার, মাটি থেকে চল্লিশ হাজার ফুট ওপরে, যে উদ্বেগ পালটে গিয়েছিল এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে, যে অনুভূতি হয়ে থাকে চার্চের সবচেয়ে জ্ঞানী সাধুসন্তদের।

কিন্তু রোজ রোজ তো আর প্লেনে চড়া যায় না। আমার এই দীর্ঘ জীবনে ওটাই একমাত্র স্বর্গের ঝলক। বরং উলটোটাই হয়। আমরা সবাই যে যার হাতে-গড়া নরকে পচতে থাকি। সেই নরকের দেওয়ালগুলো দুর্ভাবনা দিয়ে তৈরি, ছাদগুলো ভয়ে মোড়া, জানলা দিয়ে তাকালে শুধু অতল গহ্বর। আর ভেতরে, নিবু-নিবু একটা আলোর তলায় জমে যেতে থাকি আমরা, আর আগুনটা জীবনকে শুষে নেয় ভয়াবহ সব প্রশ্নের আকারে: কখন? মঙ্গলবার? শনিবার? হেমন্তে? বসন্তে...?

এ ভাবেই জমতে থাকি, পুড়তে থাকি আরও। নিজেকে মনে হয় মিউজিয়মে সাজিয়ে রাখা মান্ধাতার আমলের কোনও বস্তু, অপুষ্টিতে ভোগা। আমি নিশ্চিত, আমার শিরায় এখন রক্ত না, পুঁজ বইছে, গায়ের পাঁচড়াগুলো বিজবিজে গোলাপি হয়ে উঠেছে, হাড়গুলো উলটে, পালটে গিয়েছে শরীরের আকারটাই। চিমড়ে শরীরে কণ্ঠার হাড়দুটো একটা নোঙরের মতো, জাহাজের এক ধারে ঝুলছে। মাথার খুলিটা যেন তোবড়ানো নারকোলের মালা, হাতুড়ি মেরেছে কেউ।

এত কিছুর পরেও, আমার মাথায় সেই একটাই ভাবনা। এক্ষুনি, এই মুহূর্তে বিছানায় টানটান শুয়ে আছি, মাথার ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে মৃত্যু। এমনকী মৃত্যু দেওয়ালে টাঙানো বাবার ওই ছবিটাও হতে পারে, আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘দেখছ দেখো, কিন্তু কখন যে অ্যায়সা একখান ঘুসি হাঁকড়াব, নিজেও জানো না।’

বাবার ছবির দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে বললাম, ‘সে হচ্ছে না। তুমি এক চুল সরলেও আমি বুঝে যাব, চেঁচাব, এই তো, ধরে ফেলেছি! সময় এসেছে! বলো, বলো তুমি হেরে গেছ!’ আর ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন ঠিক-ভুল, সত্যি-মিথ্যে একাকার হয়ে গিয়েছে, পায়ের শব্দ শুনলাম। ছবি থেকে চোখ সরিয়ে তাকালাম আলমারির আয়নাটার দিকে। দেখি এক যুবকের মুখ, শুধু মুখটাই দেখতে পেলাম। খুব একটা পাত্তা দিলাম না মুখটাকে। এই বয়সে, এই অবসাদের মধ্যে একটা অচেনা মুখের উপস্থিতি মেনে নেওয়া কী আর এমন কাজ। ওই অচেনা মুখটা হয়তো আমার ঘরে ছড়িয়ে-থাকা হাজারটা জিনিসের, বা আমার মাথার মধ্যে কিলবিল করতে থাকা ভূতগুলোর কোনও একটা হবে। বাবার ছবির দিকে তাকালাম, তার পর আবার যখন চোখ গেল আয়নায়, দেখলাম মুখটা আর নেই। ফের ছবির দিকে তাকাতে দেখি বাবার মুখে একটা রাগ... ওটা বাবার মুখই তো? হ্যাঁ কিছুটা, কিন্তু পুরোপুরি নয়, যেন কোনও ট্র্যাজেডি থেকে উঠে আসা চরিত্র, কে জানে! বাস্তব-অবাস্তবের মধ্যেকার এই সীমানায় সব সম্ভব— সবই ঘটছে, আবার ঘটছেও না। আমি চোখ বন্ধ করে বলতে লাগলাম: এই তো, এ বার, এক্ষুনি। হঠাৎ পায়ের শব্দ, খুব কাছে। দেখি, বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে সেই অচেনা মুখ। ভাবলাম, বাহ্, আয়নায় যাকে দেখলাম, সে-ই। আবার চোখ ফেরালাম বাবার ছবির দিকে। হঠাৎ কী মনে হল, আর এক বার তাকালাম অচেনা-মুখের দিকে। একটা ছুরি বার করে আস্তে আস্তে সে ঝুঁকে পড়ছে আমার ওপর। এত ক্ষণে বুঝলাম, ও আসলে আমাকে বাঁচাতে এসেছে! মৃত্যুর মুহূর্তটা আসার অনেক ক্ষণ আগেই আমি নিশ্চিত ভাবে জানি, আমার মৃত্যুর নির্দিষ্ট ক্ষণ কখন। গলার নলিটা ফুঁড়ে ছুরিটা যখন আরও গভীরে ঢুকে যাচ্ছে, সেই রক্তস্রোতের মধ্যে আমার পরিত্রাতার দিকে তাকিয়ে আমি বলে উঠলাম, ‘বাঁচালে!’

suvankar88@gmail.com

(সংক্ষেপিত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement