ভুতুড়ে হাসি

অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তীব্যাপারটা তেমন কিছু নয়। অমলবাবু গল্প লেখেন। কলকাতার বড় কাগজে ছাপাও হয়। সব ঠিকঠাকই ছিল। মুশকিল হল এ বার ভূতের গল্প লিখে। এর আগে কোনও দিনই ভূত নিয়ে লেখা হয়নি। নিজে ভিতু মানুষ। সাহস হয়নি। কিন্তু গত সপ্তাহে এক বোকা ভূত নিয়ে মজার গল্প লিখেছেন। তিল্লি পড়েই বলেছিল, ‘জেঠু, ভূত নিয়ে মজা করাটা ঠিক হল না।’

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share:

ছবি: সুমন চৌধুরী।

ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়। অমলবাবু গল্প লেখেন। কলকাতার বড় কাগজে ছাপাও হয়। সব ঠিকঠাকই ছিল। মুশকিল হল এ বার ভূতের গল্প লিখে। এর আগে কোনও দিনই ভূত নিয়ে লেখা হয়নি। নিজে ভিতু মানুষ। সাহস হয়নি। কিন্তু গত সপ্তাহে এক বোকা ভূত নিয়ে মজার গল্প লিখেছেন। তিল্লি পড়েই বলেছিল, ‘জেঠু, ভূত নিয়ে মজা করাটা ঠিক হল না।’

Advertisement

‘কেন বল তো? অনেকেই তো লেখে। তা ছাড়া সবটাই তো গল্প, নাকি? হাঃ হাঃ হাঃ। কী, ঠিক কি না?’

‘ঠিক না ভুল তুমিই বুঝবে, আমার কী!’ তিল্লি আর কথা বাড়ায়নি।

Advertisement

ব্যস, ঘটনা ওইটুকু। আর সে দিন থেকেই অমলবাবু কেমন যেন উলটোপালটা স্বপ্ন দেখছেন। অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছেন। কথা বলতে বলতে থেমে যাচ্ছেন। গলাটা প্রায় শুকিয়ে যাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কোনও সময় হয়তো ভয় ভয় করছে। কোনও সময় বা বোকা বোকা লাগছে। অফিসে এসেও শান্তি পাওয়া যাচ্ছে না।

এখন টিফিনের সময়। সবাই গল্পগুজব করলেও অমলবাবু একেবারেই চুপ।

‘কী ব্যাপার অমলদা, এত চুপচাপ কেন?’ তাপসবাবু সেল ফোনটা টেবিলে নামিয়ে পাশের চেয়ারে বসলেন।

‘না, কিছু না।’

‘কিছু না বললেই হল? ক’দিন ধরেই দেখছি গুম হয়ে আছেন। নতুন কিছু গল্প মাথায় ঘুরছে নাকি?’

‘না, না। ও কিছু না, এমনিই।’

‘বুঝতে পারছেন না তাপসদা, আজ পয়লা এপ্রিল না! কথা বললে যদি, বোকা হয়ে যান। তাই মুখে তালা। হাঃ হাঃ হাঃ।’ পুলকের কথা সবাই হেসে উঠলেন।

কথা মিথ্যে নয়। তিল্লি সাবধান করেছিল, ‘জেঠু, আজ কিন্তু বোকা বানাবার দিন।’ অমলবাবু শুকনো মুখে হেসেছিলেন। এ আর এক উটকো বিপদ! যাক গে। দিনটা ভাল ভাবে কেটে গেলেই হচ্ছে।

বিকেলে হঠাত্‌ আকাশে মেঘ ডাকতেই অমলবাবুর ভয়টা আরও চেপে বসল। মনে হল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা দরকার। পাতাডাঙার মোড় থেকে পথটুকু বেশ নির্জন। আজ আবার টর্চ, ছাতা সব ভুলেছেন।

বাইরে বৃষ্টি নামল। হালকা, ঝিরঝির। পড়ুক। একটু হাঁটলেই বাস স্টপেজ। অমলবাবু ঘড়ি, কাগজপত্তর, টিফিনবাক্স এমনকী মোবাইল সেট, সব কিছু ব্যাগে ভরে নিয়ে চেয়ার ছাড়লেন। ‘আজ উঠি, বুঝলেন।’

‘সে কী! আমরাও তো যাব নাকি?’

অমলবাবু বেরিয়ে এলেন। কিছু বললেন না। তাপসবাবু অবাক! যাঃ বাবা! কী হল কী?

বাস থেকে নামতেই আলো যেন ফুরিয়ে গেল। পাতাডাঙার মোড়ে তেমন লোকজনও নেই। অমলবাবু হারুর চায়ের দোকানের দিকে এগোলেন। বৃষ্টি এখনও থামেনি। গুঁড়িগুঁড়ি পড়ছে। কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করা যেতে পারে। ও মা। কোথায় হারু? সন্ধের মুখেই দোকান বন্ধ করে পালিয়েছে। কী আর করা যায়। অমলবাবু এ বার সোজা বাড়িমুখো।

আবছা আলোতে হাঁটাই মুশকিল। তার ওপরে বেয়াড়া হাওয়া সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। ভিজে জামাকাপড়ে শীত শীত করছে। হঠাত্‌ একটা চাপা শব্দ কানে এল অমলবাবুর। তিনি চার পাশে তাকালেন। শুনশান পথ। ঠিকঠিক দেখাও যাচ্ছে না। মনের ভুল নয়তো। না, তা কী করে হয়? শব্দটা অস্পষ্ট হলেও তিনি ঠিকই শুনেছেন।

এখনও বেশ কিছুটা পথ বাকি। শব্দটা এখন নেই। ভিজতে ভিজতে নিজেকেই কেমন ভুতুড়ে মনে হচ্ছে অমলবাবুর। গাছগুলো আরও বেশি ঝাঁকড়া দেখাচ্ছে। ভাবতে ভাবতেই আবার সেই শব্দ। কীসের শব্দ বুঝতে পারছেন না। বৃষ্টির? না। পাখির? না। মনে হচ্ছে কোনও দুষ্টু বাচ্চার হাসির শব্দ। কিন্তু এখানে বাচ্চা কোত্থেকে আসবে? আশেপাশে কোনও জনবসতিও নেই। কেউ কি মজা করছে? তাই বা কী করে হয়? কেউ তো নেই। সামনে শুধু আঁকাবাঁকা মোরামের রাস্তা। আবার সব চুপ। শব্দ উধাও। গলা শুকিয়ে কেমন দলা পেকে যাচ্ছে। তার মানে কি তিল্লির কথাই ঠিক? ভাবতেই গা-হাত-পা আরও ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। অমলবাবুর এখন মনে হচ্ছে, কেন যে ও-সব লিখতে গিয়েছিলাম। আজ শেষ রক্ষা হলে হয়। ওই ওই সেই শব্দ। চাপা খিলখিল শব্দটা এ বার পায়ে পায়ে এসে গায়ের ওপর পাক খাচ্ছে। এ দিকে পথ যেন ফুরোয় না। অমলবাবুর ভয়ে প্রায় ছুটতে শুরু করলেন। ভুতুড়ে শব্দটা এখনও তাড়া করছে।

দরজা খুলেই তিল্লি অবাক! জেঠুর জামাকাপড় জলকাদায় মাখামাখি। ধপাস করে অমলবাবু সোফায় বসলেন। ঢকঢক করে জল খেলেন। এখন একটু ভাল লাগছে।

‘কী হল জেঠু, শরীর খারাপ?’ তিল্লি একটা তোয়ালে এনে দিল।

‘না রে, রাস্তাটা এত অন্ধকার!

তা ছাড়া আজ টর্চ, ছাতা সবই ভুলেছি তো, বেশ অসুবিধেয় পড়েছিলাম।’ আসল কথাটা চেপে গেলেন অমলবাবু।

‘তা ফোন ধরছিলে না কেন?’

‘ফোন?’

হ্যাঁ। তখন থেকে আমরা ফোন করছি, তাপসকাকু ফোন করছে, তুমি তো ধরছই না।’

‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ। ব্যাগের মধ্যে ফোনটা রেখেছিলাম তো, বুঝতে পারিনি। কেন তাপসবাবু কিছু বলছিলেন নাকি?’

‘কী আর বলবে? তুমি তো নিজেরটা ফেলে তাপসকাকুর ফোনটা ভুল করে নিয়ে এসেছ, সেটাই বলছিল।’

‘তাই নাকি? দেখেছিস, কখন যে ভুল করে...।’ ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করতে গিয়ে চমকে গেলেন অমলবাবু। কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই সেই দুষ্টু বাচ্চার হাসির শব্দটা এ বার ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল হাঃ হাঃ হাঃ-হিঃ হিঃ হিঃ...।

প্রথমটায় ভয় পেলেও এ বার লজ্জা পেলেন অমলবাবু। ছি, ছি, এত ক্ষণ তাপসবাবুর মোবাইলের রিং টোন ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত কি না একটা রিং টোন ওকে এপ্রিলফুল করে দিল!

‘কী হল ফোনটা ধরো।’ তিল্লি চেঁচাল।

অমলবাবু চুপ। ফোনটা এখনও হাসছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement